বান্দরবানের ইটভাটা

প্রাণ ও পরিবেশের বিপর্যয় ঠেকান

সুন্দরবন বাদে দেশের মোট বনভূমির বড় অংশই পার্বত্য জেলাগুলোতে অবস্থিত। তবে পাহাড়ধস, বন উজাড় ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের তোয়াক্কা না করে নির্মিত স্থাপনার কারণে সেখানকার বনভূমি রয়েছে হুমকির মুখে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইটভাটার জন্য পাহাড় থেকে লাগামহীন মাটি উত্তোলন। 

প্রথম আলোর খবরে এসেছে, বান্দরবানে অবৈধ ইটভাটার বিস্তার জেলাটিকে ঠেলে দিচ্ছে পরিবেশগত বিপর্যয়ের দিকে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান, আদালতের নিষেধাজ্ঞা কিংবা প্রশাসনের নির্দেশ—কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করছেন না ইটভাটার মালিকেরা। প্রশাসনের তালিকাভুক্ত ৭০টি ইটভাটার একটিও বৈধ নয়, অথচ বর্তমানে ৪৩টি ভাটায় প্রকাশ্যেই ইট পোড়ানো হচ্ছে।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক চিত্র দেখা যাচ্ছে লামা উপজেলায়। সেখানে একটি ইউনিয়নেই ২৬টি ইটভাটা, যেখানে সেনাবাহিনী, র‍্যাব ও পুলিশের উপস্থিতিতেও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ভাটায় অভিযান করতে পারেননি। এতে ফুটে উঠেছে সেখানে প্রশাসনিক দুর্বলতা কতটা গভীর। অনেক সময় অভিযান চালিয়ে ভাটা ভেঙে দেওয়া হলেও এক সপ্তাহের মধ্যেই সেগুলো আবার চালু হচ্ছে। এ যেন ‘ইঁদুর-বিড়াল খেলা’, যে খেলায় শেষ পর্যন্ত হারছে পরিবেশ ও সাধারণ মানুষ।

অবৈধ ইটভাটাগুলো পাহাড় কেটে, কৃষিজমি খনন করে মাটি সংগ্রহ করছে এবং জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে বনাঞ্চলের কাঠ। এতে একদিকে পাহাড়ধসের ঝুঁকি বাড়ছে, অন্যদিকে বন উজাড় হয়ে নষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। পানির উৎস শুকিয়ে যাওয়ার অভিযোগও উঠেছে, যা পাহাড়ি এলাকায় দীর্ঘমেয়াদি মানবিক সংকটের ইঙ্গিত দেয়। 

স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির দিকটি আরও ভয়াবহ। ইটভাটার ধোঁয়া, তাপ ও শব্দদূষণে শিশু, নারী ও বয়স্করা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শ্বাসকষ্ট, চোখ ও ত্বকের রোগ, দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসজনিত সমস্যার আশঙ্কা বাড়ছে। বিদ্যালয়ের পাশেই ইটভাটা থাকায় শিশুরা প্রতিনিয়ত বিষাক্ত ধোঁয়ার মধ্যে বড় হচ্ছে, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য মারাত্মক হুমকি। এই অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে জনস্বাস্থ্য খাতে এর বড় মূল্য দিতে হবে। 

ইটভাটার মালিকেরা বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের যুক্তি তুলে ধরছেন। কিন্তু অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কর্মসংস্থান টেকসই হতে পারে না। আইন ভেঙে, পাহাড় ও বন ধ্বংস করে উন্নয়ন সম্ভব নয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের জনবল ও অর্থসংকট বাস্তবতা হলেও, এটি দায়িত্ব এড়ানোর অজুহাত হতে পারে না। বন বিভাগ, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত, ধারাবাহিক ও কঠোর অভিযানের বিকল্প নেই। 

পাহাড় ও বন শুধু একটি জেলার সম্পদ নয়, এটি দেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য। আমরা আশা করি, এই ঐতিহ্য রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেবে সরকার।