সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

বিশেষ সাক্ষাৎকার: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

দেশে আরেকটি সাংস্কৃতিক জাগরণ প্রয়োজন

লেখক, সমাজচিন্তক ও শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ৯০তম জন্মদিন ২৩ জুন।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ইমেরিটাস অধ্যাপক ২৩ বছর ধরে নতুন দিগন্ত–এর সম্পাদনা করছেন। জন্মদিন উপলক্ষে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তাঁর জীবন, কর্ম, রাজনীতি ও সমাজ অন্বেষা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও মনজুরুল ইসলাম

প্রশ্ন

৯০তম জন্মদিন উপলক্ষে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আপনাকে অভিনন্দন। একই সঙ্গে আপনার অনুভূতি জানতে চাই।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ধন্যবাদ আপনাকে এবং প্রথম আলোর সব আপনজনকে। জন্মদিনে আমার অনুভূতি দুটি পরস্পরবিরোধী উপলব্ধিজাত। প্রথম উপলব্ধি হলো বয়সের ভার বলে একটা জিনিস যে আছে, সেটা তো বাস্তব সত্য। সেই বোঝা বাড়ছে। দ্বিতীয় উপলব্ধি একেবারে ভিন্ন রকমের; সেটা হলো আমার বাইরের দৃষ্টিশক্তি যত দুর্বল হচ্ছে, ভেতরের দৃষ্টিশক্তি তত স্বচ্ছ হয়ে উঠছে। জগৎ ও জগতের ভালো-মন্দকে আমি আগের চেয়ে কিছুটা স্বচ্ছভাবে দেখতে ও বুঝতে পারছি।

প্রশ্ন

‘কেন লিখি’ প্রবন্ধে আপনি বলেছেন, সমাজ পরিবর্তন ও বৃত্ত ভাঙার জন্যই  লেখেন। ছয় দশকের বেশি সময় ধরে লেখালেখি করছেন। বৃত্ত কতটা ভাঙল?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: না, বৃত্ত তো ভাঙেনি; বরং আরও সংকীর্ণ ও নিপীড়ক হয়ে উঠেছে। বৃত্ত তো লেখার আঘাতে ভাঙবে না। ভাঙবে রাজনৈতিক আন্দোলনে, যে আন্দোলনের জন্য সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি দরকার হবে। লেখার মধ্য দিয়ে আমি বৃত্ত ভাঙার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চেয়েছি। আমার প্রথম বই বের হয় ১৯৬৫ সালে। নাম ছিল অন্বেষণ; ভাবটা ছিল এই রকমের যে পথ খুঁজছি। ১৯৭১ সালের পরে প্রথম দিকেই আমার যে বইগুলো বের হয়েছে, সেগুলোর নাম বদলে গেছে। যেমন নিরাশ্রয় গৃহী এবংবৃত্তের ভাঙা গড়া, নিরাশ্রয় গৃহীতেভাবটা ছিল এই রকমের যে দেশ স্বাধীন হয়েছে, তবে আমাদের আশ্রয় প্রয়োজন; যেমন বস্তুগত, তেমনি মতাদর্শিক। বৃত্তের ভাঙা গড়াতে বলতে চেয়েছি পুরোনো বৃত্ত ভেঙে নতুন বৃত্তে যাওয়াতেও কিন্তু মুক্তি নেই; মুক্তির জন্য বৃত্তে আবদ্ধ থাকার অভ্যাসটাই কাটানো চাই। কৌতূহলের বিষয় যে তখন আমি দ্বিতীয় ভুবন নামেও একটি বই লিখেছি।

‘দ্বিতীয় ভুবন’ বলতে বোঝানো হয়েছে সাহিত্যের জগৎকে। সাহিত্যও একটি ভুবন বটে, তবে সেটা যে আশ্রয়, এমন দাবি করা হয়নি। আমার পরবর্তী সব লেখাতেই কোনো না কোনোভাবে সমাজ পরিবর্তনের আবশ্যকতার বিষয়টি এসেছে। একেবারে শুরুতে আমার ধারণা ছিল, লিখি আত্মপ্রকাশের জন্য। পরে সে ধারণা যে বাতিল হয়ে গেছে, তা নয়; তবে এ সত্য ক্রমাগত স্পষ্ট হয়েছে, আত্মপ্রকাশের জন্য যথার্থ আত্মবিকাশ দরকার এবং তার জন্য অন্যদের সঙ্গে যুক্ত হওয়া চাই। যুক্ত হওয়ার পথে বাধাটা হচ্ছে বৈষম্য ও বিচ্ছিন্নতার প্রাচীর; ভিন্ন নামে বৃত্ত। বৃত্ত ভাঙেনি বলে যে হাল ছেড়ে দিতে হবে, অমন হতাশা দেখা দেয়নি।

প্রশ্ন

চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে আশা জাগিয়েছিল। স্বৈরাচারী সরকার বিদায় নিয়েছে। ১০ মাস পর সেই আশা ও সম্ভাবনা কতটা পূরণ হয়েছে বা দেশ আদৌ সেদিকে যাচ্ছে কি?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: না, জনগণের আশা পূরণ হয়নি। ভয়াবহ চরিত্রের একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটেছে। সেটা কম কথা নয়। পতনের দরকার ছিল এবং অভ্যুত্থান ভিন্ন অন্য কোনো পথে সেটা ঘটা সম্ভব ছিল না। অভ্যুত্থান ঘটেছে, কিন্তু সামাজিক বিপ্লব তো ঘটেনি। সামাজিক বিপ্লব না ঘটলে বিদ্যমান বৈষম্য দূর হবে না। গত শতাব্দীর নব্বই সালে  একটি গণ–অভ্যুত্থান ঘটেছিল। তার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন শহীদ নূর হোসেন। নূর হোসেন তাঁর বুকে–পিঠে লিখেছিলেন, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। কিন্তু গণতন্ত্র তো মুক্তি পায়নি। এমনকি সংসদীয় গণতন্ত্র, যাকে যথার্থ গণতন্ত্র বলা যাবে না, সেটাও আসেনি। উল্টো দেখা গেল, স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতার ভাগীদার হয়ে গেছেন। অভ্যুত্থানমাত্রই যে বিপ্লব নয়, সেটা গতবারও দেখেছি, এবারও দেখা গেল।

প্রশ্ন

আপনার প্রায় সব লেখায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা থাকে। পুঁজিবাদী সমাজেও তো কিছু উন্নত সংস্কৃতি থাকে, জ্ঞানবিজ্ঞানের অবাধ চর্চার সুযোগ থাকে। আমাদের এখানে সেটা কতটা আছে বলে মনে করেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: পুঁজিবাদে আলোর দিক অবশ্যই আছে। পুঁজিবাদ সামন্তবাদের নিগড় ভেঙে ফেলেছে। ইহজাগতিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা—এসব ধারণা সামনে নিয়ে এসেছে। স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর আওয়াজকে লালন-পালন করেছে। তবে পুঁজিবাদের ভিত্তিভূমিতে রয়েছে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা, যার অর্থ কতিপয়ের উন্নতি এবং অধিকাংশের বঞ্চনা। পুঁজিবাদের চালিকা শক্তি হচ্ছে মুনাফালোলুপতা। পুঁজিবাদ বৈষম্য ও বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে; ভোগবাদিতাকে উৎসাহ দেয়। প্রকৃতির সঙ্গে শত্রুতা করে। জলবায়ুতে বিরূপ পরিবর্তন আনে। বাংলাদেশ একটি প্রান্তিক পুঁজিবাদী দেশ। এর শাসকেরা উৎপাদনের উদ্যোগে অংশ নিয়ে ধনী হননি; ধনী হয়েছেন লুণ্ঠন, প্রতারণা ও শোষণের মধ্য দিয়ে। বিশ্বে পুঁজিবাদের অভ্যুদয়ের সময়ে পুঁজিবাদীদের ভেতর একধরনের দেশপ্রেম ছিল; বাংলাদেশের পুঁজিবাদীদের ভেতর সেটা নেই। এখানকার পুঁজিবাদীরা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করেন, যেভাবে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসকেরা করেছেন, সেভাবেই। পুঁজিবাদের আলোর দিকটা পাওয়া যায়নি, অন্ধকারটা ছড়িয়ে পড়েছে। এর আরও একটা কারণ, পুঁজিবাদের এখন আর দেওয়ার কিছু নেই, ধ্বংস ও ফ্যাসিবাদী নির্যাতন ছাড়া। দ্বিতীয়ত, আমাদের স্বদেশি পুঁজিবাদীরা শ্রেণিগতভাবে রাজনৈতিক সংগ্রামেও অংশ নেননি। তাঁরা ক্ষমতা পেয়ে গেছেন জনগণের মুক্তিসংগ্রামের দরুন। সংগ্রামটা করেছে সাধারণ মানুষ; তার সুফলটা নিয়ে নিয়েছেন পুঁজিবাদীরা।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রশ্ন

আপনার লেখালেখিতে জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতা যতটা গুরুত্ব পায়, বামপন্থীদের সীমাবদ্ধতা পেল না কেন? বাংলাদেশের বামপন্থীরা মূলধারার রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়লেন কেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: জাতীয়তাবাদের সীমার কথাটাই যে আলোচনায় বড় হয়ে দেখা দেয়, তার কারণ রাষ্ট্রক্ষমতা জাতীয়তাবাদীদের হাতেই রয়েছে। ক্ষমতা বদল হয়, কিন্তু ক্ষমতা ঘুরপাক খেতে থাকে বুর্জোয়াদের বৃত্তের ভেতরেই এবং বুর্জোয়ারা তো স্বাভাবিকভাবেই পুঁজিবাদী। পরিপোষক হিসেবে বামপন্থীদের সীমাবদ্ধতার ব্যাপারটাও কিন্তু আমার লেখায় থাকে; অনেক সময় প্রচ্ছন্নভাবে, কখনো কখনো সরাসরি। কারণ, বুর্জোয়ারা যে ক্ষমতায় আছে, তার মুখ্য কারণটা তো অন্য কিছু নয়, বামপন্থীদের দুর্বলতা বটে। বামপন্থীরা মূলধারায় থাকতে পারেননি একাধিক কারণে। প্রথম কারণ, জাতীয়তাবাদীরা তাঁদের প্রধান শত্রু বলে গণ্য করেছেন।

দ্বিতীয় কারণ সাতচল্লিশের দেশভাগ। তৃতীয় কারণ বামপন্থীদের কেবল যে প্রধান শত্রু মনে করেছেন তা–ই নয়, তাঁদের নির্মূল করতেও সচেষ্ট থেকেছেন। এটাই স্বাভাবিক। কারণ, বামপন্থীরা পুঁজিবাদবিরোধী। হিটলার ও মুসোলিনি দুর্ধর্ষ জাতীয়তাবাদী ছিলেন; তাঁদের কাছে এক নম্বর শত্রু ছিলেন কমিউনিস্টরা। আমাদের দেশেও দেখেছি, জিন্নাহ, আইয়ুব খান তো বটেই, শেখ মুজিব থেকে শুরু করে যত শাসক এসেছেন, প্রত্যেকেই কমিউনিস্টদের দমন করাকে নিজের প্রথম কাজ বলে ধরে নিয়েছেন। কাউকে তাঁরা প্রলোভন দেখিয়ে দলে টেনে নিয়েছেন; না পারলে কারারুদ্ধ করেছেন, হত্যাও করেছেন বহু বামপন্থীকে। এমনকি সুভাষ বসুর মতো অসামান্য স্বাধীনতাসংগ্রামীও কমিউনিস্টবিরোধী ছিলেন। তিনি সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন, কিন্তু সেটা জাতীয় সমাজতন্ত্র, যার সবচেয়ে বড় প্রচারক ছিলেন হিটলার। বাংলাদেশেও দেখেছি, জাসদ যে সমাজতন্ত্রের আওয়াজ তুলেছিল, সেটাও জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্র বৈকি। তার ফলে প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বামপন্থীদের নিজেদের ভেতরেও দুর্বলতা ছিল। তাঁরা যথার্থ বিপ্লবী হয়ে উঠতে পারেননি। অনেক ক্ষেত্রেই আপস করেছেন। আবার হঠাৎ হঠাৎ উগ্রপন্থা অবলম্বন করে জনবিচ্ছিন্ন ও আত্মঘাতী হয়েছেন। আপসপন্থীরা সংসদীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সমাজে বিপ্লব ঘটাবেন বলে ভেবেছেন। উগ্রপন্থীরা সাংস্কৃতিক প্রস্তুতিবিহীনভাবেই শ্রেণিশত্রু খতম করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবেন বলে ভেবেছেন। ওদিকে সমাজতন্ত্রীদের জন্য জ্ঞানের চর্চা অত্যাবশ্যক। তাঁরা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বেশির ভাগ সময়ই তাঁদের হয় কারাগারে, নয়তো আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। বইপত্রও পাওয়া যেত না।

তা ছাড়া ভারতের মনীষীরা আধ্যাত্মিক ও এক জাতিতত্ত্ব এমনভাবে প্রচার করেছেন যে বস্তুবাদীরা সুবিধা করতে পারেননি এবং এক জাতিতত্ত্ব দ্বিজাতিতত্ত্বের গোড়ায় জলসিঞ্চন করে সম্প্রদায়কে জাতিতে পরিণত করতে তৎপর হয়ে উঠেছে। শ্রেণিশোষণের প্রশ্নটি চাপা পড়ে গেছে জাতিসমস্যার নিচে। ফলে না হয়েছে জাতি প্রশ্নের সমাধান, না শ্রেণি প্রশ্নের মীমাংসা। সুবিধা হয়েছে জাতীয়তাবাদীদের, তাঁরা হিন্দু জাতীয়তাবাদী ও মুসলিম জাতীয়তাবাদী অবস্থান নিয়ে দেশভাগকে অনিবার্য করে তুলেছেন। ভাববাদিতাকে প্রসারিত ও ভারতের বহুজাতিত্বের বাস্তবতাকে অস্বীকার করার ব্যাপারে বড় একটা ভূমিকা কিন্তু পালন করেছেন মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বড় মাপের মানুষেরাও।

প্রশ্ন

আপনার একটি জনপ্রিয় লেখা ছিল ‘উপরকাঠামোর ভেতরেই’। সমাজের ওপরকাঠামোর যত পরিবর্তনই হোক না কেন, ভেতরটা স্থবিরই রয়ে গেছে। এমনটি কেন হলো?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ, ওপরকাঠামোয় পরিবর্তন ঘটেছে, রাষ্ট্রের ভাঙাগড়া চলেছে; কিন্তু ভেতরে অর্থাৎ আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় বড় কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এর অনেক কারণ আছে। একটা কারণ, আমরা বিশ্বপুঁজিবাদী ব্যবস্থার অধীনই রয়েছি এবং সে ব্যবস্থা নানা কৌশলে টিকে আছে। ছাড় দিয়েছে, তথাকথিত কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণা নিয়ে এসেছে, মজুরি বৃদ্ধিসহ রাষ্ট্রীয় সেবা বর্ধিত করেছে, লুণ্ঠনে-শোষণে অর্জিত সম্পদের ছিটেফোঁটা অংশ মেহনতি মানুষকে দিয়েছে। আবার অন্যদিকে চরম ফ্যাসিবাদী রূপ নিতেও কার্পণ্য করেনি। সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শক্তিশালী বাম আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। রাজনীতির প্রধান ধারা জাতীয়তাবাদীদের; ব্যতিক্রমহীনভাবে তাঁরা পুঁজিবাদে দীক্ষিত এবং সমাজ পরিবর্তনের বিরোধী। তৃতীয়ত, বুদ্ধিজীবীরা সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে ব্যাপকভাবে যুক্ত হতে পারেননি।

রাষ্ট্রশাসকেরা তাঁদের দমন করেছেন, ভয় দেখিয়েছেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রলুব্ধ করেছেন। গণমাধ্যম পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। বামপন্থীদের টেলিভিশন বা দৈনিক পত্রিকা তো দূরের কথা, উল্লেখযোগ্য সাপ্তাহিক পত্রিকা পর্যন্ত নেই। তারপরও বামপন্থীরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। সর্বোপরি দেশে একটা হতাশা বিরাজ করেছে এবং এখনো করছে। মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না যে পরিবর্তন সম্ভব। হতাশা মানুষকে বিপ্লবী করে না, মৌলবাদী হতে উৎসাহ জোগায়। এনজিওগুলোর কিছু তৎপরতা রয়েছে—তারা মানবাধিকার রক্ষার কথা বলে, ক্ষুদ্রঋণ দেয়, দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করে। কিন্তু এনজিওগুলো তো সংস্কারের মাধ্যমে পুঁজিবাদকে রক্ষা করতে চায়; বিপ্লব চায় না, বিপ্লব ঠেকানোটাই তাদের উদ্দেশ্য। তাদের তহবিল আসে পুঁজিবাদী বিশ্ব থেকেই।

প্রশ্ন

চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর ডানপন্থার আরও উত্থান হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। বিভিন্ন স্থানে মাজার, দরগাহ, খানকা ভাঙা হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের কাছারিবাড়িও রেহাই পায়নি। এসব ঘটনায় আপনি বিচলিত বোধ করেন কি না?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ, বিচলিত বোধ করার কারণ আছে বৈকি। তবে ডানপন্থার কেন উত্থান ঘটছে, সে কারণও দেখা দরকার। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন ও থাকেন, তাঁরা সবাই ডানপন্থীই, কেউ-ই বামপন্থী নন। বামপন্থীরা রাজনৈতিক মঞ্চে অনুপস্থিত। অভ্যুত্থানে তাঁদের অনুসারী ছাত্ররাও ছিল; কিন্তু তারা নেতৃত্ব দিতে পারেনি। ভয়ংকর চরিত্রের একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটেছে। ফলে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। এই শূন্যতা পূরণ করবে কারা? সম্ভাব্য শক্তি তিনটি—১. জাতীয়তাবাদী; ২. ধর্মীয় মৌলবাদী; ৩. বামপন্থী। জাতীয়তাবাদীরা অপেক্ষা করছেন; নির্বাচন হলে তাঁরা ক্ষমতায় যাবেন—এ রকমের প্রত্যাশা। ধর্মীয় মৌলবাদীরা নানা রকম তৎপরতা প্রদর্শন করছেন এবং সংগঠিতও হচ্ছেন। বামপন্থীরা কিন্তু তেমন দৃশ্যমান নন। তাঁদের কর্তব্য ছিল একটি যুক্তফ্রন্ট গঠন করে সামনে এগোনো। তাঁরা সেটা করেননি, করছেনও না। আশঙ্কার জায়গাটা হচ্ছে ধর্মীয় মৌলবাদীদের বিকাশ। তাঁরা যে ধরনের রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চান, তা তো কেবল রক্ষণশীল নয়, ঘোরতর প্রতিক্রিয়াশীলও বটে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রশ্ন

আপনি ব্যক্তিমালিকানার বদলে সামাজিক মালিকানা তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। কিন্তু সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনসহ যেসব দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, টিকল না কেন? এর অন্তর্নিহিত দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করেছেন কি?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর শত্রু ছিল যেমন বাইরে, তেমনি ঘরেও। বাইরের শত্রু গোটা পুঁজিবাদী বিশ্ব। পুঁজিবাদী শক্তিগুলো সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছে। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে তারা ব্যস্ত রেখেছে অস্ত্র প্রতিযোগিতায়, ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদন যেখানে ব্যাহত হয়েছে। এটা বোঝা গেছে যে এক দেশে বা কয়েকটা দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে টিকে থাকা কঠিন। পুঁজিবাদ যেমন একটি বিশ্বব্যবস্থা, সমাজতন্ত্রকেও তেমনি আন্তর্জাতিক আন্দোলন হিসেবেই শক্তিশালী হতে হবে।

অভ্যন্তরীণ শত্রু ছিল আমলাতন্ত্র। ভেতরে–ভেতরে আমলাতন্ত্র শক্তিশালী হচ্ছিল। পার্টি আমলাতন্ত্র যে সাধারণ আমলাতন্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী, সেটা প্রমাণিত হয়েছে।

স্তালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত ইউনিয়নে আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিয়েছে এবং পুঁজিবাদী বিশ্বের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করেছে। চীন মনে করেছে ওই পথ সংশোধনবাদিতার; ফলে রুশপন্থা ও চীনপন্থায় বিরোধ দেখা দিয়েছে। এই বিরোধের দরুন সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে এবং স্বভাবতই উভয় পক্ষই দুর্বল হয়েছে। ওদিকে চীনের অভ্যন্তরেও আমলাতান্ত্রিকতা গড়ে উঠছিল, যার বিরুদ্ধে মাও সে–তুং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন; কিন্তু সেটা সফল হয়নি। চীনের নেতৃত্বও সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিকতার আদর্শে স্থির না থেকে জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠেছে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতন তাই ঠেকানো যায়নি। তাই বলে মতাদর্শ হিসেবে সমাজতন্ত্র যে বাতিল হয়ে গেছে, তা কিন্তু নয়। পুঁজিবাদের বিকল্প পুঁজিবাদ হতে পারে না, তা সে যত রকমের ছদ্মবেশই ধারণ করুক না কেন।

প্রশ্ন

বাংলাদেশের শিক্ষার এই বেহাল কেন? এটাকেও নিশ্চয়ই আপনি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অনিবার্য পরিণতি বলবেন না। চব্বিশে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে আন্দোলন হলো, কিন্তু শিক্ষার অধোগতি ঠেকানো গেল না।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের দুর্দশাও অবশ্যই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। দুর্দশার প্রধান কারণ তিন ধারায় বিভাজিত। এই তিন ধারা শ্রেণিবিভাজনের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। বিত্তবানেরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ান; কাজেই মূলধারায় কী ঘটছে, সেটি নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা নেই। শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন শুরু করেছিল, তা শিক্ষক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটানোর জন্য নয়; সেটা ছিল চাকরিতে কোটাব্যবস্থার ফলে সৃষ্ট বৈষম্য দূর করার আন্দোলন। সরকারের নিষ্ঠুর নিপীড়নের সঙ্গে জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ যুক্ত হওয়ার কারণে আন্দোলন গণ–অভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়নের প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয় শর্ত মেধাবী ও অঙ্গীকারবদ্ধ মানুষদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগদান। সর্বোপরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া; যেটা হচ্ছে না। জ্ঞানের নয়, রাজত্ব চলছে টাকার।

প্রশ্ন

লেখক, শিক্ষক ও সম্পাদক—এই তিন সত্তার মধ্যে কোনটিতে আপনি অগ্রাধিকার দেবেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: লেখা আমার আকাঙ্ক্ষা, শিক্ষকতা আমার পেশা, সম্পাদনা আমার আগ্রহ। ঘটনাক্রমে, সৌভাগ্যক্রমেও বলা যায়, এই তিনের ভেতর কোনো বিরোধ ঘটেনি। তবে অগ্রাধিকার দেব লেখকসত্তাকেই।

প্রশ্ন

আপনি ২৩ বছর ধরে নতুন দিগন্ত সম্পাদনা করছেন। স্বল্পায়ু পত্রিকা ও প্রতিষ্ঠানের দেশে এটি বড় ঘটনা। কিন্তু সামাজিক রূপান্তরে কতটা ভূমিকা রাখতে পেরেছে?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সামাজিক রূপান্তরে বড় ভূমিকা রাখতে পারব—এমনটা আমরা মোটেই আশা করিনি। রূপান্তরের পক্ষে সাংস্কৃতিকভাবে সাধ্যমতো কাজ করব—এটাই ছিল আকাঙ্ক্ষা। সাংস্কৃতিক কাজটা প্রয়োজনীয়। সেটাই করতে সচেষ্ট ছিলাম এবং এখনো আছি। টিকে থাকাটা সহজ ছিল না। মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিতরণ। পত্রিকার স্টল আগে যে খুব বেশি ছিল তা নয়, এখন আরও কমে গেছে। পত্রপত্রিকার তো অবশ্যই, বইয়ের পাঠকও তো কমে এসেছে। ভয় ছিল, লেখা পাওয়া কঠিন হবে; সে ভয় কেটে গেছে। কিন্তু কী করে আরও অধিক পাঠকের কাছে যাওয়া যায়, সেটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রশ্ন

আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন হলেও নেতির দিকটিও আছে। যেমন ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা আরও প্রান্তিক হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বৌদ্ধিক সমাজের যে ভূমিকা রাখার কথা, তাতে ব্যর্থ হলেন কেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ, কথাটা সত্য। তবে শুধু এ ক্ষেত্রে নয়, সাধারণভাবেই বাংলাদেশের বৌদ্ধিক সমাজের ভূমিকাকে আদর্শায়িত করা যাবে না। পাকিস্তান আমলে দেখেছি, রাষ্ট্রের প্রতি বুদ্ধিজীবীদের আনুগত্যের ধারাটি বেশ শক্তিশালীই ছিল। প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশকে তো আমরা একাত্তরে হারালাম। পুঁজিবাদী সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বুদ্ধিজীবীদের ভেতরও বিলক্ষণ ঘটেছে। তা ছাড়া এটাও তো সত্য, বাংলাদেশে জনগণের পক্ষের যে শক্তি, সেটি কখনোই রাষ্ট্রক্ষমতায় যায়নি। আর বিগত সরকার ছিল নিকৃষ্টতম। সরকার যেভাবে সব পেশাজীবীকে পক্ষে–বিপক্ষে ভাগ করার তৎপরতা চালিয়েছে এবং ভয়ের একটা আবহাওয়া তৈরি করেছে, তাতে প্রতিবাদী অবস্থান গ্রহণ তো পরের ব্যাপার, কথা বলাটাও কঠিন হয়ে পড়েছিল।

প্রশ্ন

ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের চিত্র কেমন দেখেন? পুরোটাই হতাশার, না আশা করার মতো কিছু আছে বলে মনে করেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমি সব সময়ই আশাবাদী ছিলাম। এখনো তা–ই। হ্যাঁ, বর্তমানে যে সংকট দেখা দিয়েছে, যেমনটা আগে কখনো দেখিনি। এটি কেবল বাংলাদেশের নয়, গোটা বিশ্বেরই সংকট। মনুষ্যত্ব আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু ভরসা রাখি, মানুষ এটা মেনে নেবে না। রুখে দাঁড়াবে। কারণ, মানুষ তার মনুষ্যত্ব হারাতে রাজি হবে না। ছাত্র–জনতা যে অভ্যুত্থান ঘটাল, সেটিও তো ছিল অপ্রত্যাশিতই। মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। যা প্রয়োজন, তা হলো সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক জাগরণ। হৃদয়বান ও বুদ্ধিমান মানুষেরা আছেন, রয়েছে তরুণ সমাজ, তাঁরা সবাই এগিয়ে আসবেন—এমন আশা করাকে আমি অযৌক্তিক বলে মনে করি না।

প্রশ্ন

অন্যান্য দেশে লেখক–শিল্পীরা রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে যেভাবে দাঁড়ান, বাংলাদেশের লেখক–শিল্পীরা তা পারছেন না কেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: পারছেন না একাধিক কারণে। প্রথম কারণ, মুখে যা–ই বলি না কেন সাংস্কৃতিকভাবে আমরা অনগ্রসর। দ্বিতীয় কারণ, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ সব পেশাজীবীর মানুষকেই বিভক্ত করে ফেলা হয়েছে এবং বিরোধী পক্ষের ওপর দমন–নিপীড়ন চলেছে। তা ছাড়া এটাও সত্য যে রাজনৈতিক আন্দোলন না থাকলে সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধ জোরদার হয় না। বামপন্থীরা যদি ঐক্যবদ্ধ হতেন, তবে লেখক–শিল্পীরাও সাহস পেতেন। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের পরে দেশের সর্বত্র তরুণেরা দেয়ালে যেসব ছবি এঁকেছে ও যে ধরনের কথা লিখেছে, সেগুলোর মূল বক্তব্য হচ্ছে দেয়াল ভাঙতে হবে। ওই সব ছবি ও লেখা কিন্তু চাপা পড়া অবস্থায় ছিল রাজনৈতিক আন্দোলন না থাকার কারণে।

প্রশ্ন

আপনাকে ধন্যবাদ।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আপনাদেরও ধন্যবাদ।