‘রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর যেভাবে হতে পারে’ শীর্ষক গোলটেবিলে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। সোমবার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে
‘রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর যেভাবে হতে পারে’ শীর্ষক গোলটেবিলে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। সোমবার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে

অধ্যাপক ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা থাকাকালে তাঁর ‘থ্রি জিরো’ তত্ত্বের উল্টো যাত্রা ঘটল: অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ‘থ্রি জিরো’ (তিন শূন্য) তত্ত্ব সমর্থন করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। কিন্তু অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে তার উল্টো যাত্রা হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তিনি থাকা অবস্থায় তাঁর থ্রি জিরো তত্ত্বের যে উল্টো যাত্রাটা ঘটল, এটা তাঁর খেয়াল করা দরকার। আমরা চাই, থ্রি জিরো তত্ত্বটাই অগ্রসর হোক।’

সোমবার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে এক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে আনু মুহাম্মদ এ কথা বলেন। ‘রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর যেভাবে হতে পারে’ শিরোনামে যৌথভাবে এ বৈঠকের আয়োজন করে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ও প্রথম আলো।

বৈঠকে অর্থনীতির অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের “থ্রি জিরো” (তিন শূন্য) তত্ত্ব সারা পৃথিবীতে পরিচিত। আমি এটা খুবই সমর্থন করি যে শূন্য কার্বন নিঃসরণ, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য দারিদ্র্য। কিন্তু পুরো যাত্রাটা তো হচ্ছে উল্টো দিকে। অধ্যাপক ইউনূসের একটা সুযোগ ছিল যে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে থ্রি জিরো তত্ত্বের বাস্তবায়নের একটা মডেল হিসেবে বাংলাদেশকে দাঁড় করানোর কিছু চেষ্টা করা। কিন্তু আমরা দেখছি, কীভাবে কার্বন নিঃসরণ আরও বাড়ে, সেটার একটা চেষ্টা চলছে। গত ১০ মাসে লক্ষাধিক বেকারত্ব বেড়েছে শুধু কারখানা বন্ধ করার কারণে আর দারিদ্র্য বেড়েছে ২৫ থেকে ৩০ লাখ। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তিনি থাকা অবস্থায় তাঁর থ্রি জিরো তত্ত্বের যে উল্টো যাত্রাটা ঘটল, এটা তো তাঁর একটু খেয়াল করা দরকার। এতে তো আমরা খুশি না। আমরা তো চাই যে থ্রি জিরো তত্ত্বটাই অগ্রসর হোক।’

‘রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর যেভাবে হতে পারে’ শীর্ষক গোলটেবিলে আলোচকদের একাংশ। সোমবার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে

আনু মুহাম্মদ বলেন, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কিছু পরিবর্তনের চিন্তা আনা দরকার যে রাজনৈতিক দলগুলোর কী ধরনের বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত, কী কী শর্ত তাদের পূরণ করা উচিত। এটা নিয়ে কথা বলা দরকার এবং সমাজে এর পক্ষে একটা জনমত দাঁড় করানো দরকার। এ প্রসঙ্গে তিনটি প্রস্তাব তুলে ধরেন তিনি। সেগুলো হলো—জাতীয় রাজনৈতিক দল হতে হলে সেই দলে অবশ্যই দেশের সব জনগোষ্ঠী, ধর্ম-জাতি ও লিঙ্গের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে; দলের সব পর্যায়ে নির্বাচনের প্রক্রিয়া থাকতে হবে এবং নেতা-নেত্রীদের রাজনীতি থেকে অবসরের বয়সসীমা নির্দিষ্ট করা দরকার।

এখন অনলাইনে যেভাবে ব্যক্তি আক্রমণ হয়, সে প্রসঙ্গে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘আক্রমণটা এই মাত্রায় হয় যে আসলে কারও পক্ষে টিকে থাকাই মুশকিল। এটাকে অগ্রাহ্য করে নিজের মত প্রকাশ করা বা সক্রিয়তা বজায় রাখা খুব কঠিন। এটা এখন অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এটার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের লোকজন তো আছেই। তারা তো একধরনের আক্রমণ করছে। এরপর অন্য যে দলগুলো আছে নতুন ও পুরোনো, ইসলামি ও অ-ইসলামি—কোনো দলকে বলা যায় না যে এই দল এই জিনিসগুলো করছে না। বড় বড় যে কয়টা দল আছে, তারা প্রত্যেকেই তাদের সঙ্গে দ্বিমত হলেই, তাদের মতের সঙ্গে না মিললেই তাদের একটা বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে।’

‘বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির জবাবদিহি দরকার’

মুক্তবাজার অর্থনীতি বলে কিছু আছে বলে মনে করেন না আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, আসলে একটা মিথ (রূপকথা) তৈরি করা হয়েছে। আসলে এটা হচ্ছে অলিগোপলি অর্থনীতি, কতিপয় গোষ্ঠীনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি। এই অর্থনীতির নব্য উদারতাবাদী অর্থনৈতিক নীতির কড়া সমালোচনা করেন তিনি।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নীতি দেশের কোনো সরকার নির্ধারণ করে না বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রকল্প, নীতি ও চুক্তিগুলোর সঙ্গে জনগণের সংশ্লিষ্টতার প্রশ্নই নেই। এগুলো করে কিছু গোষ্ঠী এবং তার পেছনে আছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির মতো আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থা। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি কেন জবাবদিহির মধ্যে আসবে না? যাদের নীতি, পরামর্শ ও ঋণের বড় ধরনের আধিপত্যের মধ্য দিয়ে জনগণের অধিকার ক্রমান্বয়ে দূরে চলে যায় এবং যারা স্বৈরতন্ত্রকে সব সময় সমর্থন, পৃষ্ঠপোষকতা ও বিভিন্নভাবে পুষ্টির জোগান দিয়েছে, তাদের জবাবদিহি কীভাবে হবে, এ প্রশ্নটা আলোচনার মধ্যে না আনলে কোনো কাজ হবে না।’

‘এ দুই পক্ষের মধ্যে জাতীয় ঐক্য কীভাবে সম্ভব’

গোলটেবিল বৈঠকে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, কোন পথে গণতন্ত্র আসতে পারে, ‘সেটা নিয়ে এখন যে আলোচনা-বিতর্ক হচ্ছে, সেখানে মাঝেমধ্যে আমরা ডান, বাম, মধ্যপন্থী—এ কথাগুলো শুনি। সেক্যুলার, ইসলামপন্থী, ধর্মপন্থী—এই যে বিভিন্ন ধরনের বিভাজন, বাংলাদেশকে কে কীভাবে দেখবে কিংবা বাংলাদেশকে কে কোন দিকে নিয়ে যেতে চায়...। আমরা খুব সহজভাবে বিষয়টা দেখতে পারি। এই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের একটা স্বপ্ন বা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। বৈষম্যের জায়গাগুলোকে অ্যাড্রেস না করে কি গণতন্ত্রের পথে যাওয়া সম্ভব? বৈষম্যহীন পথে যাওয়ার পথ ও পদ্ধতির সঙ্গে একমত হয়ে যারা কাজ করতে চেষ্টা করবে, তারাই হচ্ছে গণতান্ত্রিক শক্তি।’

আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘কেউ যদি বলে যে আমি নারী–পুরুষ বা লিঙ্গবৈষম্য রাখতে চাই, এ বৈষম্যটাই আমার মতাদর্শ, তাকে কি গণতান্ত্রিক শক্তি বলা যায়? কিংবা কেউ যদি বলে যে অন্য জাতি যা আছে, তা আমি স্বীকার করি না, তাকে কি আমরা বলতে পারি গণতান্ত্রিক শক্তি? কেউ যদি বলে এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ যারা, তাদের শাসনই চলবে, তাকে কি গণতান্ত্রিক শক্তি বলা যাবে? তাহলে বৈষম্যবাদী এবং বৈষম্যহীন রাজনীতি বা মতাদর্শ নিয়ে যারা কাজ করে, এ দুই পক্ষের মধ্যে জাতীয় ঐক্য কীভাবে সম্ভব? তাদের নিয়ে গণতন্ত্রের পথে আপনি কীভাবে যাবেন? দুজন দুই দিকে যাচ্ছে। এখানে তো বড় ধরনের একটা মৌলিক পার্থক্য। আমাদের যেটা চেষ্টা থাকতে হবে, গণতান্ত্রিক শক্তির সম্প্রসারণ।’

আশির দশকে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ বলেন, সেই লড়াইয়ের মধ্যে যে ঐক্যবদ্ধ সংঘটিত শক্তি তৈরি হয়েছিল, সেটা পরবর্তীকালে কিন্তু আর থাকেনি। নব্বই সালে নির্বাচিত সরকার আসার পর এই সংগঠিত শক্তির মধ্যে একটা বড় ধরনের ভাঙন তৈরি হলো। এই ভাঙনটা এত বহুধা ভাগে বিভক্ত হয়েছে যে সংগঠিত শক্তির উল্টো যাত্রা হয়েছে। স্বৈরতন্ত্রের সময়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিন্তু নির্বাচিত সরকার শুরু হওয়ার পরে আর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি।

এখানে যে রাজনৈতিক দলগুলো নেতৃত্ব দিচ্ছে, তারা নিজেরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করা বা সেটাকে আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ করার প্রধান একটা প্রতিবন্ধক হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় বলে মন্তব্য করেন আনু মুহাম্মদ।