প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ

ভয়হীন পরিবেশ সৃষ্টিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিন

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দেশের ভোট রক্ষা করে দেশ রক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ওপর নির্ভর করছে দেশের সবার ভবিষ্যৎ। বিজয় দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণ বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় দেশের নাগরিক ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সুস্পষ্ট বার্তা বলেই আমরা মনে করি।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এটি জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার প্রথম ভাষণ। খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর নির্বাচনের বিষয়টি তাঁর বক্তব্যে গুরুত্ব পেয়েছে। ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে অন্তর্বর্তী সরকার সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। নির্বাচন সামনে রেখে মাঠ প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনে রদবদলের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, দেশের প্রত্যেক ভোটার যেন নিরাপদ পরিবেশে ও ভয়মুক্ত মনে ভোট দিতে পারেন—সেটাই সরকারের একমাত্র লক্ষ্য।

তবে নিরাপদ ও ভয়মুক্ত নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে দৃশ্যমান উন্নতি প্রয়োজন, সেখানে এখনো অনেকটা ঘাটতি রয়ে গেছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিনই রাজধানীর পুরানা পল্টনে সন্ত্রাসীদের গুলিতে জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে উঠে আসা তরুণ রাজনীতিবিদ ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদির গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনায় নাগরিক ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা আরও বেড়েছে।  

প্রার্থী ও নাগরিকদের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে যে উদ্বেগ ও শঙ্কা তৈরি হয়েছে, সেটা প্রশমনের দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনের। ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় কয়েকজন আটক হলেও মূল সন্দেহভাজন ও তার সহযোগী এখনো গ্রেপ্তার না হওয়াটা উদ্বেগজনক। তদন্ত–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাঁরা দুজন সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে পারেন। এটা বড় ধরনের গোয়েন্দা ব্যর্থতা বলেই আমরা মনে করি।

প্রধান উপদেষ্টা ওসমান হাদির ওপর এই হামলাকে দেশের অস্তিত্ব ও গণতান্ত্রিক পথচলার ওপর আঘাত হিসেবে বর্ণনা করেছেন। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শক্তির দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, ভয় দেখিয়ে, সন্ত্রাস ঘটিয়ে এই দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা থামানো যাবে না। যারা অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান অধ্যাপক ইউনূস। বাংলাদেশ একটি রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। চব্বিশের অভ্যুত্থান এ দেশের মানুষের সামনে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন পেরিয়ে গণতান্ত্রিক পথে যাত্রার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে জাতির সামনে এ সুযোগ তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই শহীদদের আত্মত্যাগ ও জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকাটা স্বাভাবিক, কিন্তু কোনোভাবেই সেটা যেন বিরোধ ও সহিংসতায় রূপ না নেয়, সেদিকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের আগে প্রতিটি দিনকে উৎসবমুখর করে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। দেশবাসীও একটি উৎসবমুখর নির্বাচনী পরিবেশে ভোট দেওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। তফসিল ঘোষণার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে। তবে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং শীর্ষ ও তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে এখনো সমন্বিত ও জোরালো কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও প্রার্থীদের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হলে সেটা নিরাপত্তা নিয়ে নতুন উদ্বেগ তৈরি করবে বলেই শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।  

আমরা আশা করি, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পর অন্তর্বর্তী সরকার, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীগুলো একটি নিরাপদ ও ভয়হীন নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে।