চিঠিপত্র

৭ মার্চের ভাষণ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একই সুতায় গাঁথা

কানায় কানায় পূর্ণ রেসকোার্স ময়দানে মাত্র ১৯ মিনিট ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের সেই ভাষণে বাঙালি জাতি পেয়ে যায় স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা
ছবি: সংগৃহীত

আজ ‘আমি বাংলাদেশের নাগরিক’—এ কথাটা বুক ফুলিয়ে বলতে পারার পেছনে ৭ মার্চ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অসীম। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর একটি। এ ভাষণকে গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ (১৮৬৩) বক্তৃতা ও মার্টিন লুথার কিং (জুনিয়র)-এর ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ (১৯৬৩) ভাষণের সঙ্গে তুলনা করা হয়। ১৮৬৩ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জাতিকে একতাবদ্ধ করার জন্য গেটিসবার্গে মাত্র ৩ মিনিটের এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়েছিলেন, যা ইতিহাসে অত্যন্ত খ্যাতি লাভ করে। প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ গেটিসবার্গ ভাষণের মতোই ইতিহাসের এক অনন্য দলিল।

একজন মা যেমন সন্তান কান্না করলে বুঝতে পারেন যে তার ক্ষুধা লেগেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও বাঙালিদের ক্ষুধা, প্রয়োজন বুঝতে পারতেন এবং সমাধানের জন্য নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে এগিয়ে যেতেন, ইতিহাস তা সাক্ষ্য দেয়। ৭ মার্চের ভাষণে সেটিই আমরা দেখতে পাই। ৭ কোটি বাঙালিদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যবোধ সৃষ্টিতে ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

সেদিনের সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর বাণী ছিল মন্ত্রমুগ্ধের মতো। তিনি যেমন তাঁর ভাষণে ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে সম্বোধন করেছিলেন তেমনি বাঙালিদেরও পরস্পর ভাই ভাই হিসেবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সেদিন বাঙালি জাতির মধ্যে সুদৃঢ় ভ্রাতৃত্ববোধের সৃষ্টি করে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। অনন্য ভাষণটি অধিকারবঞ্চিত বাঙালির শত সহস্র বছরের সংগুপ্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের উচ্চারণে সমৃদ্ধ। দীর্ঘ ২৩ বছরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালি জনগণের মধ্যে যে তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভ জন্ম হয়েছিল, মাত্র ১৮ মিনিটের (মতান্তরে ১৯ মিনিটের) ভাষণে তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সাবলীল ভঙ্গিমায় অত্যন্ত সুনিপুণভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হন। শুধু অভিযোগ ও বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে তিনি ক্ষান্ত হননি, একই সঙ্গে আপামর বাঙালির মুক্তির পথও বাতলে দিয়েছেন। এ জন্য এ ভাষণ ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। বঙ্গবন্ধু তাঁর পাণ্ডিত্য ও তেজোদীপ্তময় ঘোষণার মধ্য দিয়ে পরোক্ষভাবে এদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাও দিয়েছিলেন।

একজন নেতার একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ একটি পুরো জাতিকে কীভাবে ঐক্যবদ্ধ ও আমরণ সংগ্রামে উদ্বেলিত করতে পারে, তার অনন্য নজির হয়ে আছে এই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে। এই ভাষণের শক্তিকে ধারণ করেই কিন্তু বাঙালিরা উজ্জীবিত হয়েছিল দেশকে স্বাধীন করার চেতনায়। যার ফলে বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে একবারের জন্যও পিছু তাকায়নি। আর তাদের ত্যাগের ফলাফল আজকের বাংলাদেশ এবং ‘আমি বাংলাদেশের নাগরিক’—এ কথা বলার শক্তি।

ইতিহাস থেকে জানা যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের অসীমতা। তিনি কখনো নিজেকে নিয়ে ভাবতেন না, অন্যকে নিয়ে ভাবতেন এবং জনগণকে নিয়ে বাঙালিদের ভাবাতে শেখাতেন। তিনি কখনো নিজের কষ্টকে নিয়ে ভাবতেন না বরং আমজনতার কষ্ট বুকে লালন করে সেসব কষ্টের সমাধানকে নিয়ে ভাবতেন। এমন একজন মহান নেতাকে পাওয়া বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণের সারা জীবনের অহংকার।

সুতরাং শেষ লাইনে বলতে চাই, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বাংলার উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন, আছেন এবং এই পৃথিবীতে যত দিন প্রকৃতির অস্তিত্ব থাকবে, তত দিন তিনি কোটি কোটি বাঙালির অন্তরে উজ্জ্বল প্রদীপের মতোই থাকবেন।

মো. আব্দুল ওহাব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়