দীপেশ চক্রবর্তীর লেখা

স্মৃতি, সত্তা ও ইতিহাসের অন্বয়ী রণজিৎ গুহ

বেঁচে থাকলে আজ ২৩ মে শততম জন্মদিন হতো রণজিৎ গুহর। গত ২৮ এপ্রিল অস্ট্রিয়ায় নিম্নবর্গের ইতিহাসের প্রখ্যাত এই তাত্ত্বিকের জীবনাবসান ঘটে। শততম জন্মদিবসে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে দীপেশ চক্রবর্তী লিখেছেন রণজিৎ গুহর ইতিহাস-ভাবনায় স্মৃতি বা ‘দেশে ফেরা’র ভূমিকা নিয়ে। দীপেশ চক্রবর্তী নিজে নিম্নবর্গের আরেক খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ এবং রণজিৎ গুহের দীর্ঘদিনের সঙ্গী। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের লরেন্স এ কিম্পটন ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস প্রফেসর।

রণজিৎ গুহ (২৩ মে ১৯২৩–২৯ এপ্রিল ২০২৩)
রণজিৎ গুহ (২৩ মে ১৯২৩–২৯ এপ্রিল ২০২৩)

রণজিৎ গুহের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে কিছু লিখতে আহূত হয়ে সাজ্জাদ শরিফেরই করা একটি প্রশ্ন মনে পড়ছে। একদা যিনি নিম্নবর্গের, কৃষকের বিদ্রোহী চৈতন্যের ঐতিহাসিক হিসেবে বিশ্বনন্দিত হয়েছিলেন, সেই রণজিৎ গুহ মহাশয় তাঁর জীবনের শেষ দুই-আড়াই দশক মহাভারত, রামমোহন, অভিনবগুপ্ত, রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি অবলম্বন করে বহু সাহিত্যিক ও মানব-জীবনের দার্শনিক প্রশ্ন নিয়েই লেখালেখি করেছিলেন। এবং শুধু বাংলায়। ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ বা ‘চন্দ্রা’স ডেথ’-এর মতো প্রবন্ধ আর লেখেননি। কিছুটা রহস্য করেই জিজ্ঞাসা করেছিলেন সাজ্জাদ, এই যে রণজিৎ গুহ বা আপনারা নিম্নবর্গের ইতিহাস ছেড়ে আবার রামমোহন রায়ের মতো এলিটদের কাছে ফিরে যান, এটা কি বৃদ্ধ বয়সে তীর্থে যাওয়ার মতো?

বলা বাহুল্য, এই প্রশ্নে রণজিৎদার প্রতি বা তাঁর শেষের দিকের বাংলা রচনার প্রতি কোনো অসম্মান ছিল না। আমিও তখন যা-হোক একটা জবাব দিয়েছিলাম। বস্তুত, এই প্রশ্নের জবাব রণজিৎদাও তাঁর শেষ দুয়েকটি ইংরেজি রচনা—যেমন দ্য স্মল ভয়েস অব হিস্টরি বা তাঁর সর্বশেষ ইংরেজি বই, হিস্টরি অ্যাট দ্য লিমিটস অব ওয়ার্ল্ড হিস্টরিতে কিছুটা দিয়েছিলেন। বুদ্ধি ও জ্ঞানকে আশ্রয় করে ছিল তাঁর সেই উত্তর।

বলেছিলেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধীত যে পশ্চিমি ইতিহাসবিদ্যা বা ডিসিপ্লিন, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের সঙ্গে তার এমন জন্মগত সম্পর্ক যে তাকে অবলম্বন করে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক ও ভঙ্গুর সুখ-দুঃখের গল্পের মধ্যে যে ঐতিহাসিকতা, তাকে ধরা যায় না। রাষ্ট্রের প্রতি কোনো আনুগত্য ছিল না রণজিৎদার লেখায় বা মননে। কোনো দিনই ছিল না। বরং বলেছিলেন যে ঐতিহাসিকতার স্বাদ পেতে গেলে রাষ্ট্রিক ইতিহাসের বাইরে সাহিত্য ও ভাষার মধ্যে সন্ধান করতে হবে। তাই তাঁর সেই অভিমুখে যাত্রা।

রণজিৎদার এই উত্তর ছিল চিন্তা ও যুক্তিভিত্তিক। রণজিৎদার চিন্তার যে পরিক্রমার পথ, এ যেন তারই একটি বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে কথা বলা। আজ কেউ কেউ রণজিৎদার শেষের দিকের বাংলা রচনার আলোচনা শুরুও করেছেন। সেই আলোচনার গুরুত্ব আছে, কিন্তু আমি সেই তাত্ত্বিক আলোচনায় যাচ্ছি না। বরং রণজিৎদার জন্মদিনে বসে রণজিৎদার এই সাহিত্য বা দর্শনমুখী হওয়ার তাৎপর্য কিছুটা তাঁর সামগ্রিক ব্যক্তিজীবনের পরিপ্রেক্ষিতে বুঝতে চাই। সেই বোঝার কাজটা শুরু করতে গেলে কিন্তু সাজ্জাদের তোলা ওই ‘ফিরে যাওয়া’র প্রশ্নটাই একটি ইঙ্গিতবহ উক্তির মতো কাজ করে। কথাটির প্রতিধ্বনি করে আমি বলব, রণজিৎদাদের মতো বাঙালি ঐতিহাসিকদের জন্য বাংলা ভাষায় চিন্তা করা ও লেখা একধরনের ‘ফেরা’ই বটে।

কিন্তু কোথায় ফেরা? ভাষার মধ্য দিয়ে যে ‘দেশ’-এর স্বাদ পাওয়া যায়, বহু বহুদিন দেশছাড়া প্রবাসজীবনের মধ্যেও নিজের মধ্যে ধরে রাখা যে ‘দেশ’, সেই দেশে ফেরা। সেই দেশে বর্ডার, পাসপোর্ট, রাষ্ট্রের হুকুমত চলে না।

বলতে পারেন, বহুবচনে ‘রণজিৎদাদের’ মতো কেন লিখলেন? বহুবচন নয়, আমার মনে ছিল দ্বিবচন—দুই প্রবাসী বাঙালি ঐতিহাসিকের কথা। তপন রায়চৌধুরী, সকলের সর্বজনীন তপনদা ও রণজিৎ গুহ বা রণজিৎদা। একই প্রজন্মের বাঙালি, তপনদা সামান্য ছোট, দুজনেই ভারত-ইতিহাসচর্চার পথের পথিক, আধুনিক বিশ্ব-ইতিহাসে আজকের গ্লোবায়নপর্ব শুরু হবার আগেই দেশত্যাগী, দুজনেই বহুদিন চাকরিসূত্রে ইংল্যান্ডবাসী, ভাগ্যক্রমে দুজনেই বরিশালের হিন্দু জমিদার/তালুকদার বংশের সন্তান এবং সেই কারণে দেশভাগেরও শিকার। শেষজীবনে দুজনেরই বাংলা ভাষায় প্রত্যাবর্তন। অনেকেই স্বীকার করবেন যে তপনদার স্মৃতিমূলক বাংলা বই তাঁর ইংরেজি গবেষণাধর্মী গ্রন্থের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী। আর রণজিৎদার বাংলায় প্রত্যাবর্তন নিয়েই তো এই লেখার অবতারণা।

অথচ পাশ্চাত্যে রণজিৎদাদের মতো মানুষেরা এই জীবনঘন অস্তিত্বের স্বাদ সামাজিকভাবে বিশেষ পেতেন না। তাই ফিরতে হয় স্মৃতিতে, সাহিত্যে, গাথায় ও কাব্যে—পরিচিত, একান্ত নিজস্ব ভাষার মারফত। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত লাইনগুলিই আবার মনে পড়ে: ‘কিন্তু তোমার তালছড়িটা—/ মেঘে মেদুর সেই যে বক্ষে বাস্তুভিটা/ যেখান থেকে বাকি জীবন করবে শুরু বলেই এলে—/ সেইখানে আজ অভয় পেলে’। তা না হলে আবার শক্তিরই ভাষায় বলি, ‘এই বিদেশে সবই মানায়’।

ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমার মনে হয় এই প্রত্যাবর্তন—সাজ্জাদের ভাষায় ‘ফেরা’—বুঝতে গেলে আমাদের শিক্ষিত বাঙালির প্রবাসী হওয়ার ইতিহাসে কতগুলি পর্যায়ভেদ করে বুঝতে হবে। গত পঁচিশ বা তিরিশ বছরে দেখেছি পাকিস্তানে, বাংলাদেশে, ভারতে সচ্ছল বা উচ্চবিত্ত পরিবারের বহু ছেলেমেয়ে শৈশব থেকেই পরিবারের, ইস্কুলের, কলেজের, বিশ্ববিদ্যালয়ের ও মিডিয়ার আবহাওয়ায় যেন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা, ইংল্যান্ডে বসবাস করার জন্যই তৈরি হয়ে বড় হয়।

এরা যথার্থই গ্লোবায়িত। এদের মধ্যে অল্পসংখ্যক যারা ইতিহাস অধ্যয়ন করতে আসে, তাদের ইতিহাসবোধ যেন আসলেই গ্লোবাল। তাদের লেখা পড়ে বা কথা শুনে মনে হয় তারা যেন ভাবে যে পশ্চিমের বর্ণবিদ্বেষ ও ভারতের ইতিহাসে জাতপাতের অত্যাচার আদতেই এক, লিঙ্গভিত্তিক বা শ্রেণিভিত্তিক লড়াই তো এক বটেই। ফলে এরা বিদেশি জীবনে মিশে যায় সেই শঙ্খ ঘোষের ভাষায় ‘যেমন সহজেই চৈত্র মেশে বৈশাখে’।

রণজিৎদা-তপনদাদের প্রজন্ম ছিল আজকের সময়ের চেয়ে চরিত্রগতভাবে ভিন্ন এক ঐতিহাসিক সময়ের ফসল, যখন প্রবাসী এইসব মানুষের কর্মক্ষেত্র বিদেশে হলেও এঁদের মন বিদেশের সকল সুবিধা সারা জীবন ভোগ করেও বিদেশকে সম্পূর্ণভাবে আপনার গণ্য করত না। পশ্চিমি জীবনের সুযোগ-সুবিধার আকর্ষণ এঁরা স্বীকার করতেন, কিন্তু মনের মধ্যে থাকত একটা স্মৃতিকাতরতা। কেমন একটা ‘সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে’ ধরনের অনুভব। রণজিৎদার ইংরেজি রচনাসম্ভারের একটি অংশের নামই সম্পাদক দিয়েছেন ‘একজাইল’।

এখনো মনে পড়ে আমার ডক্টরেট ডিগ্রির সময়ের কথা। আমি তখন ডক্টরেট করে কোথায় চাকরি করব, এই প্রসঙ্গে রণজিৎদার সঙ্গে কথা হতো। যখন কথায় কথায় এটা পরিষ্কার হয়ে যেত আমি পশ্চিমে কোথাওই চাকরি খুঁজছি, রণজিৎদা যেন আমাদের দুজনের জীবনের দিকে তাকিয়েই কিছুটা স্নেহ, দুঃখ ও আপাতভাবে অপরিশীলিত ভাষা মিশিয়ে আমাকে উদ্দেশ করে একটু আত্মগত স্বরে বলতেন, ‘বাবা, পাকা পায়...নায় হা...র স্বাদ পেয়েছ, এখন কি আর খাটা পায়..নায় হা...তে ভালো লাগবে?’ মনে হতো কথাটা যেন নিজেকেও বলছেন।

রণজিৎদার এই স্মৃতিমুখীনতা তাঁর বিদেশে বসে ইংরেজি রচনার গোড়ার থেকেই। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত তাঁর এ ‘রুল অব প্রপার্টি ফর বেঙ্গল’-এর বিষয় ছিল ১৭৯৩-এর বাংলার রাজস্ব-ব্যবস্থার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। ভূমিকার প্রথম অনুচ্ছেদটিই কিন্তু এই ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর ছেলেবেলার সম্পর্ক নিয়ে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-প্রসূত জমিদারি ব্যবস্থার ছায়ায় যে তিনি বড় হয়েছিলেন, সেই স্মৃতিই তাঁর এই ইতিহাস-জিজ্ঞাসার উৎপত্তিস্থল। প্রায় বিশ বছর বাদে বইটির যখন একটি দেশি সংস্করণ প্রকাশিত হয়, রণজিৎদার কলমের কণ্ঠে প্রথমেই তখন সেই দেশে ফেরার সুর: ‘ইট ইজ গুড টু সি দিস হাম্বল এসে কাম হোম।’

বহু পরে রচিত ও তাঁর বাংলা রচনাসংগ্রহে অন্তর্ভুক্ত ‘কৈফিয়ত’ নামক লেখাটি পড়লে বুঝতে পারবেন যে সেই জমিদারি ব্যবস্থা, তালুকদার বাড়িতে বড় হওয়া, ছোট জাতের প্রজাবাড়ির সমবয়সী ছেলেদের সঙ্গে একসঙ্গে খেলাধুলা করার অভিজ্ঞতা—‘ভাবে ভালোবাসায়, ঝগড়াঝাঁটি মারামারিতে, সাঁতারে বা দাড়িয়াবান্ধা খেলার প্রতিযোগিতায়, কিংবা সাপের ভয়, হাত-পা ভাঙার ভয় ও সবচেয়ে বাস্তব যে বড়দের ভয়—এই ত্রিবিধ ভয় অগ্রাহ্য করে নানা নিষিদ্ধ এলাকায় যৌথ অভিযানে আমাদের মধ্যে জাতপাতের ধনীনির্ধনের বিচার নেই তখন’—এবং ‘ঘোর সাম্যবাদী শৈশবের সেই শিশুরাজ্য’ ভেঙে যাওয়ার দুঃখ ও ক্ষোভের ছাঁচে কীভাবে আকৃতি পেয়েছে তাঁর পরবর্তী কালের নানান গবেষণাপ্রকল্প ও ইতিহাসবোধ।

লিখেছেন যে একটি কথা তিনি কোনো দিন বলতে শেখেননি, ‘প্রজা’; কারণ কথাটি বলতে শেখার আগেই এগারো বছর বয়সে তাঁকে পড়াশোনা করতে কলকাতা পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যেখানে গিয়ে তিনি কম্যুনিস্ট হয়ে ওঠেন ও জমিদারি প্রথাকে সমালোচনার চোখে দেখতে শেখেন। কিন্তু এ-ও লিখেছেন যে ‘কোনওদিনই আমি...[“প্রজা” শব্দটি] ভুলতে পারব না। আদিম পাপবোধের মতো তা সারা জীবনই আমার চিন্তার সহচর হয়ে থাকবে’।

১৯৮৩ সালে তাঁর কৃষক-বিদ্রোহবিষয়ক বিখ্যাত বইটি ছাপা হয়। আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম উনিশ শতকে ভারতীয় কৃষকের ওপরে অত্যাচার ও নিষ্ঠুরতার যে বর্ণনা তিনি দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে দিয়েছেন, তার ভিত্তি কি শুধু মহাফেজখানা থেকে আহরিত জ্ঞানে? তিনি বললেন, ‘না, কৃষকের সঙ্গে, দরিদ্র প্রজার সঙ্গে এই দুর্ব্যবহার আমি চোখে দেখেছি।’ এ কথা রণজিৎদা পরে নানান সাক্ষাৎকারেও বলেছেন।

রণজিৎদার কথা শুনে আমার তৎক্ষণাৎ মনে হয়েছিল, ঠিকই তো, গরিব নিঃসহায় মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও অত্যাচার আমিও তো নিত্য দেখেছি কলকাতায় কাটানো আমার জীবনের প্রথম সাতাশ বছরে। তাহলে আমাদের নিম্নবর্গের ইতিহাস-সাধনার মূলে কি ছিল এই স্মৃতি? আরও বড় প্রশ্ন, এই গ্লোবাল দুনিয়ায় প্রবাসী জীবনযাপন করেন অথচ বর্তমানের গ্লোবায়িত সচ্ছল শৈশবে বড় হননি, ভারতীয় উপমহাদেশের এমন যাঁরা ঐতিহাসিক, তাঁদের জন্য কি সব সময়ে স্মৃতিই হবে ঐতিহাসিক দলিলের সম্পূরক? কেন?

এই প্রশ্নের জবাব দিয়ে এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে ইতি টানি। সমস্যাটা এই যে আমরা যারা দেশে দিশিভাবে বড় হয়েছি—অর্থাৎ হাইস্কুল বা কলেজ থেকেই পশ্চিমের দিকে পা না-বাড়িয়ে বড় হয়েছি—তারা মনুষ্য-সম্পর্ককে তার সবচেয়ে ঘনত্বে ও বৈচিত্র্যে অভিজ্ঞতা করেছি দেশেই। একবার পশ্চিমে এসে পড়লে এবং এখানেই শিক্ষকতা, গবেষণা ইত্যাদি করলে আমরা ইউনিভার্সিটি নামক প্রতিষ্ঠানটির পেশাদারি জীবনে সেঁধিয়ে যাওয়া জীব হয়ে যাই।

সেই জীবনে কোনো ভালো দিক নেই বা চিন্তার প্রভূত খোরাক নেই, এ কথা অবশ্যই বলি না—একটি ভালো লাইব্রেরির বা ভালো ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর আকর্ষণ কে অস্বীকার করবে? এবং নিজের চোখে ও অভিজ্ঞতায় যা দেখি, এখানে পড়তে ও পড়াতে এসে যে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে অনেকেই দেশের নানাবিধ অত্যাচার থেকে একটা মুক্তির স্বাদ পান, তা–ও তো অনস্বীকার্য। পশ্চিমে তাঁদের একধরনের বিকাশ হয়, এ কথা অবশ্যই মানি।

কিন্তু দীর্ঘ জীবনে মুশকিল হয় এই যে বিশ্বজুড়ে দেখাশোনা, ওঠাবসা যাঁদের সঙ্গে, তাঁরা সব আমারই মতো, কেবল বাড়িঘর-সেমিনার রুম আলাদা! এখানে হয়তো একটা শিক্ষার এলিটিজমের কথা ওঠে। রণজিৎদার মতো মানুষেরা ইতিহাসের একটি ক্ল্যাসিক ধারণা নিয়ে বাঁচতেন, যেখানে ইতিহাস যথার্থই মানবিকীবিদ্যা, নিছক সমাজবিজ্ঞান নয়।

এখন সার্থক ইতিহাস রচনা যে সাহিত্যের নানান রসের স্বাদে জারিত হতে পারে—আইরনি, ট্র্যাজেডি, কমেডি, হেরোইক ইত্যাদি (পাঠক মার্জনা করবেন, কথাগুলো ইংরেজিতে বললাম)—তার উৎপত্তি তো নিশ্চয়ই এই সত্যে যে জীবনের ঘনত্ব আর বৈচিত্র্যকে কোনো দিনও কোনো বিশেষ সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্বের বা দার্শনিক সূত্রের দড়িতে খুব জোরে একটা টান মেরে বেঁধে ফেলা যায় না।

অথচ পাশ্চাত্যে রণজিৎদাদের মতো মানুষেরা এই জীবনঘন অস্তিত্বের স্বাদ সামাজিকভাবে বিশেষ পেতেন না। তাই ফিরতে হয় স্মৃতিতে, সাহিত্যে, গাথায় ও কাব্যে—পরিচিত, একান্ত নিজস্ব ভাষার মারফত। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত লাইনগুলিই আবার মনে পড়ে: ‘কিন্তু তোমার তালছড়িটা—/ মেঘে মেদুর সেই যে বক্ষে বাস্তুভিটা/ যেখান থেকে বাকি জীবন করবে শুরু বলেই এলে—/ সেইখানে আজ অভয় পেলে’। তা না হলে আবার শক্তিরই ভাষায় বলি, ‘এই বিদেশে সবই মানায়’।

  • দীপেশ চক্রবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের লরেন্স এ কিম্পটন ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস প্রফেসর।