পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের দাবি

জনগণকে জিম্মি করা যাবে না

দেশের প্রশাসনিক সংস্কৃতির একটি স্থায়ী বৈশিষ্ট্য হলো দীর্ঘসূত্রতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ অধিকাংশ সময়েই পরিস্থিতি চূড়ান্ত সংকটের রূপ না নেওয়া পর্যন্ত নাগরিকদের সমস্যা ও প্রত্যাশার প্রতি নির্লিপ্ত থেকে যায়। পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের চলমান ছয় দফা দাবিকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রায় সাত মাস ধরে দাবি তুলে ধরার পরও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর নিস্পৃহতা এবং সময়োপযোগী সংলাপের অভাব ছাত্রদের বাধ্য করেছে রাজপথে নামতে। 

কিন্তু আন্দোলনের ধরন নিয়েও প্রশ্ন তোলা জরুরি। বিশেষ করে গত বুধবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা মোড়ে শিক্ষার্থীদের অবরোধ কর্মসূচির ফলে যে অভাবনীয় জনদুর্ভোগ তৈরি হয়েছে, তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। ঢাকা নগরী এমনিতেই প্রতিদিন তীব্র যানজটে জর্জরিত। তার ওপর নগরীর কেন্দ্রস্থলে সড়ক অবরোধ করলে স্বাভাবিক নাগরিক জীবন কার্যত থমকে যায়। ওই দিন ছিল এসএসসি পরীক্ষা, হাসপাতালে রোগী নেওয়ার তাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও চাকরির পরীক্ষার মতো জরুরি কর্মকাণ্ড—সবই স্থবির হয়ে পড়ে। অনেকেই গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেননি, কেউ কেউ ফিরে যাওয়ার পথও খুঁজে পাননি। 

এই ধরনের পরিস্থিতি শুধু রাজধানীতে সীমাবদ্ধ ছিল না। দেশের অন্যান্য নগরেও শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি পালন করায় সড়ক যোগাযোগ বিঘ্নিত হয়েছে। এমনকি বৃহস্পতিবার রেলপথ অবরোধ কর্মসূচিও ঘোষিত হয়েছিল, যা পরে শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরারের হস্তক্ষেপে স্থগিত করা হয়। কিন্তু বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের সঙ্গে অনুষ্ঠিত আলোচনায় কোনো সমাধানে পৌঁছানো যায়নি। শিক্ষার্থীরা প্রকাশ্যে জানিয়েছেন, তাঁরা সন্তুষ্ট নন এবং আবারও কর্মসূচিতে ফিরবেন। 

এখানেই সরকারের ব্যর্থতা প্রকটভাবে ধরা পড়ে। দাবির যৌক্তিকতা থাকলে সরকারকে তা মেনে নিয়ে বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে। আর দাবি বাস্তবায়ন করা কঠিন হলে, সময়সাপেক্ষ হলে বা অযৌক্তিক হলে সেটাও স্পষ্ট করে একটি সমঝোতায় আসা সরকারের দায়িত্ব। সংকটকে ঝুলিয়ে রাখা বা দীর্ঘায়িত করা আত্মঘাতী। পাশাপাশি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতিও কিছু প্রত্যাশা থাকে। জনদুর্ভোগ সৃষ্টির পথ বেছে নেওয়া যেমন তাদের ন্যায্য দাবির প্রতি জনসম্পৃক্ততা কমিয়ে দেয়, তেমনি গণমানুষের সহানুভূতিও হারিয়ে ফেলে। 

সরকার ও নাগরিক—উভয় পক্ষের কাছ থেকেই সহিষ্ণুতা, দূরদৃষ্টি ও দায়িত্ববোধ প্রত্যাশা করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের বুঝতে হবে জনজীবনকে অচল করে দেওয়া কখনোই দাবি আদায়ের পথ হতে পারে না। বরং নতুন প্রজন্মের সচেতন নাগরিক হিসেবে তাঁদের উচিত বিকল্প, সৃজনশীল ও কার্যকর পন্থায় তাদের দাবিগুলো উপস্থাপন করা। সংবাদ সম্মেলন করা, শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাঙ্গণ কিংবা নির্ধারিত জায়গায় অবস্থান কর্মসূচি কিংবা প্রতীকী অনশন—এসব মাধ্যমেও দাবির পক্ষে জনমত তৈরি করা সম্ভব। 

অন্যদিকে সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে সংকট চরমে ওঠার আগেই আগ্রহ ও আন্তরিকতা দেখানো। ছাত্রদের দাবিগুলো কতটা বাস্তবসম্মত, কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য—তা নিরপেক্ষভাবে যাচাই করে একটি সুসমন্বিত পরিকল্পনা নেওয়া। মূলত কারিগরি শিক্ষা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ও যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি, যেখানে ছাত্রদের ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান, ডিপ্লোমা ও ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রির স্বীকৃতি, শিক্ষাক্রমের মানোন্নয়ন ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকবে। 

সরকারের সঙ্গে ছাত্রসমাজের সম্পর্ক যেন প্রতিনিয়ত সংঘর্ষে রূপ না নেয়—এটি সবার কাম্য। সরকারকে হতে হবে গণমুখী আর নাগরিকদের হতে হবে দায়িত্ববান। পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি অবিলম্বে বিবেচনায় নিয়ে, একটি সুসংহত ও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে অগ্রসর হওয়া সময়ের দাবি। আর শিক্ষার্থীদের প্রতিও আহ্বান—আন্দোলনের হাতিয়ার হোক সংযম ও সংবেদনশীলতা; জনদুর্ভোগ নয়।