দক্ষিণ চীনের ফুঝোওতে ডিসেম্বরের ব্যস্ত ও প্রাণবন্ত এক দিনে নিম্নমাধ্যমিক স্কুলের ছাত্ররা পার্কে সমবেত হয়েছে। এই সমাবেশের উদ্দেশ্য, চীনা নেতা সি চিন পিংয়ের মতাদর্শ সম্পর্কে অবহিত হওয়া।
যদিও প্রকাশ্যে তারা এই সমাবেশের নাম দিয়েছে ‘ওয়াকিং ক্লাসরুম অব পলিটিক্স অ্যান্ড আইডিওলজি’ (হাঁটতে হাঁটতে গল্পচ্ছলে রাজনীতি ও মতাদর্শ শেখা ), আদতে এই ক্লাসে ছাত্রছাত্রীরা শিখবে সি চিন পিং তাঁর পুরোনো পরিচিত জায়গায় ভ্রমণ করে নতুন করে কীভাবে আলোকিত হয়েছেন, সে বিষয়ে। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম এভাবেই এই ক্লাসের বর্ণনা দিয়েছে।
স্কুলের নিচের দিককার ছেলেমেয়েরা শিক্ষাসফরে গেছে উত্তরের উপকূলীয় শহর তিয়ানজিনের এক দুর্গে। উদ্দেশ্য, বিদেশি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চীনারা কীভাবে প্রতিরোধ করেছিল, সেই করুণ ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞানলাভ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই শিক্ষাসফরগুলোর উদ্দেশ্য জাতীয়তাবাদী শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও পোক্ত করা। এই সপ্তাহের শুরুর দিকে আইন করে শিক্ষাব্যবস্থায় এই পরিবর্তন আনা হয়েছে।
‘পেট্রিয়টিক এডুকেশন ল’-এর (দেশপ্রেমনির্ভর শিক্ষা আইন) উদ্দেশ্য, জাতীয় ঐক্যকে আরও জোরদার করা। এই আইনের অধীনে দেশ ও ক্ষমতাসীন চায়নিজ কমিউনিস্ট পার্টিকে ভালোবাসার বাধ্যবাধকতা আছে। এই আইন কর্ম ও শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং এর আওতাভুক্ত হবে শিশু থেকে শুরু করে সব খাতের কর্মী, পেশাজীবী।
চীনের নানা ভাবাদর্শকে একীভূত করে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে তুলতে এই আইন করা হয়েছে। উদ্দেশ্য, চীন যেন বিশ্বমঞ্চে অর্থনীতি ও রাজনীতিতে মূল চালিকা শক্তিতে পরিণত হতে পারে।
দেশ ও কমিউনিস্ট পার্টিকে ভালোবাসতে বাধ্য করার বিষয়টি চীনে নতুন নয়। ১৯৭৫ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রটির অভ্যুদয়ের পর থেকেই এই বিষয়গুলো শিক্ষা, কোম্পানি কালচার (কর্মক্ষেত্রে একই ভাবাদর্শে পরিচালিত হওয়া) ও জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে।
সি-এর অধীনে চীনা জাতীয়তাবাদের বিস্তার ঘটেছে। গত কয়েক দশকে সি চীনের সবচেয়ে কর্তৃত্বপরায়ণ নেতা, যিনি চীনকে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে যেতে চান। বৈশ্বিকভাবে ক্ষমতা ও প্রাধান্যের শীর্ষে ওঠাই তাঁর উদ্দেশ্য।
পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্কে অব্যাহত টানাপোড়েনের মধ্যে তিনি আক্রমণাত্মক কূটনীতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁদের নীতিকে বলা হচ্ছে ‘উলফ ওয়ারিয়র’ নীতি (চীন, চীনা মানুষ ও তাঁদের প্রত্যাশাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা ও সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতিতে উচ্চ কণ্ঠ হওয়ার যে প্রবণতা পশ্চিমা কূটনীতিকদের আছে বলে চীন সরকার ধারণা করে, থাকে তার জবাব দেওয়া।)
দেশপ্রেমহীনসুলভ আচরণ দমনে চীনে আগেও আইন ছিল। যেমন পতাকার অমর্যাদা করা কিংবা সৈনিকদের অপমান করা। সি-এর নেতৃত্বে চীনে এখন কোনো ভিন্নমত সহ্য করা হয় না। পার্টি ভাষ্যের বাইরে কেউ, এমনকি অনলাইনে কোনো মন্তব্য করলেও সরকারের কোপানলে পড়তে পারেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতিমধ্যে অতি জাতীয়তাবাদের চর্চা লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। চীনকে হেলাফেলা করা হয়েছে, এমন কোনো কিছুর ইঙ্গিত লাইভ স্ট্রিম, কমেডি কিংবা বিদেশি কোনো ব্র্যান্ডে প্রকাশ পেলেই তাদের কঠোর নেতিবাচক প্রক্রিয়া এবং বর্জনের মুখে পড়তে হতে পারে।
নতুন এই আইনের মাধ্যমে সি আসলে সরকারি প্রতিষ্ঠান; মানুষের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে তাঁর রাজনৈতিক দলের উপস্থিতিকে আরও গভীরভাবে প্রোথিত করতে চাইছেন। কিন্তু আইনটি করা হলো চীনে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার কিছুদিন পরই।
২০২২-এর শেষ ভাগে দেশজুড়ে এই সি সরকারের বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তরুণেরা। তা ছাড়া অর্থনীতির অধোগতি এবং তরুণদের বেকারত্বও যেকোনো সময়ের তুলনায় চীনে এখন সর্বোচ্চ। এই সময়ে আরও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেইজিং হয়তো নানামাত্রিক প্রতিবন্ধকতার মুখে সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে জাতীয়তাবাদের চেতনাকে আরও সুদৃঢ় করার চেষ্টা করছে।
বহু বছর পর্যন্ত চীনা কর্তৃপক্ষ তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য শুধু প্রণয়ন করে গেছে। তারা সাধারণ মানুষের ওপর নির্ভর করেছে এই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে। এগুলো অনেকটা সামাজিক চুক্তির মতো। কিন্তু সামনের বছরগুলোয় চীনের জন্য যাত্রা খুব আরামদায়ক হবে না বলে মনে করেন ইউনিভার্সিটি অব নটিংহামের চীনা রাজনীতি বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক জোনাথন সুলিভান।
জোনাথন সুলিভান বলেন, ‘যদি অর্থনীতির অবনমন অব্যাহত থাকে, তাহলে চ্যালেঞ্জে পড়ে যাবে চীন...তারা চাইছে, রাজনৈতিকভাবে সঠিক চিন্তার কোনো পরিসর যেন না থাকে, তা নিশ্চিত এবং পার্টি যেভাবে বলছে, সেটিই সঠিক এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা। এমন একটা ভাষ্য দাঁড় করানো যে যদি আপনি চীনকে ভালোবাসেন, তাহলে আপনার পার্টিকে ভালোবাসতে হবে।’
২০১৯ সালে গণতন্ত্রের দাবিতে হংকংয়ে যখন মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন, তখন তাঁদের ভালো করে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
বেইজিং যে বিষয়টি জনগণের কাছে পরিষ্কার করেছে তা হলো, তারা দেশপ্রেমীদের নতুন একটি প্রজন্ম গড়ে তুলবে, দেশপ্রেমনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন করবে এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এমনভাবে আরোপ করবে, যেন দেশপ্রেমী নন, এমন কেউ সরকারের অংশ হতে না পারেন।
আইনটি এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ৭৫তম বার্ষিকী অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। কর্মকর্তারা দেশপ্রেম উদ্যাপন ও ভিন্নমতকে উচ্ছেদে চাপের মুখে পড়বেন।
নতুন এই আইনে বিজ্ঞানী হোন বা অ্যাথলেট—তাঁকে বিশেষভাবে গড়ে তোলা হবে। তাঁর মধ্যে দেশপ্রেমের অনুভূতি এমনভাবে প্রোথিত করা হবে, যেন তিনি দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনতে পারেন।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে সাংস্কৃতিক সম্পদগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। যেমন জাদুঘর ও ঐতিহ্যবাহী চীনা উৎসব। এর উদ্দেশ্য দেশ ও পরিবারের প্রতি অনুভূতি জাগ্রত করা। সংবাদপত্র, প্রচারমাধ্যম ও সিনেমাতেও দেশপ্রেমনির্ভর শিক্ষার প্রকাশ ঘটাতে হবে।
ধর্মকে চীনা রূপ দেওয়া ও ধর্মের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় কর্মরত ব্যক্তি ও তাঁদের অনুসারীদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলার কথা বলা হচ্ছে।
২০১৬ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমন একটি নির্দেশনা জারি করেছিল, যেন শিক্ষার সব স্তরে এবং শিখনের সব পর্যায়ে দেশপ্রেমনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়। মূলত সেই নির্দেশনাই এখন আইন হলো।
এর বাইরেও চীনা সরকার ‘লার্ন অ্যাবাউট নিউ সোশ্যালিস্ট থট’ নামে স্মার্টফোনে একটি নতুন অ্যাপ চালু করে। এই অ্যাপে শিশুদের যা শেখানো হয় তা হলো, ‘গ্র্যান্ডপা সি আমাদের একটি নতুন পর্বে নিয়ে গেছেন।’ প্রাপ্তবয়স্কদের সি প্রবর্তিত তত্ত্ব নিয়ে কুইজে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা আছে।
ডাউনলোডের সংখ্যার দিক থেকে অ্যাপটি একটি বিরাট সাফল্য। কমিউনিস্ট পার্টির ৯০ মিলিয়ন সদস্য এবং রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলোয় এই অ্যাপের ডাউনলোড বাধ্যতামূলক।
দেশপ্রেমহীনসুলভ আচরণ দমনে চীনে আগেও আইন ছিল। যেমন পতাকার অমর্যাদা করা কিংবা সৈনিকদের অপমান করা। সি-এর নেতৃত্বে চীনে এখন কোনো ভিন্নমত সহ্য করা হয় না। পার্টি ভাষ্যের বাইরে কেউ, এমনকি অনলাইনে কোনো মন্তব্য করলেও সরকারের কোপানলে পড়তে পারেন।
নিউজিল্যান্ডের ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলিংটনের আইনবিষয়ক জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ইয়ে রুইপিং বলেন, বিদ্যমান আইনে যেসব কর্মকাণ্ডে শাস্তি হতো না, নতুন আইনে সেই সব কর্মকাণ্ডকেও আইনের আওতায় আনা হয়েছে। যেমন দেশপ্রেমনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বললেও শাস্তির ব্যবস্থা আছে নতুন আইনে।
নিবন্ধটি সিএনএনে প্রকাশিত। ইংরেজি থেকে অনূদিত
ক্রিস লাও হংকংয়ের আদালত ও আইনবিষয়ক সাংবাদিক
সিমন ম্যাককার্থি সিএনএনের চীনবিষয়ক সাংবাদিক