দেশব্যাপী যখন টাইফয়েডের টিকাদান কর্মসূচি শেষ হলো, তখন গাজীপুরের ভাওয়ালগড় ইউনিয়নের হোতাপাড়া গ্রামের বেদে সম্প্রদায়ের যাযাবর পরিবারগুলো এ সম্পর্কে কিছুই জানতো না। তাঁবুতে বসবাসরত এই জনগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য টিকা ছিল নাগালের বাইরে। এটি কেবল একটি স্বাস্থ্য কর্মসূচির ব্যর্থতা নয়; বরং সমাজের প্রান্তিকতম অংশ রাষ্ট্রীয় সুবিধা থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন, সেটিও প্রতীয়মান হয়। তবে শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের টিকাদানের ব্যবস্থা করেছে বলে জানা গেছে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানায়, হোতাপাড়ার এই অভিভাবকেরা জানতেন না টাইফয়েড টিকা কী বা কোথায় এটি দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের শিশুরা স্কুলে যায় না, তাঁরা ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করেন এবং সরকারি প্রচারণার কোনো মাধ্যমই তাঁদের কাছে পৌঁছায় না। এ কারণে তাঁদের সন্তানেরা সমাজের অন্য শিশুদের মতো স্বাস্থ্যগত সুরক্ষা পাওয়ার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বেদে সম্প্রদায় মূলত নদীভাঙন বা অন্য প্রাকৃতিক কারণে বাস্তুচ্যুত হয়ে যুগ যুগ ধরে যাযাবর জীবন যাপন করছে। সিভিল সার্জন মো. মামুনুর রহমান স্বীকার করেছেন যে তাঁদের প্রচারণা ছিল মূলত স্কুলভিত্তিক। এখানেই সমস্যাটির মূল নিহিত। যে শিশুরা স্কুলে যায় না, যারা স্থায়ী ঠিকানা থেকে বিচ্ছিন্ন বা যারা কোনো আনুষ্ঠানিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত নয়—তারা কি স্বাস্থ্যসেবার অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে? সিভিল সার্জনের বক্তব্য, তাঁরা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। এই সম্পাদকীয় লেখার সময় জানা গেছে, আগামী মাস থেকে এসব বেদে শিশুকে টিকার আওতায় আনা হবে।
এ রকম কেবল টাইফয়েড টিকা নয়, অন্যান্য নিয়মিত টিকাদান, শিক্ষা এবং জরুরি স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও বেদে সম্প্রদায়ের বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরে। জেলা–উপজেলার প্রশাসনের মাধ্যমে এসব প্রান্তিক ও বাস্তুচ্যুত গোষ্ঠীকে পরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজন তাদের খুঁজে বের করে, তাদের যাযাবর জীবনযাত্রার সঙ্গে মানানসই একটি বিশেষ টিকাদান কর্মসূচি তৈরি করা যেতে পারে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সমাজকর্মী, এনজিও বা স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে তাদের কাছে সরাসরি পৌঁছানো যেতে পারে। শুধু স্কুল বা স্থায়ী ক্লিনিকভিত্তিক প্রচারণার ওপর নির্ভর করলে, বেদে বা অন্যান্য ভাসমান জনগোষ্ঠীর শিশুরা বারবার স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে।
হোতাপাড়ার বেদে শিশুদের মতো সমাজের প্রান্তিকতম অংশ যখন মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়, তখন দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য সূচক বা উন্নয়নের দাবি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। দেরিতে হলেও বেদে শিশুদের টিকাদানের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।