
আষাঢ়ের শেষ দিন অকৃপণ ছিল আকাশ; ঝুম বৃষ্টি ঝরিয়েছে লাগাতার। বড় রাস্তা থেকে তস্য গলি—কমবেশি সবই তলিয়ে যায়। কিন্তু এমন দিনেও আবদুল মালেকের ঘরে থাকার উপায় ছিল না। জলে সপসপে, কাদায় মাখামাখি রাস্তার পাশে ঠিকই কলার পসার সাজাতে হয়। দুর্যোগ-দুর্বিপাক মানে তো বেচাবিক্রিতেও কোপ, তাই মাত্র দুই পোন কলার মধ্যে বড় অংশই থেকে যায় অবিক্রীত।
শ্রাবণের প্রথম দিন মেঘ ফাঁকফোকর গলে মাঝেমধ্যেই সূর্যের ঝলক দেখা দিচ্ছিল। তখন মধ্যদুপুর। আবদুল মালেকের মনেও আশার আলো ছড়াচ্ছিল, যাক, অন্তত কেনা দামে হলেও কলাগুলোর গতি হতে পারে আজ! তা না হলে তো পুরোটাই লোকসান।
অবশ্য সত্তর ছুঁই ছুঁই মানুষটির গোটা জীবনটাই যেন লোকসানের গল্পের সারাৎসার! এখন কলা বেচে দিনে মেরেকেটে লাভই হয় তিন থেকে চার শ টাকা। কিন্তু এমন দিন মাঝেমধ্যেই দেখতে হয়, যেদিন চালান তুলতে টানাটানি। লোকসানও মেনে নিতে হয় অনেক সময়।
কৈশোরে বাবাকে হারিয়েছেন, তখন বয়স মাত্র ৯। এরপর নিজের পেটের ভাত নিজের জোগাড়ের লড়াই শুরু; ৬৭-তে এসেও তা জারি আছে। কৃষিকাজ, তাঁত বোনা, মাটি কাটা, ইট টানা—কোথায় শ্রম দেননি? তখন শরীরে তাকত ছিল, বয়স কম ছিল, করেছেন। এখন আর পারেন না, কিন্তু এখনো যে নিজের খাবারের বন্দোবস্ত নিজেরই করে নিতে হয়।
এমন আবদুল মালেকদের সংখ্যা কত, যাঁদের ‘গালভরা’ কথায় বলা হয়, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক? দেশের শ্রমজীবী মানুষের অন্তত ৮৫ শতাংশেরই নাকি এই হাল, অর্থাৎ কাজ করলে পয়সা, না হলে ‘খালি পেট’। মজুরি কম, দুঃসময়ের জন্য কিছু তুলে রাখার সুযোগ নেই। অসুখ করলে ধুঁকে ধুঁকে মরো। শরীর কমজোরি হলেও শ্রম দিতে হবে। না পারলে ‘হাত পাতো’।
আবদুল মালেক তাঁত বুনতে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার বেতিল পর্যন্ত গেছেন। সেখানে ছিলেন চার-পাঁচ বছর। অথচ তাঁর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার হোমনা উপজেলার তাকুয়াকান্দি। চরকির মতো এক কাজ থেকে আরেক কাজ, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরেও জীবনে ‘স্থিতি’ আনতে পারেননি।
অবশ্য গত এপ্রিলে বিশ্বব্যাংকের দেওয়া একটা তথ্যই ‘বৈষম্যহীন’ সমাজ গঠনের অগ্রগতি বুঝতে যথেষ্ট সহায়ক। বাংলাদেশে এ বছর আরও ৩০ লাখ মানুষ ‘অতিদরিদ্র’ হবে। ফলে অতিদারিদ্র্যের হার বেড়ে হবে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ, ২০২৪ সালে যা ছিল ৭ দশমিক ৭।
সাড়ে তিন দশক ধরে আছেন ঢাকায়। গেল ১০-১১ বছর ধরে কলা বেচেন; এতে অপেক্ষাকৃত খাটুনি কম বলে। বয়সের সঙ্গে পেরে ওঠেন না, আছে অসুখবিসুখও—পেটে আলসার, উচ্চ রক্তচাপ।
আবদুল মালেকের তিন ছেলে, তিন মেয়ে। দুই ছেলে ব্যবসা করেন, একজন প্রবাসী শ্রমিক। ছোট মেয়েটি প্রতিবন্ধী, ঠিকঠাক কথা বলতে পারেন না, বৈষয়িক বুদ্ধিও কম। ফলে তাঁর বিয়ে টেকেনি; জামাইও নাকি মাদকাসক্ত ছিল। বছর একুশের এই মেয়েটি এখন মেজ মেয়ের কাছে থাকে। তাঁর বিয়ে হয়েছে এলাকাতেই। সংসারের চাপে বড় মেয়ে বাবার খোঁজ নিতে পারেন না।
রাজধানীর পশ্চিম রামপুরার উলন এলাকায় যেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে আবদুল মালেকের, সেটি বড় ছেলের ভাড়া বাসা। কিন্তু সেখানে থাকার শর্ত—নিজের ‘খরচ’ নিজেকেই জোটাতে হবে। স্ত্রী গত হয়েছেন ৯ বছর। বেচারা আবদুল মালেক আর যাবেন কোথায়?
নিজের ধস্ত জীবনের কথা বলতে বলতে মানুষটির চোখেও নামে ‘শ্রাবণধারা’; কোনো বাক্যই পুরো শেষ করতে পারছিলেন না, গলা বুজে আসছিল! লুঙ্গির এক কোণ দিয়ে বারবার চোখ মুছছিলেন। শ্রাবণ যতই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি ঝরাক, এই অশ্রুজলের কাছে কি তা কম পড়বে না!
আর কী আশ্চর্য সমাপতন, শ্রাবণের প্রথম দিন, আবদুল মালেকের চোখে ‘শ্রাবণ’, আর ‘শ্রাবণ বিদ্রোহের’ও বছর ঘুরে এল। যে বিদ্রোহ-অভ্যুত্থানের পাটাতন ছিল বৈষম্যহীন সমাজ-রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা। সেই যে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর নানা টালবাহানায় হাত ফসকে যাওয়া সাম্য-মানবিক মর্যাদা-সামাজিক সুবিচার, সেই হিস্যাই আসলে নতুন করে বুঝে নেওয়ার বন্দোবস্ত পাকা করতে জান-কবুল লড়াই, আরেকবার ‘লাল জুলাইয়ে’।
স্বৈরাচারের শ্বাসরোধী শাসনের গোড়া উপড়ে ফেলার সমবায়ী সেই সংগ্রামে, শ্রাবণের সেই দিনগুলোতে বুকের রক্ত ঢেলে ‘শ্রাবণধারা’কে রঞ্জিত করেছিল কত শত মানুষ! কিন্তু মহান এই আত্মত্যাগের ‘সুফল’ পেতে আরও কত অপেক্ষা?
এমন কোনো লক্ষণ কি স্পষ্ট হয়েছে, যাতে ধরে নেওয়া চলে, যে স্বপ্নে মানুষ মৃত্যুভয় জয় করে রাজপথে নেমেছিল গেল শ্রাবণে, এই শ্রাবণে এসে সেই স্বপ্ন ‘সাকার’ পেতে শুরু করেছে?
আবদুল মালেকের চোখেও তেমন কোনো ‘পরিবর্তন’ ধরা পড়ছে না। অবশ্য তিনি এ কথাও অকপটে কবুল করলেন, লেখাপড়া জানেন না, দেশের ‘দশ দিক’ বোঝেন না, রাজনীতিতেও সমান আনপড়।
অবশ্য গত এপ্রিলে বিশ্বব্যাংকের দেওয়া একটা তথ্যই ‘বৈষম্যহীন’ সমাজ গঠনের অগ্রগতি বুঝতে যথেষ্ট সহায়ক। বাংলাদেশে এ বছর আরও ৩০ লাখ মানুষ ‘অতিদরিদ্র’ হবে। ফলে অতিদারিদ্র্যের হার বেড়ে হবে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ, ২০২৪ সালে যা ছিল ৭ দশমিক ৭।
আবদুল মালেক কি অতিদরিদ্র? বিদায় নেওয়ার সময় তিনি হাতে দুটো কলা গুঁজে দিলেন। এ লেখকের আপত্তি ছাপিয়ে তাঁর আন্তরিকতাও যেন আরেক ‘শ্রাবণধারা’, বললেন, ‘খাইয়ো বাবা, সবরি কলা, ভালা।’ ভালো লাগার শ্রাবণে স্নাত হয়ে ফিরলাম!
এমন ‘সোনার মানুষ’ থাকার পরও ‘সোনার বাংলা’ হয় না কেন?
হাসান ইমাম সাংবাদিক
hello.hasanimam@gmail.com