ইসলাম মানুষের ওপর ধার্মিকতা চাপিয়ে দেয় না
ইসলাম মানুষের ওপর ধার্মিকতা চাপিয়ে দেয় না

ধর্ম–দর্শন

খোদা–আসক্তি বাস্তব জীবনকে বর্জন করে না

ইসলাম মানুষের জীবনব্যবস্থাকে যে মৌলিক দর্শনের ওপর দাঁড় করিয়েছে, তার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হলো ‘হাক্কুল্লাহ’ ও ‘হাক্কুল ইবাদ’—আল্লাহর অধিকার ও বান্দার অধিকার। এই দুই অধিকারকে ইসলাম কখনো বিচ্ছিন্ন করে দেখে না, বরং পরস্পর সম্পূরক হিসেবেই বিবেচনা করে।

মানুষের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সুস্থতা ও ভারসাম্য এই দুই অধিকারের সঠিক সমন্বয়ের ওপর নির্ভরশীল। তবে ইসলাম একে অপরের সমান গুরুত্বের কথা বললেও সব ক্ষেত্রে সমান অগ্রাধিকার দেয় না। বরং বিষয়ভেদে অগ্রগণ্যতার পার্থক্য নির্ধারণ করে দিয়েছে।

ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী, ফরজ ও ওয়াজিব ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর হক প্রাধান্য পায়। যেমন নামাজ, রোজা, জাকাত, হজ ইত্যাদি। এগুলোতে কোনো অবহেলা গ্রহণযোগ্য নয়, যদিও তা কখনো কখনো ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য বা সামাজিক পছন্দের পরিপন্থী হয়।

ইসলাম মানুষের ওপর এমন কোনো ধার্মিকতা চাপিয়ে দেয় না, যা তাকে সমাজ ও সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

অন্যদিকে নফল, মুস্তাহাব ও মুবাহ বিষয়গুলোতে মানুষের অধিকার, পারিবারিক দায়িত্ব ও সামাজিক বাস্তবতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

অর্থাৎ ইসলাম মানুষের ওপর এমন কোনো ধার্মিকতা চাপিয়ে দেয় না, যা তাকে সমাজ ও সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

যদিও ইতিহাসের নানা প্রান্তে দেখা যায় সম্পূর্ণ বিপরীত একটি চরমপন্থা, যাকে বলা যায় সন্ন্যাসবাদ। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আবির্ভাবের পূর্ববর্তী যুগে, বিশেষ করে আরব ও আশপাশের অঞ্চলে এই প্রবণতা ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছিল।

ধারণা ছিল, সংসার, পরিবার, সামাজিক দায়িত্ব ত্যাগ করে নির্জন জীবন বেছে নিলেই স্রষ্টার নৈকট্য অর্জন সম্ভব। পাহাড়, জঙ্গল কিংবা উপাসনালয়ে একাকী সাধনায় নিমগ্ন হওয়াকেই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সর্বোচ্চ পথ মনে করা হতো।

এই সন্ন্যাসবাদী চিন্তায় আল্লাহর হককে এতটাই একপেশে গুরুত্ব দেওয়া হতো যে বান্দার হক, পরিবার, সমাজ ও মানবিক দায়িত্বগুলো কার্যত উপেক্ষিত হয়ে পড়ত। স্ত্রী-সন্তান, জীবিকা, সামাজিক সম্পর্ক—সবকিছুই যেন আধ্যাত্মিকতার পথে বাধা বলে বিবেচিত হতো। অথচ ইসলাম এই ধারণাকে স্পষ্ট ভাষায় বিভ্রান্তি বলে ঘোষণা করেছে।

কোরআনে সুরা হাদিদের এক আয়াতে এই সন্ন্যাসবাদ সম্পর্কে সুস্পষ্ট অবস্থান নেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বৈরাগ্য বা সন্ন্যাসবাদ কোনো ঐশী নির্দেশ নয়; বরং মানুষ নিজেরাই তা উদ্ভাবন করেছে। আল্লাহ তা ফরজ করেননি।

আর বৈরাগ্যবাদ—তা তারা নিজেরাই নতুনভাবে চালু করেছে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়। আমি তাদের ওপর এ বিধান অপরিহার্য করিনি।
কোরআন, সুরা হাদিদ, আয়াত ২৭

‘আর বৈরাগ্যবাদ—তা তারা নিজেরাই নতুনভাবে চালু করেছে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়। আমি তাদের ওপর এ বিধান অপরিহার্য করিনি।’ (সুরা হাদিদ, আয়াত ২৭)

এই আয়াত প্রমাণ করে যে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ মানুষ নিজে বানিয়ে নিতে পারে না, বরং তা হতে হবে আল্লাহ নির্দেশিত ও রাসুল (সা.) প্রদর্শিত পথে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজ জীবনাচরণ দিয়ে এই সন্ন্যাসবাদী প্রবণতার কার্যকর প্রতিবাদ করেছেন। তাঁর সুন্নাহ ছিল পূর্ণাঙ্গ মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি—যেখানে ইবাদত আছে, আবার পরিবারও আছে; রাতের নামাজ আছে, আবার দিনের কর্মব্যস্ততাও আছে; সংযম আছে, আবার বৈধ ভোগও আছে।

একটি প্রসিদ্ধ হাদিসের ঘটনা এই ভারসাম্যপূর্ণ আদর্শকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরে। কয়েকজন সাহাবি একদিন পরস্পর আলোচনা করছিলেন, রাসুল (সা.)–এর প্রকাশ্য ইবাদত ও কর্মজীবন তাঁদের জানা, কিন্তু ঘরের ভেতরের আমল সম্পর্কে তাঁরা অবগত নন।

তাঁরা ভাবলেন, নিশ্চয়ই রাসুল (সা.) ঘরে গিয়ে সারাক্ষণ ইবাদতেই নিমগ্ন থাকেন। এই ধারণা থেকে তাঁরা রাসুলের স্ত্রীদের কাছে তাঁর ঘরোয়া জীবন সম্পর্কে জানতে চাইলেন।

উত্তরে জানা গেল, তাঁর ঘরের জীবন ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক ও মানবিক। তিনি পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতেন, ঘরের কাজে সাহায্য করতেন, বিশ্রাম নিতেন, বাজারে যেতেন এবং স্বামী হিসেবে স্ত্রীর অধিকার আদায় করতেন। একই সঙ্গে তিনি নিয়মিত ইবাদতও করতেন।

এই স্বাভাবিক জীবনযাপন সাহাবিদের কাছে আশ্চর্য ও কিছুটা হতাশাজনক মনে হলো। তাঁরা ভাবলেন, আল্লাহ তো রাসুল (সা.)-এর সব গুনাহ আগেই ক্ষমা করে দিয়েছেন, তাই হয়তো তাঁর জন্য কম ইবাদতই যথেষ্ট। কিন্তু আমাদের তো বেশি ইবাদত দরকার!

এই ভুল উপলব্ধি থেকেই তাঁরা নিজেদের জন্য কঠোর সিদ্ধান্ত নিলেন, কেউ সারা জীবন রোজা রাখার সংকল্প করলেন, কেউ বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিলেন, কেউ আবার সারা রাত নামাজ পড়ে ঘুম ত্যাগ করার ঘোষণা দিলেন। উদ্দেশ্য ছিল তাকওয়া ও আল্লাহভীতিতে অগ্রসর হওয়া।

যে আমার সুন্নাহ থেকে বিমুখ হলো, সে আমার দলভুক্ত নয়।
সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫,০৬৩

কিন্তু রাসুল (সা.) এই সিদ্ধান্ত শুনে কঠোর ভাষায় তাঁদের সংশোধন করলেন। তিনি বলেন, তিনিই তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহভীরু ও মুত্তাকি। অথচ তিনি বিয়ে করেছেন, সন্তান আছে, ঘুমান, ইবাদত করেন, কখনো রোজা রাখেন আবার কখনো ছাড়েন। অর্থাৎ তিনি এমন এক জীবনযাপন করেন, যেখানে কোনো প্রয়োজনীয় দিকই উপেক্ষিত নয়।

এই প্রসঙ্গে রাসুল (সা.)-এর ঐতিহাসিক ঘোষণা, যে আমার সুন্নাহ থেকে বিমুখ হলো, সে আমার দলভুক্ত নয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫,০৬৩)

এই বাক্য শুধু একটি হাদিস নয়; বরং ইসলামি জীবনদর্শনের সংক্ষিপ্ততম সংবিধান।

এই বক্তব্যের মূল শিক্ষা হলো ইসলাম কোনো চরমপন্থার নাম নয়। না স্রষ্টাবিস্মৃত মানবতাবাদ, না সংসারবিমুখ সন্ন্যাসবাদ—উভয়ই ইসলামি ভারসাম্যের পরিপন্থী। ইসলাম এমন এক মধ্যপন্থার কথা বলে, যেখানে আল্লাহর অধিকার ও বান্দার অধিকার পরস্পরবিরোধী নয়, বরং পরস্পরের পরিপূরক।

সুন্দর, স্থিতিশীল ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য এই ভারসাম্য অপরিহার্য। যে ব্যক্তি ইবাদতের নামে পরিবার ও সমাজের অধিকার নষ্ট করে, কিংবা মানবাধিকারের নামে স্রষ্টাকে ভুলে যায়—উভয়েই পথভ্রষ্ট। রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহ আমাদের শেখায়, আল্লাহকে পাওয়ার পথ মানুষ থেকে দূরে সরে নয়, বরং মানুষের মাঝেই আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবনযাপন করার মধ্যেই নিহিত।

 আহমাদ সাব্বির : আলেম ও লেখক