
কেমব্রিজ ইসলামিক কলেজের ডিন ড. মুহাম্মদ আকরাম নদভি ৪৩ খণ্ডের একটি চরিতাভিধান রচনা করেছেন ইসলামের ইতিহাসে নারী হাদিস বর্ণনাকারীদের নিয়ে; যাদের বলা হয় ‘আল–মুহাদ্দিসাত’। ২০২১ সালে প্রকাশিত গ্রন্থটিতে প্রায় ১০ হাজার স্কলার নারীর জীবন–কর্ম স্থান পায়। লন্ডন মুসলিম সেন্টারের চ্যানেলে এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন তিনি। অনুবাদ করেছেন মারদিয়া মমতাজ ও শরিফ সাইদুর।
নারী হাদিস বিশারদদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মানুষের কাছ থেকে উৎসাহের বদলে অনেক বাধা পেয়েছি। বেশির ভাগ স্থানেই অধিকাংশ আলেম এর বিরোধিতা করেছেন। বিশেষ করে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন এ নিয়ে বক্তব্য দিলাম, তখন এক অধ্যাপক দাঁড়িয়ে বললেন, ‘নারী স্কলারদের নিয়ে এই পুরো কাজটি পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্র। আপনি নিজেও পশ্চিমে থাকেন। এই ষড়যন্ত্র হলো নারীদেরকে পুরুষের চেয়ে উত্তম ও গুরুত্বপূর্ণ দেখাতে চাওয়া।’
এরপর শায়খ ইউসুফ আল কারজাভি দাঁড়িয়ে বলেন, ‘ড. আকরাম নারীদের পুরুষদের চেয়ে উত্তম দেখাতে চাইছে না। সে দেখিয়েছে, নারীদের কথা কখনো বলাই হয়নি। ড. আকরাম নারীদের ইতিহাসই বলতে চাচ্ছে। এর অর্থ নারীকে শ্রেষ্ঠ দেখানো নয়।’ মানুষের ভাবনায় ব্যাপারটার পরিণতি নেতিবাচক।
একজন বলেন, ‘আপনার এই কাজ ইসলামকে বাদ দিয়ে দেবে।’ আমি বলেছি, ‘আমি যেসব তথ্য এনেছি, এগুলো ইসলামের মূল গ্রন্থগুলোয়ই আছে। আমাকে বলুন তো এই উৎসগুলোয় কি কোনো সমস্যা আছে?’
নারী হাদিস বিশারদদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মানুষের কাছ থেকে উৎসাহের বদলে অনেক বাধা পেয়েছি। বেশির ভাগ স্থানেই অধিকাংশ আলেম এর বিরোধিতা করেছেন।
অনেকে বলেছেন, নারী স্কলারের এই সংখ্যা আসলে বাড়াবাড়ি। আমার জবাব হলো, এটা একেবারেই সত্যি নয়। আমাদের কাছে এখনো পর্যাপ্ত তথ্য নেই। শুধু ইমাম মুসলিমেরই ৭০ নারী শিক্ষক ছিলেন, আমি কেবল চার থেকে পাঁচজনের তথ্য পেয়েছি। ইবনে নাজ্জার ৪০০ নারী থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন, আমাদের কাছে সবার তথ্য নেই। প্রত্যেকের সঙ্গে অসংখ্য নারী যুক্ত ছিলেন, যাঁদের তথ্য আমাদের বইয়ে নেই।
এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, মধ্য এশিয়ার প্রতিটি ঘর থেকে নারীদের দস্তখতকৃত ফতোয়া আসত। অর্থাৎ প্রতি ঘরেই ফতোয়া দেওয়ার যোগ্য ও উপযুক্ত নারীরা ছিলেন।
অনেকে বলেন, এই নারীরা কেবল হাদিস বর্ণনা করেছেন, কিন্তু তাঁরা হাদিস বুঝতেন না। অথচ দেখুন, এই নারীরা মুফতিয়াত ছিলেন, তাঁরা নিয়মিত ফতোয়া দিতেন। এই তথ্য আমিও জানতে পেরেছি। সুতরাং এই মানসিকতার আলোকে বিচার করবেন না, আরও গবেষণা করুন।
কেউ যখন আমাকে প্রশ্ন করেন, মুহাদ্দিসাতের প্রকৃত সংখ্যা কত? আমি বলি, থামুন! এ তো কেবল শুরু মাত্র। আমরা এখনো পুরোপুরি জানি না। এটা আরও সময় নেবে। এরপর হয়তো আমরা এমন একটা অবস্থায় পৌঁছাব যে মুহাদ্দিসাতের প্রকৃত সংখ্যা ও রাবিয়াতের সংখ্যা জানব। এ কাজে সময় লাগবে। ঠিক যেমন পুরুষদের সংখ্যা জানতে সময় নিয়েছে ৬০০ বছর। নারীদের জন্যও ন্যূনতম কয়েক শতাব্দী লাগবে।
যদি নারীটি সত্যনিষ্ঠ হন, সৎ হন, তাঁর স্মৃতিশক্তি ঠিক থাকে, তাঁর কাছ থেকে হাদিস নেওয়ায় কোনো বাধা নেই। বরং কখনো কখনো নারীদেরকে এ ক্ষেত্রে প্রাধান্যও দেওয়া হয়।
ইসলামে একটা ব্যাপার আছে, দুজন নারীর সাক্ষী একজন পুরুষের সমান। কেন বিষয়টি? বুঝিয়ে বলছি।
ব্যাপার হলো, ‘খবর’ বা তথ্য নিয়ে সাক্ষ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্ভরশীলতা। মূলত এ ক্ষেত্রে একজনের সাক্ষ্যই যথেষ্ট। সে নারী হোক বা পুরুষ। যদি নারীটি সত্যনিষ্ঠ হন, সৎ হন, তাঁর স্মৃতিশক্তি ঠিক থাকে, তাঁর কাছ থেকে হাদিস নেওয়ায় কোনো বাধা নেই। বরং কখনো কখনো নারীদেরকে এ ক্ষেত্রে প্রাধান্যও দেওয়া হয়। এখানে সংখ্যা নয়; বরং গুণগত বিচারই মূল কথা।
এ রকম কোথাও নেই যে হাদিস গ্রহণের সময় দুজন নারীর সাক্ষ্য লাগবে, একজনের বর্ণনা নেওয়া যাবে না। সহিহ বুখারি ও মুসলিমে প্রচুর হাদিস বর্ণিত হয়েছে, শুধু একজন নারীর কাছ থেকে। হানাফি, মালিকি কিংবা শাফেয়ি মাজহাবে উসুল বা ফিকহের ক্ষেত্রে একজন নারীর বর্ণনাকে যথেষ্ট মনে করা হয়েছে।
ইবনে মানদা মুহাদ্দিসাতদের নিয়ে লিখেছেন, আরও অনেকে অনেক কাজ করেছেন। অনেকে আবার নিজেদের শিক্ষকদের জীবনী বর্ণনা করে তার শেষের দিকে নারী বর্ণনাকারীদের নিয়ে কয়েক পৃষ্ঠা লিখেছেন। কিন্তু নারীদের নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা হয়নি।
কিন্তু আমি কাজ করতে গিয়ে কখনো কোনো আলেমকে এই রকম কোনো একটা কাজের কথা বলেছি, তাঁরা আমাকে নিরুৎসাহিত করেছেন। অধিকাংশই বলেছেন, এর কোনো দরকার নেই। এ একেবারে অপ্রয়োজনীয় কাজ।
এটি আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দের যে এই অসিলায় অনেক নারী ইসলামে ফিরে আসছেন। তাঁদের ইমান বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন তাঁরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)–এর ওপর সন্তুষ্ট। তাঁরা ভাবছেন, তাঁদের ওপর হওয়া অবিচারগুলোর জন্য সমাজ দায়ী। ইসলাম, আল্লাহ কিংবা তাঁর রাসুল (সা.) এ জন্য দায়ী নন।
আমি মনে করি, এ বই যদি নারীদের ইসলামে ফিরিয়ে আনতে পারে, তাঁদের অন্তরে আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর মহব্বত সৃষ্টি করে দেয়, ইসলামি জ্ঞানচর্চায় তাঁদের আগ্রহী করে তোলে, তাহলে এ অনেক বড় একটি বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
আল-মুহাদ্দিসাত ০১: ইতিহাসে লুকানো নারী হাদিস বর্ণনাকারীদের কাহিনী