
বলা হয়ে থাকে, রবীন্দ্রনাথ নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু তিনি বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বড় উৎসব দুর্গাপূজা নিয়ে ভাবিত ছিলেন। তিনি মনে করতেন, একমাত্র উৎসবের দিনই একজনের গৃহ সবার গৃহ হয়। অতএব উৎসব সবার। এতে আকার–নিরাকারের ভেদ থাকবে কেন?
এই দিনে প্রাণের সঙ্গে প্রাণের দোলা হয়। ১৯০৩ সালের ২২ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথ বোলপুর থেকে কাদম্বরী দেবীকে চিঠিতে লেখেন, ‘সাকার–নিরাকার একটা কথার কথামাত্র। ঈশ্বর সাকার এবং নিরাকার দুই-ই। শুধু ঈশ্বর নন, আমরা প্রত্যেকে সাকার এবং নিরাকার। তাঁকে রূপে ও ভাবে, আকারে এবং নিরাকারে, কর্মে ও প্রেমে সব রকমেই ভজনা করতে হবে। আকার তো আমাদের রচনা নয়। এই আকার তাঁরই।’
কিন্তু মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর দুর্গাপূজার সময় প্রবাসে কাটাতেন। এ জন্য দুর্গাপূজা উপলক্ষে যাত্রা, গান ইত্যাদি যা কিছু হতো, তাতে পরিবারের অন্যরা মেতে থাকলেও দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী সরাসরি এসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন না। কিন্তু ষষ্ঠীর দিন ছেলেমেয়েদের, আত্মীয়স্বজনদের, কর্মচারী, ভৃত্য এমনকি ঝিদেরও নতুন জামাকাপড় দেওয়া হতো। দ্বারকানাথ অত্যন্ত দরাজ ছিলেন এবং প্রচুর খরচ করতেন। তিনি মোয়া, ক্ষীর ইত্যাদি মিশিয়ে বৃহদাকার মিঠাই তৈরি করাতেন এবং সবাইকে আপ্যায়ন করতেন।
আবার রবীন্দ্রনাথের মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর জানিয়েছেন, ‘দালানে গিয়ে সন্ধ্যার আরতি দেখতুম, ধূপধুনো–বাদ্যধ্বনির মধ্যে আমরা ঠাকুরকে প্রণাম করে আসতুম, এত বাহ্য–আড়ম্বরের মধ্যে এই যা ভিতরকার আধ্যাত্মিক জিনিস।’
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ কন্যা সৌদামিনী দেবী লিখেছেন, ‘আমাদের বাড়িতে যখন দুর্গোৎসব ছিল, ছেলেরা তখন বিজয়ার দিনে নতুন পোশাক পরে প্রতিমার সঙ্গে চলত। আমরা মেয়েরা তেতলার ছাদে উঠে প্রতিমা বিসর্জন দেখতাম।’
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে বিজয়ার রাতে শান্তিজল দান ও ছোট-বড় সবার মধ্যে কোলাকুলি খুব প্রিয় ছিল।
নিজেদের বাড়িতে হতো বিজয়া সম্মিলনী। অবনীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘বসত মস্ত জলসা। খাওয়াদাওয়া, তাতর পান, গোলাপজলের ছড়াছড়ি। ঝাড়বাতি জ্বলত। ওস্তাদ তানপুরা নিয়ে গানে গানে মাত করে দিতেন।’
ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মা দুর্গাকে খাঁটি সোনার গয়না দিয়ে সাজানো হতো। ভাসানের সময়ও তা খুলে নেওয়া হতো না। সালংকারা মা দুর্গাকে বিসর্জন দেওয়া হতো।’
তত্ত্ববোধিনী সভা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দশ বছর পরও ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপূজা আর জগদ্ধাত্রীপূজা অনুষ্ঠিত হতো। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ ভাই নগেন্দ্রনাথের মতে, ‘দুর্গোৎসব আমাদের সমাজবন্ধন, বন্ধুমিলন ও সবার সঙ্গে সদ্ভাব স্থাপনের একটি উৎকৃষ্ট ও প্রশস্ত উপায়। এর উপরে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। করলে সবার মনে আঘাত লাগবে।’
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোট কাকার ধারণায় প্রভাবিত ছিলেন বলে অনেকের ধারণা। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘অবর্ণনীয় দুঃখ আর অনির্বচনীয় আনন্দের ঠিক মাঝখানে বাঙালি চিরকাল দাঁড়িয়ে থাকে। জাতিগতভাবে এখানেই তার অনন্যতা, এখানেই তার অমরত্ব। এই কোজাগরী পূর্ণতার মধ্যেই সে তার মৃণ্ময়ী জননীর মুখ দেখাতে পায়। ক্ষুদ্রতায় ঘেরা তার গৃহকোণ তখন জীবনলীলা গৃহাঙ্গন হয়ে ওঠে। জগজ্জননী বসুন্ধরা হয়ে ওঠেন বিশ্বরূপা; ভয়ংকরী আদ্যাশক্তি রূপান্তরিত হন শুভঙ্করীতে। এই জীবনপ্রতিমা থেকে জন্ম নেয় তার প্রতিমা। মাতৃপূজা হয়ে ওঠে মুক্তির পূজা, মানুষের পূজা।’
রবীন্দ্রসাহিত্যে তাই দুর্গাপূজা অবলীলায় স্থান করে নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমাদের বাংলাদেশের এক কঠিন অন্তর্বেদনা আছে—মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো। অপ্রাপ্তবয়স্ক অনভিজ্ঞ মূঢ় কন্যাকে পরের ঘরে যাইতে হয়, সেই জন্য বাঙালি কন্যার মুখে সমস্ত বঙ্গদেশের একটি ব্যাকুল করুণ দৃষ্টি নিপতিত রহিয়াছে। সেই সকরুণ কাতর স্নেহ বারংবার শারদোৎসবে স্বর্গীয়তা লাভ করিয়াছে। আমাদের এই ঘরের স্নেহ, ঘরের দুঃখ, বাঙালির গৃহের এই চিরন্তন বেদনা হইতে অশ্রুজল আকর্ষণ করিয়া লইয়া বাঙালির হৃদয়ের মাঝখানে শারদোৎসব পল্লবে ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। ইহা বাঙালির অম্বিকাপূজা এবং বাঙালির কন্যাপূজাও বটে। আগমনী এবং বিজয়া বাংলার মাতৃহৃদয়ের গান।’
রবীন্দ্রনাথ দুর্গাপূজা ও দুর্গাপূজায় অংশগ্রহণকারীদের গভীর সমতার চোখে দেখেছেন। এভাবে তাঁর কবিতায়, ছড়ায়, গল্পে, উপন্যাসে দুর্গোৎসব প্রাসঙ্গিক হয়ে স্থান নিয়েছে। বড় উৎসবে ছোট মানুষের অংশগ্রহণের বিড়ম্বনা ও কষ্ট রবীন্দ্রনাথ চিত্রিত করেছেন তাঁর লেখায়। অমন বড় মাপের লেখককেও ব্যস্ত রেখেছে দুর্গাপূজা। এখানেই দুর্গাপূজার সার্থকতা।
ডা. প্রমিত অনন্য চক্রবর্তী ঢাকার ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির জ্যেষ্ঠ প্রভাষক।