‘আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে’ বলে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আর ডিসেম্বরের মধ্যেই যাতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তার প্রস্তুতি নিতে তিনি নতুন প্রজন্মসহ দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বুধবার রাজধানীর নয়াপল্টনে এক জনাকীর্ণ সমাবেশে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়ে তারেক রহমান কথা বলেন।
‘তারুণ্যের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সমাবেশ’ শীর্ষক এই সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি লন্ডন থেকে সমাবেশে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হন।
সমাবেশে তারেক রহমান বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবেই। আবারও আমরা বলতে চাই, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’ নতুন প্রজন্মসহ দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন যাতে অনুষ্ঠিত হয়, তার প্রস্তুতি নিতে শুরু করুন। কারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে, কারা আপনাদের প্রতিনিধি হবে, জাতীয় নির্বাচনে আপনারা ভোট দিয়ে আপনাদের সেই প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করবেন।’
তারুণ্যের এই সমাবেশ ঘিরে ঢাকায় লাখো মানুষের জমায়েত হয়। এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যানজট ও জনদুর্ভোগে রাজধানী ঢাকার বড় একটি অংশ রীতিমতো অচল হয়ে পড়ে। বিএনপির তিন সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের উদ্যোগে এই সমাবেশ হয়।
বেলা দুইটায় সমাবেশ শুরুর কথা থাকলেও ১১টা থেকেই নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নেতা–কর্মীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে জমায়েত হতে থাকেন। ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা-কর্মীরা সবুজ, হলুদ ও লাল রঙের ক্যাপ ও টি-শার্ট পরে সমাবেশে যোগ দেন। এ সময় নেতা-কর্মীদের হাতে শোভা পাচ্ছিল বিএনপির দলীয় পতাকা এবং দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ছবিসংবলিত প্ল্যাকার্ড।
সমাবেশ শুরু হয় বেলা দুইটার কিছু আগে। তখন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে নয়াপল্টন ও আশপাশের এলাকা। এ সময় ওই এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। একপর্যায়ে কাকরাইল, দৈনিক বাংলা, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল, পল্টন এবং নটর ডেম কলেজসংলগ্ন সড়কেও নেতা-কর্মীরা ছড়িয়ে পড়েন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সমাবেশ শুরু হয়। পরে বক্তব্য দেন নেতারা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ‘তারুণ্যের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সমাবেশ’ নামে এই কর্মসূচি করা হলেও কার্যত এর মধ্য দিয়ে সরকারের ওপর রাজনৈতিক চাপ তৈরি দলটির অন্যতম লক্ষ্য। সমাবেশে প্রধান অতিথিসহ সব বক্তাই নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের সমালোচনা করেন।
বিকেল সাড়ে পাঁচটায় তারেক রহমান বক্তব্য শুরু করেন। তিনি ২৫ মিনিট বক্তব্য দেন। নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা শুরু হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে মনে হয় এরই ভেতরে টালবাহানা শুরু হয়েছে বা চলছে। কথিত অল্প সংস্কার আর বেশি সংস্কারের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচনের ভবিষ্যৎ। এরই ভেতরে জনগণ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, সংস্কার নিয়ে সময়ক্ষেপণের আড়ালে অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে এবং বাইরে কারও কারও মনে হয় ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে।’
গত দেড় দশকে ভোটার তালিকায় প্রায় সাড়ে তিন কোটি নতুন ভোটার সংযুক্ত হয়েছেন উল্লেখ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘এই নতুন ভোটাররা আজ পর্যন্ত একটা জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার সুযোগ পায়নি। পতিত পরাজিত পলাতক স্বৈরাচারের কাছে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা কিংবা নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। সুতরাং সংস্কার ইস্যুর পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের দৃশ্যমান প্রস্তুতি নেওয়া উচিত বলে মনে করি।’
অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা তুলে ধরে তারেক রহমান বলেন, ‘প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে দেখেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাসের মধ্যেই সফলভাবে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছে। সুতরাং অতীতে এই বাংলাদেশে রেকর্ড রয়েছে, তিন মাসের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা সম্ভব। কিন্তু আজ আমরা দেখছি, ১০ মাস পার হয়ে গেলেও অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করছে না। আমরা ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে জনগণের ভোটে জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক, জনগণের কাছে দায়বদ্ধ একটি সরকার দ্রুত দেখতে চাই।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেনকে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেওয়া নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, পলাতক স্বৈরাচারের পরে যেই সরকারের কাছে দেশের মানুষ আশা করেছিল যে আইনের প্রতি সম্মান থাকবে, আমরা দেখেছি আদালতের রায়ের প্রতি সম্মান না দেখিয়ে যারা ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করেছে, স্বৈরাচারের সেই একই যে ঘটনা, সেটির পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে পাচ্ছি।’
‘যারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখায় না, যারা আদালতের নির্দেশকে অবজ্ঞা করে, তাদের কাছ থেকে কতটুকু সংস্কার আশা করতে পারি’—এমন প্রশ্ন তোলেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘পুঁথিগত সংস্কারের চেয়ে ব্যক্তিমানসিকতার সংস্কার অনেক বেশি জরুরি।’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘গণতন্ত্রকামী জনগণ এবং গণতন্ত্রের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোকে দয়া করে প্রতিপক্ষ বানাবেন না। যদি আপনাদের কেউ রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকতে চায়, তাহলে সরকার থেকে পদত্যাগ করে জনগণের কাতারে আসুন। নির্বাচন করুন। যদি ভবিষ্যতে নির্বাচনে জনগণের রায় পান, তাহলে আবার সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করুন।’
তারেক রহমান আগামীতে বিএনপি সরকার গঠন করতে পারলে তরুণদের জন্য নানা কর্মসূচি নেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেন।
নির্বাচনকে বিলম্বিত করার জন্য পতিত স্বৈরাচার দেশে-বিদেশে নানা ষড়যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, তা না হলে সংস্কার এবং মামলা—দুটি বিষয়কে নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করার কোনো অর্থ হয় না। সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন—এই তিনটি আলাদা বিষয়। বিএনপি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এলে সংস্কার এবং মামলার বিচার গুরুত্বের সঙ্গে করবে। সে জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বিলম্বিত করার কোনো যুক্তি নেই।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি ইঙ্গিত করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, এই সরকারের মাথা থেকে নিচ পর্যন্ত পচে গেছে। এই সরকার যদি এভাবে চালায় আরও, আওয়ামী লীগ যা ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে।
নির্বাচিত সরকারের হাতে দেশ নিরাপদ থাকবে উল্লেখ করে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘সরকার বলছে সংস্কার করে নির্বাচন দেবে। কিন্তু গত ৯ মাসে সরকার কিছুই করতে পারেনি। তারা আগামী ৯ বছরেও কিছু করতে পারবে না।’
নির্বাচন নিয়ে হেলাফেলা করা চলবে না বলে হুঁশিয়ারি জানান স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, এ দেশের লাখ লাখ তরুণ যেভাবে আজ উপস্থিত হয়েছেন, তাঁরা একটি বার্তা দিচ্ছেন। গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের পথ হচ্ছে নির্বাচন। তিনি আরও বলেন, সংস্কারের কথা বলে নির্বাচনকে দীর্ঘায়িত করার কোনো সুযোগ নেই। বিচারের কথা বলে নির্বাচনের রোডম্যাপ পেছানোর কোনো সুযোগ নেই।
সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপের ফলাফল নিয়ে আমীর খসরু বলেন, এখন বলা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ে নাকি ঐকমত্য হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে ঐকমত্য না হয়ে থাকলে সেটা করবে জনগণ। ভোট ও ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার সেই সংস্কার করবে।
সমাবেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ ভাবনার আলোচনা নিয়ে কথা বলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘আমরা ডিসেম্বরে নির্বাচনের জন্য রোডম্যাপ চেয়েছিলাম। আমরা কারও পদত্যাগ চাইনি। পদত্যাগের নাটক দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ। গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য কথা বলা যদি অপরাধ হয়, সেই অপরাধ আমরা বারবার করতে পারব।’
সালাহউদ্দিন আহমদ দাবি করেন, ‘প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কখনো আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র বোঝেনি, স্বৈরাচার কায়েম করেছে। কিন্তু আমরা যারা গণতন্ত্রের পক্ষে সংগ্রাম করেছি, তারা নাকি কোনো কোনো দেশের এজেন্ট হয়ে গেছি। এগুলো কারা করছে, সেটি আমরা বুঝতে পারি। এ দেশে পরস্পরের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে এদের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ ফিরে আসতে চায়।’
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম হুঁশিয়ারি জানিয়ে বলেছেন, ‘ছাত্রদলের ধৈর্যের পরীক্ষা নেবেন না, ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে কাউকে শান্তিতে থাকতে দেব না।’
ইসলামী ছাত্রশিবিরের নাম উল্লেখ করে রাকিবুল ইসলাম বলেন, সরকারি তিতুমীর কলেজে ‘গুপ্ত সংগঠনের’ ৮ থেকে ১০ জন মিলে অধ্যক্ষের কক্ষে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) ছাত্রদলের কর্মীদের ওপর হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করা হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাম ধারার ছাত্রসংগঠনের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। তিনি এর তীব্র নিন্দা জানান।
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান প্রমুখ। যুবদলের সভাপতি আবদুল মোনায়েমের সভাপতিত্বে সমাবেশ সঞ্চালনা করেন স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান, ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন।
ভোটের আগে তরুণদের কাছে টানার লক্ষ্য নিয়ে মে মাসজুড়ে কর্মসূচি করে বিএনপির তিন সংগঠন—জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে চারটি বড় বিভাগ ও শহরে দুই দিন করে মোট আট দিন সেমিনার ও সমাবেশ।
চট্টগ্রাম, খুলনা ও বগুড়ার পর গতকাল রাজধানীতে ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট ও ঢাকা বিভাগ মিলে এ সমাবেশ হয়। তবে চার বিভাগের সমাবেশ হলেও অন্যান্য বিভাগের নেতা-কর্মীদের মিছিল ও ব্যানার নিয়ে উপস্থিত হতে দেখা যায়। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশের পর এটি রাজধানীতে বিএনপির দ্বিতীয় বৃহত্তম সমাবেশ বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।