সরকারি ব্যাংকের সব পদে একটি সম্মিলিত পরীক্ষা নেওয়া যায় কি?
আগে প্রতিটি সরকারি ব্যাংক আলাদাভাবে পরীক্ষা নিত। প্রক্রিয়াটি ছিল ব্যয়বহুল এবং খুবই সময়সাপেক্ষ। দেখা যেত, একই শিক্ষার্থী কয়েকটি পরীক্ষায় টিকছেন, কেউ কেউ সব কটিতেই। কিন্তু একজন তো আর একাধিক ব্যাংকে যোগদান করতে পারেন না, লেগে যেত জটিলতা। বেকারদের নাভিশ্বাস উঠে যেত।
এই পদ্ধতির অসুবিধা দূর করতে কর্তৃপক্ষ একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। এখন আর আগের পদ্ধতিতে পরীক্ষা হয় না। অসুবিধা বিবেচনায় পরীক্ষাপদ্ধতিতে নতুনত্ব এসেছে। এখন সব সরকারি ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য সমন্বিত পরীক্ষা হয়। ধরা যাক, সরকারি ব্যাংকগুলো সিনিয়র অফিসার নেবে। তার জন্য প্রতিটা ব্যাংক আলাদাভাবে পরীক্ষা নেয় না। একটিই পরীক্ষা। দায়িত্বে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি।
গত বছরের ১২ ডিসেম্বর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস-২০২২’ উদ্যাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলব। আর সেই বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে আমরা চলে যাব।’
এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে বর্তমান পরীক্ষাপদ্ধতি স্মার্ট করার সময় এসেছে। সিনিয়র অফিসার, অফিসার (জেনারেল) এবং অফিসার (ক্যাশ) পদের জন্য একটি সম্মিলিত পরীক্ষা নেওয়া সময়ের দাবি। চাইলে এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক, অফিসার (জেনারেল) এবং অফিসার (ক্যাশ) যুক্ত করা যেতে পারে অথবা বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের এই তিনটি পরীক্ষা সম্মিলিতভাবে নিতে পারে।
বর্তমান পদ্ধতির সংস্কার কেন জরুরি হয়ে পড়েছে, সে বিষয়ে নজর দিই। সরকারি ব্যাংকের প্রতিটি পদের জন্য একজন চাকরিপ্রত্যাশীকে তিন ধাপে যাচাই করা হয়। প্রথমে প্রিলিমিনারি, তারপর লিখিত এবং সর্বশেষ মৌখিক পরীক্ষা। একটি পরীক্ষা পুরোপুরি শেষ হতে সময় লাগে প্রায় এক বছর। অনেক ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি সময়। পদসংখ্যার ওপর নির্ভর করে। সহজ কথায় বলতে গেলে যে কাজ একবারে শেষ করা যায়, সেই কাজ তিনবার করা হচ্ছে। হচ্ছে সময়ক্ষেপণ। বাড়ছে ব্যয়।
ব্যাংকে প্যানেলের ব্যবস্থা আছে, অর্থাৎ কেউ যদি যোগদান না করেন, তাহলে অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে চাকরি হয়। প্যানেল নিয়ে চাকরিপ্রত্যাশীদের মধ্যে হতাশা এবং ক্ষোভ আছে। কারণ, সব ব্যাংক একই সঙ্গে নিয়োগ দেয় না। কোনো ব্যাংক চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের দুই মাসের মধ্যে নিয়োগ দেয়, কোনো ব্যাংক পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যেও নিয়োগ দেয় না। উদাহরণ হিসেবে রূপালী ব্যাংকের কথা ধরা যাক। প্রায় ৯ মাস আগে চূড়ান্ত ফলাফল হয়েছে, কিন্তু এখনো নিয়োগ হয়নি। এদিকে প্যানেল হয় সব ব্যাংকের নিয়োগ শেষ হওয়ার পর, যা খুবই সময়সাপেক্ষ।
সমস্যা আরও আছে। সিনিয়র অফিসার, অফিসার (জেনারেল) এবং অফিসার (ক্যাশ) এ তিনটি পরীক্ষাই প্রায় কাছাকাছি সময়ে হয়। এমন না যে একটি পদের নিয়োগ শেষ হওয়ার পর আরেকটি পদের পরীক্ষা শুরু হয়। ফলে এই তিন পরীক্ষাতেই টেকা অনেক চাকরিপ্রত্যাশী থাকেন। প্যানেল হতে দেরি হয়। আজ যাঁর চাকরি পাওয়ার কথা, তিনি পান আরও ছয় মাস বা বছরখানেক পর, কিংবা আরও বেশি সময় পর। অথচ একটি সম্মিলিত পরীক্ষা হলেই এই সমস্যা দূর করা যায়।
একটি পদের পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে ঢাকার বাইরে থেকে একজন চাকরিপ্রত্যাশীকে তিনবার ঢাকায় আসতে হয়। আবার বিষয়টা এমন নয় যে একটি ভাইভা দিয়েই কারও চাকরি হয়ে যায়। তিনটি পদের পরীক্ষা শেষ করতে তাঁকে নয়বার ঢাকায় আসতে হয়। একজন বেকারের জন্য বিষয়টি কতটা ব্যয়বহুল, তা সহজেই অনুমেয়। আর্থিক দিক ছাড়াও একজন নারীর জন্য বিষয়টি আরও কষ্টদায়ক। এর অবসান হওয়া দরকার।
ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি তাদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে ২০০ টাকা ফি নেয়। এটি খুবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। একটি সম্মিলিত পরীক্ষা নিলে ফি আরও কমানো যাবে। কারণ, তখন কেন্দ্র একবার ভাড়া করলেই হবে।
এ ছাড়া ২০১৮ সালের সার্কুলারের নিয়োগ ২০২৩ সালে এসে হচ্ছে। একটি সম্মিলিত পরীক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমে এই ৫ বছরের গ্যাপ (সংকট) দূর করা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে দ্বৈত পরীক্ষক পদ্ধতি চালু করা সহজ হবে। বর্তমানে একক পরীক্ষক পদ্ধতি চালু আছে, যা চাকরিপ্রত্যাশীদের জন্য অস্বস্তিকর। কারণ, এসব পরীক্ষায় ন্যূনতম নম্বরের ব্যবধানে কারও চাকরি হয়, কারও হয় না। আর এটা জানা কথা যে পরীক্ষক ভেদে লিখিত পরীক্ষার নম্বরে এই ন্যূনতম ব্যবধানের চেয়ে বেশি ব্যবধান হওয়া মোটেও অস্বাভাবিক না। দ্বৈত পরীক্ষক হলে খাতা দেখার মান আরও ভালো হবে, নম্বরের হেরফের কম হবে। তা ছাড়া একজনের পর যেহেতু আরেকজন খাতা দেখবেন, এ কারণে পরীক্ষকের দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বশীলতা বাড়বে।
একটি সম্মিলিত পরীক্ষায় প্যানেল নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। সিনিয়র অফিসার যে কয়জন যোগদান করবেন, মেধার ভিত্তিতে পরের ক্রমের অফিসারকে সিনিয়র অফিসার করা যায়। এভাবে ক্রমে সর্বোচ্চ একটি প্যানেল করা যায়। শেষ পর্যন্ত যে সংখ্যক যোগ দেবেন না, সেই সংখ্যক পরের সার্কুলারে যোগ করে দিলেই হলো। প্যানেল পুরোপুরি বাদও দেওয়া যায়। একটি সম্মিলিত পরীক্ষায় এত বিশালসংখ্যক নিয়োগ হওয়ার পর প্যানেলেরই-বা কী দরকার। উল্লেখ্য, অধিকাংশ বড় নিয়োগে (বিসিএস, বাংলাদেশ ব্যাংক, সহকারী প্রাথমিক শিক্ষক, হিসাব নিয়ন্ত্রকের অডিটর) প্যানেল থাকে না।
বর্তমানে মেডিকেলে ভর্তির জন্য একটি পরীক্ষা নেওয়া হয়। বিসিএসে ক্যাডার ও নন-ক্যাডারদের জন্য একটি পরীক্ষা নেওয়া হয়। গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে কৃষি ও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।
ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি চাকরিপ্রত্যাশী বেকারদের জন্য একটি সুন্দর ও কার্যকর পদ্ধতির ব্যবস্থা করতে বদ্ধপরিকর। এ ব্যাপারে তারা খুব আন্তরিক। ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সব সময় চেষ্টা থাকে বেকারদের কষ্ট লাঘব করার। এই উদ্দেশ্য সফলের একটি উত্তম হাতিয়ার হতে পারে সব পদের জন্য একটি সম্মিলিত পরীক্ষা চালু করা।
সঞ্জয় সরকার
প্রাক্তন শিক্ষার্থী
ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন
-
পৃথিবীর কোন দেশে সেন্ট্রাল ব্যাংকে ঢুকতে পারছে অবাধে: ওবায়দুল কাদের
-
পদ্মা সেতু প্রকল্পে নদীশাসনে হাজার কোটি টাকা বাড়তি চায় চীনা ঠিকাদার
-
রাঙামাটিতে এলোপাতাড়ি গুলিতে ইউপিডিএফের কর্মীসহ দুজন নিহত
-
বিশ্বের সেরা এয়ারলাইনস আট মাসের বেতনের সমান বোনাস দিচ্ছে
-
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সিরিজের ভেন্যুতে ঝড় বয়ে গেছে