
উজবেকিস্তানে জন্মানো রুশভাষী ইসরায়েলি লেখক দিনা রুবিনা রাশিয়া সরকারের বিরোধী গ্রুপগুলোর পরিচালনা করা চ্যানেল রেইন টিভিকে গত জুলাইয়ে একটি সাক্ষাৎকার দেন।
ওই সাক্ষাৎকার রুশভাষী বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
দেড় ঘণ্টার অনুষ্ঠানে রুবিনা বলেন, গাজায় কোনো ‘শান্তিপ্রিয় বাসিন্দা’ নেই। তিনি বলেন, ‘গাজাকে সাফ করে পার্কিং লটে পরিণত করার’ অধিকার ইসরায়েলের আছে’। তিনি আরও বলেন, ফিলিস্তিনিদের ‘হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডে গলিয়ে ফেলতে হবে।’
রাশিয়া থেকে পালিয়ে নির্বাসিত জীবন বেছে নেওয়া সাংবাদিক ও অনুষ্ঠান প্রযোজক মিখাইল কোজিরেভ রুবিনার সাক্ষাৎকারটি নেন।
কোজিরেভ রুবিনার বক্তব্যের অংশগুলো বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং এটিকে ‘সাক্ষাৎকারের সবচেয়ে জটিল অংশ’ বলে উল্লেখ করেন।
তিনি যদিও রুবিনার ‘গাজায় কোনো শান্তিপ্রিয় বাসিন্দা নেই’ দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন এবং এটিকে তিনি ইউক্রেনের যুদ্ধে রুশদের সম্মিলিত দায়ের সঙ্গে তুলনাও করেছিলেন; কিন্তু তিনি রুবিনার দাবিকে একেবারে প্রত্যাখ্যান করেননি।
সাক্ষাৎকারের পুরো সময়জুড়ে কোজিরেভ স্পষ্টভাবে ইসরায়েলের পক্ষেই ছিলেন।
যদিও অনেক রুশভাষী ব্যক্তি রুবিনার বক্তব্যে নিন্দা জানিয়েছেন। বিশেষ করে মধ্য এশিয়ায় তাঁর বইয়ের আলোচনা সভা বাতিল করা হয়েছে। তবে রাশিয়ার রাজনৈতিক নির্বাসিতদের মধ্যে অনেকেই তাঁকে সমর্থন করেছেন।
এটি নতুন কিছু না। রাশিয়ার উদারবাদী বিরোধীরা (যাঁরা এখন প্রধানত নির্বাসনে বসে পুতিনবিরোধী কার্যক্রম চালান) সাধারণভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন করেন।
রাশিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদকে তাঁরা যে সমর্থন দিয়ে এসেছেন এবং শ্বেতাঙ্গ পশ্চিমা বিশ্বের শ্রেষ্ঠত্বকে তাঁরা যে স্বীকৃতি দিয়ে যাচ্ছেন, তারই স্বাভাবিক ফল হলো তাঁদের এই ফিলিস্তিনবিরোধী অবস্থান।
রাশিয়ার বিরোধীদের তীব্র ফিলিস্তিনবিরোধিতার উদাহরণ প্রচুর আছে। নির্বাসিত অবস্থায় থাকা বিশিষ্ট কলাম লেখক ইউলিয়া লাতিনিনা ফিলিস্তিনিদের ‘বর্বরদের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনিরা ‘বিকশিত সভ্যতাকে ধ্বংস করছে’।
গাজার গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত শিক্ষার্থীদের তিনি ‘অকর্মা ও মূর্খ’ বলেছেন।
অধুনালুপ্ত ‘গণতন্ত্রপন্থী’ সংগঠন ওপেন রাশিয়ার সাবেক পরিচালক আন্দ্রে পিভোভারভ গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে ‘একদম ঠিক আছে’ বলে রায় দিয়েছেন।
তিনি রাশিয়ায় কারাগারে ছিলেন এবং গত বছর পশ্চিমের সঙ্গে বন্দিবিনিময়ের সুবাদে তিনি মুক্তি পান।
দিমিত্রি গুদকভ একসময় রাশিয়ায় বিরোধী রাজনীতিক ছিলেন এবং বর্তমানে বুলগেরিয়ায় নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার কাছে ইসরায়েল হলো সভ্যতার প্রতীক। এর বিরুদ্ধে যা কিছু চলছে, সেটাই বর্বরতা।’
সেনিয়া লারিনা একজন প্রখ্যাত রুশ সাংবাদিক ও রেডিও হোস্ট। তিনি বর্তমানে নির্বাসনে আছেন। তিনি তাঁর শোতে বহুবার ইসরায়েলি রুশভাষী বুদ্ধিজীবীদের অতিথি হিসেবে এনেছেন।
একবার তিনি এক ইসরায়েলি শিক্ষকের সঙ্গে আলাপের শিরোনাম দিয়েছিলেন, ‘ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া শুধু অ্যান্টিসেমিটিজম নয়, এটি বোকামিও।’
রাশিয়ার এ ধরনের অনেক উদারবাদী নির্বাসিত ব্যক্তিরা গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যাকে খোলাখুলি সমর্থন করেছেন।
এ ছাড়া ইসরায়েলে বসবাসকারী বা ইসরায়েলে নিয়মিত ভ্রমণ করা রুশ পপ তারকা, কৌতুকশিল্পী, সংগীতশিল্পী ও টিভি ব্যক্তিত্বরাও ইসরায়েলের ভাষ্য প্রচার করে চলেছেন।
রাশিয়ার জনপ্রিয় বিরোধী মিডিয়া ও নোবেলজয়ী নিউজলেটার ‘নোভায়া গাজেতা’, ‘মেডুজা’ এবং ‘টিভি রেইন’ অসংখ্যবার ইসরায়েলকে সমর্থন করে খবর প্রকাশ করেছে।
কিন্তু বিপরীত মত সেখানে খুব কম প্রকাশ করা হয়। ফলে বর্ণবাদী ও ফিলিস্তিনবিরোধী বক্তব্য রুশভাষী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অন্যান্য প্রচারমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
রাশিয়ার উদারবাদীদের (যারা রাশিয়ার বিরোধী শিবিরের বড় অংশ) ইসরায়েলপন্থী অবস্থানের কারণ খুঁজতে গেলে আমাদের ২০ শতকের গোড়ার দিকে ফিরে যেতে হবে।
ইহুদি জনগণ রুশ সাম্রাজ্যের জার শাসনের সময় তীব্র বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। শুরুতে বলশেভিকরা এই নিপীড়নের নিন্দা করেছিল।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে জোসেফ স্তালিনের আমলে কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থা নিজেই ইহুদিবিরোধী মনোভাব গ্রহণ করে। ইহুদিদের বিরুদ্ধে বৈষম্য চলতে থাকে। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৩ সালে তা চরমে পৌঁছে।
ওই সময়ে স্তালিন একদল ইহুদি চিকিৎসকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে তাঁদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন চালান।
পরে কমিউনিস্ট পার্টি এই অভিযোগ প্রত্যাহার করলেও ইহুদিদের জোর করে একীভূতকরণ ও কাঠামোগত বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হয়। বহু বছর ধরে তা চলতে থাকে।
এ পরিস্থিতিতে ১৯৮০ সালের দিকে যেসব রুশ উদারপন্থী বিরোধী গোষ্ঠী তৈরি হয়, সেই গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলকে দেখত এমন একটি দেশ হিসেবে, যা নিপীড়িত ইহুদিদের রক্ষা করে এবং যা পশ্চিমা বিশ্বের মতোই গণতান্ত্রিক ও উদার।
এই সময়টাতে ইসরায়েলে এক বড় অভিবাসন ঢেউ তৈরি হয়। সোভিয়েতবিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে ইসরায়েলকে নিরাপদ আশ্রয় মনে হতো।
এর ফলে সে সময়ের ভিন্নমতাবলম্বী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইসরায়েল ও জায়নবাদের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন জন্ম নেয়। এটি পরবর্তী প্রজন্মের উদারপন্থী বিরোধীরাও উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে।
২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর এই ইসরায়েলপন্থী ঝোঁক আরও বেশি বেড়ে যায়। যুদ্ধের পরে লক্ষাধিক সরকারবিরোধী রুশ নাগরিক দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। ইসরায়েল ছিল তাঁদের প্রধান গন্তব্যের একটি।
ধারণা করা হয়, শুধু ২০২২ সালেই প্রায় ৭০ হাজার রুশ নাগরিক সেখানে চলে যায়, যা কিনা ২০২১ সালের ২৭ হাজার জনের তুলনায় অনেক বেশি। বর্তমানে ইসরায়েলে রুশভাষীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৩ লাখের মতো।
এখানে মূল বিরোধ বা বৈপরীত্য হলো, রাশিয়ার উদারপন্থীবিরোধীরা দাবি করেন, তাঁরাই ভ্লাদিমির পুতিনের স্বৈরশাসনের গণতান্ত্রিক ও নৈতিক বিকল্প শক্তি। কিন্তু একই সময়ে তারা প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী মত প্রকাশ করেন।
তাঁরা রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ এবং রুশ বাহিনীর যুদ্ধাপরাধের তীব্র নিন্দা করেন, কিন্তু ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি তাঁরা স্বীকারই করেন না।
পশ্চিমা বিশ্বে রাশিয়ার এই উদারপন্থীবিরোধীদের ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের’ দাবিগুলো খুব কমই খতিয়ে দেখা হয়। কিন্তু দেখা উচিত; কারণ শুধু ফিলিস্তিন প্রসঙ্গেই নয়, তাদের বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আরও অনেক জায়গাতেই দেখা যায়।
অতীতে উদারপন্থীবিরোধী নেতারা বহুবার অভিবাসী, মুসলিম এবং অন্য বর্ণগত সংখ্যালঘুদের নিয়ে ক্রেমলিন স্টাইলের বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে প্রয়াত বিরোধী নেতা আলেক্সি নাভালনির কথা বলা যেতে পারে।
নাভালনিকে একসময় রাশিয়ার ‘গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের আশা’ বলা হতো। তিনি ২০০৭ সালে ‘পোকামাকড়ের বিরুদ্ধে কীভাবে লড়া যায়’ শিরোনামের একটি ভিডিওতে ককেশাস অঞ্চল থেকে আসা মুসলিম অভিবাসীদের ‘তেলাপোকা’ ও ‘মাছি’ বলে বর্ণনা করেছিলেন।
২০২১ সালে এই বক্তব্যসহ অন্যান্য কারণে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাঁর ‘প্রিজনার অব কনসাস’ মর্যাদা প্রত্যাহার করে নেয়। যদিও পরে তারা দুঃখপ্রকাশ করে এবং নাভালনি কারাগারে মারা যাওয়া পর্যন্ত তাঁর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।
এপ্রিল মাসে ফ্রি রাশিয়া ফাউন্ডেশন–এর সহসভাপতি ভ্লাদিমির কারা-মুরজা দাবি করেন, রাশিয়ার সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর সেনারা নাকি ইউক্রেনীয়দের হত্যা করতে বেশি ‘সহজ’ মনে করে।
অনেকেই এটিকে যুদ্ধাপরাধের দায় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হিসেবে দেখেন। এ মন্তব্যের পর ইন্ডিজেনাস অব রাশিয়া ফাউন্ডেশন এক খোলাচিঠিতে এর নিন্দা জানায়।
নাভালনি এবং কারা-মুরজার এই মনোভাব আসলে কোনো ব্যতিক্রম কিছু নয়। রাশিয়ার উদারপন্থীবিরোধীরা প্রায় কখনোই রাশিয়ার বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের (বিশেষত মুসলিমদের) বিরুদ্ধে চলা বৈষম্য বা বর্ণবাদী সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলেন না।
যদি কালই পুতিন সরকারের পতন হয় এবং এই বিরোধীরা ক্ষমতায় আসে, তবু রাশিয়ার কাঠামোগত বর্ণবাদ দূর করার মতো বড় কোনো সংস্কার তারা করবে—এমন লক্ষণ খুবই কম। রাশিয়ার প্রান্তিক অঞ্চলগুলোর স্বায়ত্তশাসনের দাবি, অ-রুশ জাতিগোষ্ঠীর সমস্যা, আদিবাসী জনগোষ্ঠী কিংবা দেশজুড়ে থাকা অভিবাসীদের উদ্বেগ—এসব তাদের তেমন ভাবায় না।
গত বছর বাশকিরস্তান অঞ্চলে মানবাধিকারকর্মী রিফাত দাউতোভ কারাগারে কথিত নির্যাতনে মারা যান।
নির্বাসিত বিরোধী শিবিরের মধ্যে তখন প্রায় কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখা যায়নি। অথচ কয়েক সপ্তাহ পর যখন নাভালনি কারাগারে সন্দেহভাজন বিষপ্রয়োগে মারা গেলেন, তখন মাসের পর মাস শোক ও শ্রদ্ধায় সোচ্চার ছিল এই একই বিরোধী মহল।
এটি রুশ উদারনীতির এক চিরাচরিত ধরণকে প্রকাশ করে। সেই ধরনটি হলো, একদিকে তাঁরা ক্রেমলিনকে নির্যাতনকারী হিসেবে অভিযোগ করে, অথচ একই ধরনের পক্ষপাতদুষ্ট ও সংকীর্ণ চিন্তা নিজেরাই ধারণ করে।
বাস্তবে যদি কালই পুতিন সরকারের পতন হয় এবং এই বিরোধীরা ক্ষমতায় আসে, তবু রাশিয়ার কাঠামোগত বর্ণবাদ দূর করার মতো বড় কোনো সংস্কার তারা করবে—এমন লক্ষণ খুবই কম।
রাশিয়ার প্রান্তিক অঞ্চলগুলোর স্বায়ত্তশাসনের দাবি, অ-রুশ জাতিগোষ্ঠীর সমস্যা, আদিবাসী জনগোষ্ঠী কিংবা দেশজুড়ে থাকা অভিবাসীদের উদ্বেগ—এসব তাদের তেমন ভাবায় না।
এ জন্যই রুশ উদারপন্থীরা রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের সম্পূর্ণ দায় পুতিনের ওপর চাপাতে চান। এই যুদ্ধকে রাশিয়া বা সোভিয়েত আমলের দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্যবাদী নীতি ও ‘অধস্তন জনগোষ্ঠীকে দমিয়ে রাখা’র ইতিহাসের ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখা হোক, এটি তাঁরা চান না।
ইউক্রেন প্রসঙ্গে রুশ উদারপন্থীরা যুদ্ধের বিরোধিতা দেখিয়ে নিজেদের আড়াল করতে পারেন। কিন্তু ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে তাঁরা আর নিজেদের আসল চেহারা ঢেকে রাখতে পারেন না।
আজ ফিলিস্তিনিদের যে অবমাননা, উচ্ছেদ ও অস্তিত্ব অস্বীকারের অভিজ্ঞতা, তা রাশিয়ার বহু জাতিগত সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠী বহুদিন ধরে ভোগ করে আসছে।
অথচ রুশ উদারপন্থী বিরোধীরা এই বাস্তবতার প্রতি অন্ধ থেকে যাচ্ছেন এবং নিজেদেরই একমাত্র ‘স্বৈরশাসনের শিকার’ হিসেবে তুলে ধরছেন।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
সেলবি দুরদিয়াভা একজন রুশ গবেষক ও লেখক।