
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বড় মেয়ে শারমিন আহমদের এই সাক্ষাৎকার প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান নিয়েছিলেন ২০২৪ সালের ১০ নভেম্বর। এই সাক্ষাৎকারে তাজউদ্দীন আহমদকে একজন পিতা হিসেবে, একজন নেতা হিসেবে, বিশেষ করে একজন মানুষ হিসেবে আমরা কেমন করে দেখি, সে বিষয়গুলো উঠে এসেছে। এ বছর তাজউদ্দীন আহমদের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তিন পর্বের এই সাক্ষাৎকারের আজ শেষ পর্ব প্রকাশিত হলো।
স্বাধীনতার পর সরকার গঠন এবং পরে একসময় তাজউদ্দীনকে মন্ত্রিসভা থেকে সরে যেতে হলো। আবার এটাও ঠিক, এটা আমরা জানি যে একদলীয় বাকশাল তিনি গ্রহণ করতে পারেননি। তিনি মানতে পারেননি, কিন্তু প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা কিংবা বিকল্প কিছু করেননি।
শারমিন আহমদ: আপনি যদি ’৭২ থেকে ’৭৪-এ তাজউদ্দীন আহমদের বক্তৃতাগুলো দেখেন, সব পত্রিকার কাটিংগুলো আমার বোন সিমিন হোসেন রিমি ইতিহাসের পাতা থেকে ওখানে যুক্ত করে প্রকাশ করেছেন। ১৮-২০ বছর আগে বইটা প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৭৪ সালের ২০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলে আব্বু যে বক্তৃতাটা দিলেন, তার ক্যাসেটটা নিয়ে আমি আর আব্দুল আজিজ বাগমার সেটি অনুবাদ করি। তখন কিন্তু আমার বয়স মাত্র ১৪।
দেখেন, তিনি কীভাবে তাঁর দলের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু খুব যৌক্তিক সমালোচনা। তিনি এমনও কথা বলছেন, ‘আপনার সামনে এই মন্ত্রীগুলোকে বহিষ্কার করুন। আপনার এখানে দলীয় দুর্নীতি চলছে। দলের হাতে অস্ত্র চলে গেছে। এখানে প্রতিটা প্রশাসনিক প্রক্রিয়াকে দলীয় মানুষেরা বাধাগ্রস্ত করছে। প্রাইভেট বাহিনী সৃষ্টি হয়েছে, তারা ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করছে।’
তিনি পাবলিকলি সমালোচনা করেননি, কিন্তু দলীয় কার্যালয়ে সবাই ছিলেন। এবং আরেকটা কথা, তিনি বলছিলেন হার্ড হিটিং। এয়ারপোর্টে তখন সাংবাদিকেরা। ওখানে আমরাও ছিলাম। আমরা আব্বুকে রিসিভ করতে গেলাম। বিদেশ থেকে ফিরে এসে তিনি বললেন, দুর্নীতি নিজ ঘর থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। উটপাখির মতো বালুর নিচে মাথা রেখে যদি ভাবি ঝড় থেমে গেছে, এটা বলা ভুল। তারপর চুয়াত্তরে দুর্ভিক্ষটা নিয়ে কত সুন্দর কথা বললেন, জাতীয় ঐকমত্যের কাঠামো সৃষ্টি করে জাতীয়ভাবে মোকাবিলা করতে হবে এই খাদ্যসংকট। তারপর বললেন, কেন দলের হাতে অস্ত্র থাকবে? আত্মীয়স্বজনের হাতে কেন অস্ত্র থাকবে? বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু, আপনাকে আমি বলে যাই, এই ঘটনা ঘটছে, আমরা কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব।’
অনেকে বলে যে তিনি বঙ্গবন্ধুকে মেনে চুপ ছিলেন। চুপ তো ছিলেন না। এগুলো বললেন বলেই তো তাঁর এই পরিণতি! একসময় বাকশাল যখন হবে, তিনি বললেন, ‘আপনি মারা যাবেন, আমরা মারা যাব, দেশ চলে যাবে স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে—বঙ্গবন্ধু, যেভাবে আপনি এখন সব গণতন্ত্র হত্যা করে এটা করছেন...।’ মণি সিংহ আমাদের বাসায় যখন এলেন, তাঁকে বললেন, ‘মণিদা, আপনারা কী করলেন, ত্রিদলীয় ঐক্যজোট করলেন, নাকি ত্রিশূল করলেন? এক শূলে আপনারা বঙ্গবন্ধুকে মারবেন। তিনি মারা যাবেন, আপনারা মারা যাবেন, একদম আমরা সবাই মারা যাব। কেউ থাকবে না।’ আমার মাকে বললেন, ‘লিলি, সাদা কাপড় তো তুমি পরোই, বলে দিচ্ছি, বিধবা হতে আর বেশি দেরি নেই।’ অসাধারণ এ কথাগুলো তো আমরা শুনছি। সো হি ডিড ক্রিটিসাইজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কিন্তু কনস্ট্রাক্টিভ ওয়েতে।
তিনি যে কথাগুলো বলছিলেন, তখন যদি সেটা তাঁরা নিতেন, তাহলে আজ আওয়ামী লীগের এই দুর্দশা হতো না। বাহাত্তরের পর আওয়ামী লীগের পারিবারিকীকরণটা শুরু হয়ে যায়। যখনই দলটা পরিবারের হয়ে যায় অথবা দলীয় স্বার্থটা দেশের স্বার্থের ঊর্ধ্বে প্রাধান্য পায়, তখন কিন্তু গণতন্ত্র মৃত্যুর দিকে চলে যায়। তা–ই হয়েছিল। এটা দুঃখজনক। আমরা হয়তো থাকব না। পরবর্তী পর্যায়ে আমি আশা করি, তরুণেরা এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আর যেন এই ভুল না করে। আমরা যেন ভুলের পথে আর না যাই।
একটা কথা আপনাকে বলি, যখন ১৯৯৩ সালে জোহরা আপার সাক্ষাৎকার নিলাম, তখন প্রথম শুনলাম তাঁর কাছ থেকে—স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে এলেন। তিনি এক দিনের জন্যও তাজউদ্দীন আহমদ বা অন্য যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কাছে শুনতে চাননি, জানতে চাননি যে তোমরা কীভাবে দেশটাকে স্বাধীন করলে? এই যে একটা দৃষ্টিভঙ্গি বা এই যে অবস্থা, এটা থেকেও বোঝা যায় যে অনেকগুলো ঘাটতি ছিল, যেগুলো পরে ধীরে ধীরে আরও বড় হয়েছে।
শারমিন আহমদ: এই যে জানতে চাননি, এটা খুব আশ্চর্যের ব্যাপার না! কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে প্রথম বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হলো। প্রশ্ন উঠেছিল এটা ভারতের মাটিতে হবে, না বাংলাদেশের মাটিতে হবে। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং জায়গাটার নাম তিনি করলেন মুজিবনগর। কারণ, এটা অনস্বীকার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তো মুক্তিযুদ্ধের সিম্বল ছিলেন। সব মিলিয়ে এমনই ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি নাম কখনোই চাননি। দেশ এখন মুক্তির পথে চলে গেছে, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা করছে, সেটাতে কোনোমতে যেন ভাঙন না ধরে। ওই সিম্বলটা তিনি সব সময় ধারণ করেছেন। তিনি নিজের প্রচার চাননি, একটা জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন। সেই জায়গাটায় মুজিব কাকু কখনোই যাননি। জানতেও চাননি।
একদিন আব্বু বললেন, ‘লিলি, আজকে বলতেই হবে মুজিব ভাইকে এসব কথা।’ তিনি যাওয়ার পর যখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা আরম্ভ করেছেন, মুজিব কাকু নাকি হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছেন। চুরুটটা নিয়ে একদম চোখ বন্ধ। আম্মা ভেবেছিলেন, ওই ঘটনা বলতে আব্বুর অনেক সময় লেগে যাবে। চার-পাঁচ ঘণ্টা। আব্বু যখন দ্রুত চলে আসেন, তখন আম্মুকে বললেন, ‘যে জেগে ঘুমায়, তাকে তো আমি জাগাতে পারব না। তিনি তো জানতেই চাচ্ছেন না ঘটনা।’ তাহলে কি বোঝা যায় যে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে (যেটা অনেকেই বলছেন) তাঁর কোনো ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স এসেছিল যে ‘আমার অবর্তমানেই দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে।’ এটা কিন্তু আমি ভারতীয় খুব উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে কথা শুনেছি। বাংলাদেশেও যাঁরা তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন, তাঁদের কাছেও শুনেছি।
■ বাহাত্তরের পর আওয়ামী লীগের পারিবারিকীকরণটা শুরু হয়ে যায়। যখনই দলটা পরিবারের হয়ে যায় অথবা দলীয় স্বার্থটা দেশের স্বার্থের ঊর্ধ্বে প্রাধান্য পায়, তখন কিন্তু গণতন্ত্র মৃত্যুর দিকে চলে যায়। ■ ভারতীয় ইন্টেলিজেন্সের সাহায্য নিয়ে যারা মুজিব বাহিনী করেছিল, তারা কীভাবে দেশ স্বাধীনের পর সবচেয়ে বড় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যায়? এটা কিন্তু খুব সাংঘর্ষিক ব্যাপার।
স্বাধীনতার পর ঢাকায় কর্মরত ভারতীয় কূটনীতিক জে এন দীক্ষিত কিন্তু এ কথাটা তাঁর বইতে লিখেছেন, তিনি (বঙ্গবন্ধু) যে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি, থাকতে পারেননি—এটার মধ্য দিয়ে তাঁর মধ্যে একটা দুর্বলতা কাজ করত মানসিকভাবে। তাই তিনি কখনো এ বিষয়টা জানতে চাননি, এ বিষয়গুলোকে তিনি সামনে নিয়ে আসেননি।
শারমিন আহমদ: যার ফলে দেখেন, এক লাখ এক হাজার মুক্তিযোদ্ধা। আপনারা যদি তাজউদ্দীন আহমদের বাহাত্তরের স্পিচটা দেখেন, পড়েন, সেখানে কিন্তু দেখবেন যে আরম্ভ হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নিয়ে ‘ফ্রডুলেন্ট অ্যাকটিভিটি’। এক লাখ এক হাজার মুক্তিযোদ্ধা—এই দামাল ছেলেগুলো, যাদের মধ্যে বিপ্লবের চেতনা প্রবহমান, তাদের দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। তারপর দেখেন, তিন লাখের মতো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট তখন চলে গেল। চলে গেল কাদের হাতে, দেখেন। যারা মুক্তিযুদ্ধের সরকারের বিরুদ্ধে, মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, সেই যুবলীগ শেখ মনি, মুজিব বাহিনীর হাতে।
আমার প্রশ্ন হলো, এটা কিন্তু একটু ভেবে দেখার বিষয়, তাঁরা বারবার দাবি করছেন, সরকার গঠন শেখ সাহেবের প্ল্যানমতেই হয়েছে। তা-ই যদি হবে, তার মানে মুক্তিযুদ্ধের সরকার হয়েছে। তো যুদ্ধের প্রতিমুহূর্তের পরিস্থিতিতে কী হবে, কেউ তো বলতে পারে না। তারা ওগুলোরও ক্রেডিট নিয়েছে। তা-ই যদি হবে, তাহলে এটা প্রশ্ন আসে, মোশতাক চক্র, যারা সিআইয়ের সঙ্গে যোগসাজশ করছে, ষড়যন্ত্র করছিল, যাকে তাজউদ্দীন আহমদ সরিয়ে দিলেন তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে, ভারতীয় ইন্টেলিজেন্সের সাহায্য নিয়ে যারা মুজিব বাহিনী করেছিল, তারা কীভাবে দেশ স্বাধীনের পর সবচেয়ে বড় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যায়? এটা কিন্তু খুব সাংঘর্ষিক ব্যাপার। তিনি যদি সব বলেই যাবেন, তার মানে তাজউদ্দীন আহমদরা তো বঙ্গবন্ধুর কথা অনুসারেই দেশ স্বাধীন করেছেন।
এটা নিয়ে তো অনেক আলোচনা আপনারাও লিখেছেন, আরও অনেক গবেষক লিখছেন, লিখতে হবে। হবে আলোচনা। এখানে একটা-দুইটা কথা বলে আমরা শেষ করি। তাজউদ্দীন আহমদ কিন্তু শুরুতেই বলেছিলেন যে এই মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না। অথচ এই নিয়ে কিন্তু বহু আলোচনা, বহু চিন্তা। কেউ এতটা ভাবেনি যে ৯ মাসের মধ্যেই এটা শেষ হয়ে যাবে। তার যে এ রকম একটা ভবিষ্যদ্বাণী, যেটা সত্যি সত্যি প্রমাণিত হলো। আরেকটা কথা, ১০ এপ্রিলের বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, এই যুদ্ধ বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, সাধারণ মানুষের মুক্তিযুদ্ধ। আমি তো দেখি, এই যে চিন্তাচেতনার ভাবনাটা—দ্রুত যুদ্ধ শেষ হবে এবং এই যুদ্ধটা বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের যুদ্ধ।
শারমিন আহমদ: এটা অসাধারণ। বিশেষত তাঁর ১০ এপ্রিল ও ১৭ এপ্রিলের এই দুটি বক্তৃতা পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া এবং এটা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার।
আমরা শেষ করি একটা কথা দিয়ে, অন্য রকমভাবে, ১৯৫৯ সালের এপ্রিল মাসে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বেগম জোহরার বিয়ে হয়েছিল। বিয়েতে তাজউদ্দীন সাহেব বেলি ফুলের সব রকমের গয়না নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই ১৯৫৯ সালে তাজউদ্দীন আহমদের মতো একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের, মোটামুটি বিত্তশালী পরিবারের শিক্ষিত সন্তান, তখন তিনি আওয়ামী লীগের একজন প্রধান নেতা, তাঁর বিয়েতে বেলি ফুল দিয়ে বিয়ে করার বিষয়টাতে আমি খুব চমৎকৃত হয়েছি।
শারমিন আহমদ: আসলে আম্মাকে যখন আব্বু জিজ্ঞেস করেছিলেন যে বিয়ের সময় কী দরকার, কী ধরনের গয়নাগাটি লাগবে, তখন আম্মা বলেছিলেন, ‘আমি সোনার গয়না পছন্দ করি না, আমার জন্য বেলি ফুলের গয়না আনবেন।’ আম্মার বাবা তখন ঢাকা কলেজের আরবির অধ্যাপক। মানে আম্মারা খুব প্রগ্রেসিভ সম্ভ্রান্ত পরিবারের। মজার ব্যাপার, আব্বু নিয়ে এলেন একরাশ বেলি ফুলের গয়না।
আম্মার সঙ্গে আব্বুর বিয়ে হয় ’৫৯ সালে। তারপর আমার জন্ম হলো ১৯৬০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি। আম্মা বলেছিলেন, ‘তোমার আব্বু নিজে গিয়ে তোমার জন্য একটা সাদা বেতের দোলনা নিয়ে এসেছিলেন, তিনি নিজে মিষ্টি বিতরণ করলেন।’ আমার তৃতীয় বোন হলো, তখন সবাই বলছিল যে এবার ছেলে হবে। আমাদের তো সবারই ঘরে জন্ম। যখন আমার ছোট বোন মিমি হলো, তখন যে দাই ছিল, একটু মুখ ঝামটা দিয়ে বলছে যে এবারও তো মেয়ে হলো!
মিমি হওয়ার পর আব্বু অনেক মিষ্টি নিয়ে এসেছিলেন। মেয়ে-ছেলের তিনি পার্থক্য দেখতেন না। তারপর যখন সোহেল হলো, তখন সবাই বলল, এই তিন মেয়ের পরে এখন ছেলে হয়েছে। এবার তো আমাদের মিষ্টি খাওয়াতে হবে। তখন আব্বু বললেন, ‘কেন? তিন মেয়ের সময় তো আমি মিষ্টি খাওয়ালাম। আপনারা যখন আমার চেয়েও বেশি খুশি, আপনারা আনেন।’ মনে আছে, সোহেল হলে মুজিব কাকু আওয়ামী লীগ অফিসে সবাইকে মিষ্টি খাওয়ালেন।
এই বেলি ফুলের প্রসঙ্গ দিয়ে আমি একটা কথা যোগ করব, যাঁরা প্রকৃতি, ফুল সত্যিকারের ভালোবাসেন এবং তাঁদের জীবনের একটা বড় অংশ এগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত, মৃত্যুভয়টাও তাঁরা কিন্তু অতিক্রম করে ফেলেন। আব্বুকে যখন মারা হবে, ওই ১ নভেম্বরে আম্মাকে বললেন, ‘লিলি, আজকে আমার ডায়েরির শেষ পাতা, আমি শেষ পাতাটা আজকে লিখে শেষ করব। আর হ্যাঁ, আমাদের বাঁচিয়ে রাখা হবে না। কারণ, দুই দিন আগে দেখেছি, মিলিটারির লোকজন সব জায়গা দেখে গেছে।’
তিনি তখন এটাও বলছিলেন যে জেলখানাটাকে রেডক্রসের অধীনে আনলে ভালো হয়। এরপর ২ থেকে ৩ তারিখ দিবাগত রাতে তাঁদের হত্যা করা হয়। আব্বু শতাধিক ফুলের গাছ লাগিয়েছিলেন—গোবর–মাটি আনিয়েছিলেন বাইরে থেকে এবং মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তিনি প্রকৃতির কাছে চলে গিয়েছিলেন। জবা ফুলেরও গাছ লাগিয়েছিলেন। জেলখানায় যাঁরা পাঁচ-ছয় বছর ছিলেন আমার বাবার সঙ্গে রাজবন্দী, তাঁরা বললেন, ‘তাজউদ্দীন ভাই ছিল না। রক্তজবা গাছগুলো ছিল।’ ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, টু প্লান্ট আ গার্ডেন টু বিলিভ ইন টুমরো। যে বাগান লাগায়, সে বিশ্বাস করে যে একটা ভালো ভবিষ্যৎ আসবে। তিনি আশার আলোটা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, প্রতিটা বীজ প্রতিটা চারাগাছের সঙ্গে।
ভবিষ্যতের বীজ রোপণ করার প্রশ্নটাই তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এখন আমাদের সামনে। একটা ক্রান্তিলগ্নে, আশা করি যে আমরা বিগত দিনের অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগিয়ে সত্যিকার অর্থে একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাব। এটাই হয়তো পথ। এসব নিয়ে আমরা যত বেশি কথা বলতে পারব, যত বেশি আলোচনা করতে পারব, তর্কবিতর্ক করতে পারব, ততই আমাদের জন্য ভবিষ্যতের পথ, সুন্দর পথ, আমরা দেখতে পাব।
শারমিন আহমদ: সুন্দর! আপনাকে ধন্যবাদ।
মতিউর রহমান: আপনাকে ধন্যবাদ।