বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী

বাড়ছে আগ্রহী দল, আসন বণ্টনে জটিলতায় জামায়াত

সমমনা দলগুলোর সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর আসন সমঝোতা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এর মধ্যেই নতুন করে আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে দলটি। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ও বাংলাদেশ লেবার পার্টির সঙ্গে এ আলোচনা চলছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

এই দলগুলোর মধ্যে এনসিপি গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আত্মপ্রকাশ করা একটি দল। আর এলডিপি, জেএসডি ও লেবার পার্টি এত দিন বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক ছিল। তবে বিএনপির সঙ্গে বোঝাপড়ায় ছেদ পড়ায় দলগুলো নতুন রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে যাচ্ছে।

রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, সমমনা দলগুলোর সঙ্গে জামায়াতের আসন সমঝোতা চূড়ান্ত না হওয়ায় নতুন করে আরও দল যুক্ত হওয়ার আলোচনা জামায়াতসহ আট দলের ভেতরে টানাপোড়েন তৈরি করেছে। কোন দলকে কতটি আসন ছাড় দেওয়া হবে, তা নিয়েই মূলত সংকট দেখা দিয়েছে।

তবে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আসন সমঝোতা নিয়ে বড় কোনো সংকট নেই। কেউ জোট ভাঙতে চায় না। আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান আসবে।

গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে জামায়াতের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস,বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)—এই ছয়টি দল আসন সমঝোতার ভিত্তিতে সব আসনে একক প্রার্থী দেওয়ার আলোচনা শুরু করে। পরে এতে যোগ দেয় বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি। জামায়াতসহ এই আটটি দল বিভিন্ন দাবিতে অভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে টানা অনেক দিন মাঠে ছিল।

সমমনা দলগুলোর সঙ্গে জামায়াতের আসন সমঝোতা চূড়ান্ত না হওয়ায় নতুন করে আরও দল যুক্ত হওয়ার আলোচনা জামায়াতসহ আট দলের ভেতরে টানাপোড়েন তৈরি করেছে। কোন দলকে কতটি আসন ছাড় দেওয়া হবে, তা নিয়েই মূলত সংকট দেখা দিয়েছে।

শুরুতে এই আট দলের মধ্যে একটি প্রাথমিক বোঝাপড়া তৈরি হয়। আসন সমঝোতার আলোচনাও ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল। একপর্যায়ে কোন আসনে কাকে ছাড় দেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করতে প্রতিটি দল নিজ নিজভাবে অভ্যন্তরীণ জরিপও চালায়।

তবে পরে সংকট তৈরি হয়। কোনো কোনো আসনে ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিসসহ অন্য দলগুলো নিজেদের প্রার্থীদের জামায়াতের প্রার্থীর মতোই যোগ্য বলে দাবি করে। এসব আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করতে আট দলের পক্ষ থেকে নিরপেক্ষ একটি প্রতিনিধিদল পাঠানোর কথাও ওঠে। ওই প্রতিনিধিদল জরিপের ফল ও স্থানীয় মতামতের ভিত্তিতে একজনকে চূড়ান্ত প্রার্থী করার কথা ছিল। কিন্তু সে আলোচনা খুব বেশি এগোয়নি।

এরই মধ্যে এনসিপির সঙ্গে জামায়াতের আসন সমঝোতার আলোচনা প্রকাশ্যে আসে। জামায়াত এ বিষয়ে কথা বললেও এনসিপির নেতারা প্রকাশ্যে কিছু বলেননি।

এনসিপির সঙ্গে এই আলাপ সামনে আসার পর নতুন করে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে বলে আট দলভুক্ত কয়েকটি দল মনে করছে। কারণ, এনসিপির চাহিদা অনুযায়ী আসন ছাড় দেওয়া সম্ভব হবে কি না, তা নিয়েও সংশয় আছে। পাশাপাশি এনসিপির সঙ্গে অতীত অভিজ্ঞতা নিয়েও নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে আট দলভুক্ত কয়েকটি দল। এমন একটি দলের কেন্দ্রীয় নেতা প্রথম আলোকে বলেন, সমমনা দলগুলো যখন অভিন্ন কর্মসূচিতে আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন বৈঠক হয়েছিল এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের বাসায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এনসিপি আট দলের আন্দোলনে না থাকার ঘোষণা দেয়। এ কারণেই অন্য দলগুলোর মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি তৈরি হয়েছে।

তবে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এনসিপি থাকার বিষয়টি নিয়ে নতুন কোনো সংকট তৈরি হয়নি; বরং দীর্ঘ সময়েও আলোচনা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে না পৌঁছানোয় ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, ধারণার চেয়ে বেশি আসনে অনেক দল প্রার্থী দিতে চাইছে। ৩০০ আসনে সমঝোতার ভিত্তিতে একক প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। শেষ পর্যন্ত সম্ভব না হলে কোনো কোনো আসন উন্মুক্ত রাখা হতে পারে।

সমমনা আট দলের শীর্ষস্থানীয় এক নেতা বলেন, আলোচনার একটা পর্যায়ে এসে কেউ কেউ অতিরিক্ত আসনের দাবি তুলছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, জোটের পরিধি বাড়লে সবাইকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা রাখতে হবে।

খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, আসন সমঝোতা নিয়ে টানাপোড়েন থাকলেও কেউ জোট ছাড়তে চায় না। দলের সংখ্যা বাড়লেও আন্তরিকতার কারণে বড় সংকট হবে না বলেই তিনি মনে করেন।

আলোচনায় এলডিপি, লেবার পার্টি, জেএসডি

জামায়াত সূত্র জানিয়েছে, এনসিপি ছাড়াও এলডিপি ও লেবার পার্টিসহ আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে তাদের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে। সমমনা দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্বে আছেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মানসিকতার সংকট ছাড়া আর কোনো সংকট নেই। এখানে শুধু আসন সমঝোতা নয়, রাজনৈতিক সমঝোতাও প্রয়োজন।

আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জেএসডির দিক থেকেও আসন সমঝোতার লক্ষ্যে জামায়াতের সঙ্গে আলোচনার আগ্রহ দেখানো হয়েছে বলে জামায়াত-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র থেকে জানা গেছে।

দীর্ঘদিন বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা জেএসডি গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, তারা এককভাবে ভোট করবে। মূলত লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে জেএসডির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি তানিয়া রব প্রার্থী হতে চান। কিন্তু এ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে দলটির সমঝোতা হয়নি।

এরপর জেএসডির শীর্ষস্থানীয় একটা পর্যায় থেকে জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় বলেও জানা গেছে। তবে জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হলেও জামায়াতের সঙ্গে যাওয়ার বিষয়ে তাঁদের এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

এর আগে ২৪ ডিসেম্বর অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন এলডিপি বিএনপির সঙ্গ ছাড়ার ঘোষণা দেয়। তাঁর সঙ্গেও বিএনপির সমঝোতা হয়নি। তাঁর দলের মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন। তিনি ধানের শীষ প্রতীকে ভোট করবেন, সেই নিশ্চয়তা পেয়েছেন।

আসন সমঝোতা না হওয়ায় লেবার পার্টি বিএনপির সঙ্গে ২০ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। দলটি জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করছে বলেও আলোচনা আছে। লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, জামায়াতের সঙ্গে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। তবে জামায়াতসহ সমমনা অন্য দলগুলো এলডিপির কর্নেল অলির মতো লেবার পার্টিকেও পাশে চায়।

এনসিপি ও জামায়াতের মধ্যে আলোচনা চললেও দলটি বিএনপির সঙ্গেও যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। এবি পার্টিও সমঝোতার আলোচনায় আছে।

দুই দিকেই আলোচনা করছে এনসিপি ও এবি পার্টি

এনসিপি ও জামায়াতের মধ্যে আলোচনা চললেও দলটি বিএনপির সঙ্গেও যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। এবি পার্টিও সমঝোতার আলোচনায় আছে।

যদিও ৭ ডিসেম্বর এনসিপি, এবি পার্টি ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন মিলে গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট নামে নতুন জোট করেছে। এখন জামায়াতের সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে আলোচনার কারণে এই জোটে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। গতকাল রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি হাসনাত কাইয়ূম সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, সমঝোতার আলোচনার খবরটি যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে এনসিপি ও এবি পার্টি জোটের আকাঙ্ক্ষা মানছে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি এবং জামায়াত দুই দলের সঙ্গেই একধরনের আলোচনা চলছে। এনসিপি যদি জোটগতভাবে শেষ পর্যন্ত জামায়াতের সঙ্গে আসন সমঝোতার প্রস্তাব করে, তখন দলীয় ফোরামে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে এবি পার্টি। এ ক্ষেত্রে হয় জোট ভেঙে দিতে হবে, না হয় বৃহত্তর স্বার্থে সবকিছু মেনে নিতে হবে।