মতামত

আরও বর্ণবাদী হয়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ

ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেন আরও বর্ণবাদী হয়ে উঠছে
ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো নাগরিকের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে দুটি নীতি অনুসরণ করে। একটি আচরণ নীতি সাদাদের জন্য, একটি কালোদের জন্য। এই দুটি নীতি সহজাতভাবেই পৃথক এবং অসম।

এই দেশে কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে নিরাপত্তাকর্মীদের পীড়নমূলক আচরণ এখন যেন নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠছে। সর্বশেষ ঘটনায় ওহাইও অঙ্গরাজ্যের আকরন শহরে গত জুন মাসে একদল পুলিশ জেল্যান্ড ওয়াকার নামের একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির পিঠ ৪৬টি বুলেট দিয়ে ঝাঁঝরা করে ফেলে। একটি ছোটখাটো ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে পালিয়ে যাওয়ার সময় ওয়াকারকে এভাবে পুলিশ গুলি করেছিল।

এর বাইরে জনসমাগমস্থলে কালোদের ওপর শ্বেতাঙ্গদের নির্বিচার গুলি চালানোর মতো ঘটনাও ঘটছে। গত ৪ জুলাই এ ধরনের সর্বশেষ ঘটনা ঘটেছে শিকাগোর উপকণ্ঠে। সে ঘটনায় পুলিশ সশস্ত্র অবস্থায় অভিযুক্ত খুনি রবার্ট ক্রিমোকে খুঁজে বের করে এবং একটি গুলিও না চালিয়ে তাঁকে হাজতে নিয়ে যায়।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য বরাদ্দ বাড়াতে চান এবং স্কুল ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সুরক্ষায় আরও এক লাখ পুলিশ নিয়োগ করতে চান। কিন্তু পুলিশের বর্ণবাদী মানসিকতার পরিবর্তন না হলে এ উদ্যোগ কাজে আসবে না।

পুলিশের অসহিষ্ণু আচরণকে অনেক সময়ই এড়িয়ে যাওয়া হয়। বিশ্বের বাকি অংশ তো বটেই, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও টেক্সাসের উভালডে এলাকার পুলিশের সাম্প্রতিক কাপুরুষোচিত নিষ্ক্রিয়তার কথা ফলাও করে প্রকাশ পায়নি। নিউ মেক্সিকোর আলবুকার্কে একটি বাড়িতে তল্লাশির সময় পুলিশের ‘ভুলে’ ১৫ বছর বয়সী ব্রেট রোসেনাউর নিহত হওয়ার ঘটনার মতো প্রায়ই পুলিশ ‘ভুল’ করছে। মার্কিন বিচার বিভাগ সম্প্রতি ২০২০ সালে ব্রেওনা টেলরকে হত্যায় যুক্ত থাকার জন্য লুইসভিলের চারজন বর্তমান এবং সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাদের অভিযুক্ত করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশিংয়ের মারাত্মক বর্ণবাদী বাস্তবতা এবং পুলিশের হাতে, বিশেষত কালোদের প্রাণ হারানোর ঘটনার সমর্থনে আমেরিকান নেতৃত্বের দৃঢ় অবস্থান সত্যিই শ্বাসরোধকর হয়ে উঠছে।

সাধারণ সত্য হলো, আইন প্রয়োগকারী মার্কিন সংস্থাগুলো কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের মানবিক আচরণের যোগ্য হিসেবে আমলে নিতে চায় না। ‘শ্বেতাঙ্গদের সেবা এবং সুরক্ষা সবার আগে’—এই নীতি ধরে রেখে তারা সবচেয়ে অমানবিক অপরাধ করে থাকে। এ ছাড়া ‘আইনশৃঙ্খলার’ নামে কাপুরুষোচিত ক্রিয়াকলাপ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে প্রবলভাবেই বিদ্যমান।

১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে আমাকে প্রথম মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আমার মা এবং বাবার ঝগড়ার শব্দে আমার ঘুম ভেঙেছিল। যখন আমার নেশাগ্রস্ত বাবা রান্নাঘরের ছুরি দিয়ে আমার মায়ের দিকে তেড়ে আসেন। মা নিজেকে বাঁচাতে বাবাকে ধাক্কা দিলে বাবা পড়ে গিয়ে আহত হন। তাঁর নিজের হাতে থাকা ছুরিতে তাঁর পেটে জখম হয়। বাবা তখন কাতরাচ্ছিলেন। তাঁর ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছিল।

যেকোনো কারণে যেকোনো কৃষ্ণাঙ্গকে গুলি করে মেরে ফেলার মতো পুলিশ বাহিনী তৈরির ক্ষেত্রে মিশিগানের ফার্মিংটন হিলস একটি উদাহরণ হতে পারে। এই বসন্তে তারা তাদের বেশির ভাগ সাদা পুলিশ অফিসারকে বন্দুকের নিশানা অনুশীলনে কালো মানুষের ছবি ব্যবহার করেছিল।

কয়েক মিনিটের মধ্যে চিকিৎসাকর্মী ও একটা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে দুজন পুলিশ সদস্য আসেন। তাঁদের একজন শ্বেতাঙ্গ এবং একজন কৃষ্ণাঙ্গ। বাবার ক্ষতস্থান পরীক্ষা করার সময় তাঁরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছিলেন। মনে হচ্ছিল তাঁরা খুবই তামাশার কোনো বিষয় পেয়েছেন। আমি সে দৃশ্য কখনো ভুলব না। এটা আমার জন্য একটি রসিকতার বিষয় ছিল না। একজন অফিসার আমার মাথায় এমনভাবে থাপ্পড় দিয়েছিলেন যেন আমি কোনো হারিয়ে যাওয়া বিড়াল বা কুকুর। এই বর্ণবাদী, পিতৃতান্ত্রিক ও নারীবিদ্বেষী পুলিশিংয়ের প্রথম পাঠ আমি পেয়েছি সেদিন।

এর দুই মাস পরে ক্লাসে আমার শিক্ষক মিসেস গ্রিফিন বড় হয়ে কে কী হতে চায়, তা সবার কাছে জানতে চান। তিনি ডাক্তার, আইনজীবী, অগ্নিনির্বাপক, নার্স, পোস্টম্যান, দোকানদার, অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার এবং পুলিশ সদস্যদের ছবি প্রদর্শন করলেন। যখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন আমাদের মধ্যে কে কে পুলিশ অফিসার হতে চাই। প্রায় প্রতিটি ছেলে এবং মেয়ে হাত তুলেছিল।

কিন্তু আমি চিৎকার করে বললাম ‘না! না! না!’ মাথা নাড়ানোর সময় আমাকে রাগান্বিত দেখাচ্ছিল। মিসেস গ্রিফিন জিজ্ঞেস করলেন, আমি ঠিক আছি কি না। আসলে আমি ঠিক ছিলাম না, কিন্তু পুলিশ সদস্যদের সম্পর্কে আমি যে ক্রোধ অনুভব করছিলাম, তা আমি কীভাবে প্রকাশ করব বুঝতে পারছিলাম না।

যেকোনো কারণে যেকোনো কৃষ্ণাঙ্গকে গুলি করে মেরে ফেলার মতো পুলিশ বাহিনী তৈরির ক্ষেত্রে মিশিগানের ফার্মিংটন হিলস একটি উদাহরণ হতে পারে। এই বসন্তে তারা তাদের বেশির ভাগ সাদা পুলিশ অফিসারকে বন্দুকের নিশানা অনুশীলনে কালো মানুষের ছবি ব্যবহার করেছিল।

এটি যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের অন্য জায়গাতেও এ ধরনের চিত্র দেখা যায়। ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেন আরও বর্ণবাদী হয়ে উঠছে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • ডোনাল্ড আর্ল কলিন্স লয়োলা ইউনিভার্সিটি মেরিল্যান্ডের আফ্রিকান আমেরিকান ইতিহাসের ভিজিটিং প্রফেসর