শাহ ওয়ালিউল্লাহ: উপমহাদেশে মুসলিম সমাজের জ্ঞানের ঝরনা

একটি সময় ছিল যখন ভারতের মুসলিম শাসন দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তৈমুরীয় রাজবংশের গৌরবময় দিনগুলো বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল, আর ইংরেজরা ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে এসে ধীরে ধীরে ক্ষমতা দখল করছিল। সমাজে ছড়িয়ে পড়েছিল অজ্ঞতা, কুসংস্কার আর ভ্রান্ত বিশ্বাস।

এই অন্ধকার সময়ে একজন মানুষের আবির্ভাব ঘটে, যিনি জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে, সত্যের পথে মানুষকে ফিরিয়ে আনেন। তিনি শাহ ওলী উল্লাহ দেহলভি—একজন আলেম, সংস্কারক ও দার্শনিক, যাঁর জীবন যেন একটি ভুলে যাওয়া গল্প, কিন্তু যাঁর মতো ব্যক্তির পৃথিবীতে খুব প্রয়োজন ছিল। তাঁর কাহিনি শুনলে মনে হয়, তিনি এসেছিলেন একটি জাতির ঘুম ভাঙাতে, তাদের হৃদয়ে ইমানের আলো জাগাতে।

প্রথমে তিনি নিজের বাড়িতে পড়াতেন, কিন্তু ছাত্রদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় সম্রাট মুহাম্মদ শাহ তাঁর জন্য একটি বড় মাদ্রাসা তৈরি করেন, যা ‘দারুল উলুম’ নামে পরিচিত হয়।

প্রাথমিক জীবন

শাহ ওয়ালিউল্লাহ, যাঁর পূর্ণ নাম আহমদ বিন আবদুল হালিম, জন্মগ্রহণ করেন ১৭০৩ সালের ২ মার্চ (১৪ শাওয়াল ১১১৪ হিজরি) ভারতের দিল্লিতে। তখন মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনের শেষ দিনগুলো চলছিল।

তাঁর বাবা শেখ আবদুর রহিম ছিলেন একজন বিখ্যাত আলেম, যিনি আওরঙ্গজেবের তত্ত্বাবধানে হানাফি মাজহাবের ওপর ভিত্তি করে ফাতাওয়া-ই-হিন্দিয়া সংকলনে অংশ নিয়েছিলেন। এই জ্ঞানের পরিবেশে বেড়ে ওঠা শাহ ওয়ালিউল্লাহ মাত্র সাত বছর বয়সে পবিত্র কোরআন মুখস্থ করেন। তিনি বাবার কাছে এবং ভারতের শ্রেষ্ঠ আলেমদের কাছে কোরআন, হাদিস, ফিকহ, আরবি, ফারসি, ওষুধবিজ্ঞান, দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা শেখেন।

কৈশোরেই শাহ শাহ ওয়ালিউল্লাহ জুহদ (ত্যাগ) ও তাসাউফের (সুফিবাদ) প্রতি ঝুঁকে পড়েন। তাঁর আধ্যাত্মিক গভীরতা ও দুনিয়ার প্রতি উদাসীনতা মানুষের হৃদয় জয় করে। লোকেরা তাঁকে ‘শাহ ওয়ালিউল্লাহ’ নামে ডাকতে শুরু করে, যার অর্থ ‘আল্লাহর মহান বন্ধু’।

জ্ঞানের আলো ছড়ানো

১৭১৯ সালে, মাত্র ১৬ বছর বয়সে বাবার মৃত্যুর পর শাহ ওয়ালিউল্লাহ শিক্ষকতা শুরু করেন। তাঁর অসাধারণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কারণে ছাত্ররা তাঁর কাছে ভিড় করতে থাকে। ১৭৩১ সালে তিনি হজ পালনের জন্য মক্কায় যান এবং সেখানে দুই বছর কাটান। মক্কার আলেমদের কাছে হাদিস শিখে তিনি হাদিস বর্ণনার ইজাজত লাভ করেন।

১৭৩২ সালে দিল্লিতে ফিরে তিনি নতুন উদ্যমে শিক্ষাদান শুরু করেন। প্রথমে তিনি নিজের বাড়িতে পড়াতেন, কিন্তু ছাত্রদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় সম্রাট মুহাম্মদ শাহ তাঁর জন্য একটি বড় মাদ্রাসা তৈরি করেন, যা ‘দারুল উলুম’ নামে পরিচিত হয়। এই মাদ্রাসা থেকে বহু আলেম তৈরি হন, যাঁরা তাঁর জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেন।

শাহ ওয়ালিউল্লাহর বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন জাবিদি, যিনি তাজুল আরুস নামে বিখ্যাত অভিধানের রচয়িতা। তাঁর শিক্ষা ছিল শুধু বইয়ের জ্ঞান নয়, বরং জীবনকে পরিবর্তনের পথ দেখানো।

সংস্কার আন্দোলন

১৮ শতকের ভারত ছিল বিশৃঙ্খলার কেন্দ্র। মোগল শাসকেরা দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন, সমাজে কুসংস্কার আর বিদআত ছড়িয়ে পড়েছিল, আর ইংরেজরা ধীরে ধীরে ক্ষমতা দখল করছিল। এই সময়ে শাহ ওলী উল্লাহ একজন সংস্কারক হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি শুধু বই লিখে বা পড়িয়ে সময় কাটাননি; তিনি সমাজের হৃদয় স্পর্শ করেছিলেন।

তিনি সুন্নাহভিত্তিক তাসাউফের প্রচার করেন, যা কোরআন ও হাদিসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি তাসাউফ থেকে অ-ইসলামি দর্শনের প্রভাব দূর করেন এবং এর খাঁটি ইসলামি রূপ তুলে ধরেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ ইজতিহাদের দরজা খোলার পক্ষে কথা বলেন, ফকিহদের অন্ধ অনুকরণের বিরোধিতা করেন।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ ৫০টির বেশি বই লিখেছেন, যা ভারতের ইসলামি জ্ঞানের পুনর্জাগরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

তিনি উল্লেখ করেন, ইমাম আবু হানিফা নিজেই বলেছিলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার দলিল না জেনে আমার কথায় ফতোয়া দেবে, তা জায়েজ নয়।’ ইমাম মালিক, শাফিঈ এবং আহমদ বিন হাম্বলও একই মত পোষণ করতেন।

শাহ ওয়ালিউল্লাহর ছেলে শাহ আবদুল আজিজ তাঁর পথ ধরে চলেন। তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেন, ঘোষণা করেন যে ভারত আর দারুল ইসলাম নেই, বরং দারুল হারব হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘একজন মুসলিম শাসকের ক্ষমতা ছাড়া রাজত্ব কল্পনা করা যায় না, যেমন সূর্যকে আলো ছাড়া কল্পনা করা যায় না।’

এই ফতোয়া মুসলিমদের মধ্যে জিহাদের চেতনা জাগিয়ে তোলে।

রচনাবলি: জ্ঞানের অমর ঐতিহ্য

শাহ ওয়ালিউল্লাহ ৫০টির বেশি বই লিখেছেন, যা ভারতের ইসলামি জ্ঞানের পুনর্জাগরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তাঁর কিছু বিখ্যাত রচনা হলো:

  • হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা: এটি একটি দার্শনিক গ্রন্থ। শরিয়তের হিকমত নিয়ে লেখা এই গ্রন্থ ১৮৬৯ সালে ভারতে ও ১৮৭৭ সালে মিসরে প্রকাশিত হয়।

  • আল-ইনসাফ ফি বয়ানি সাবাবিল ইখতিলাফ: ফিকহের মাজহাবগুলোর উৎপত্তি ও বৈচিত্র্য নিয়ে আলোচনা।

  • আল-ফাওজুল কাবির ফি উসুলিত তাফসির: তাফসিরের নীতিমালা নিয়ে একটি ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।

  • আল-মুসাওয়া মিন আহাদিসিল মুওয়াত্তা: ইমাম মালিকের মুওয়াত্তার হাদিসের ব্যাখ্যা।

  • ফাতহুর রহমান ফি তারজামাতিল কোরআন: কোরআনের ফারসি অনুবাদ।

শাহ ওয়ালিউল্লাহর ছাত্র আহমদ উরফান শহীদ ও ছেলে শাহ আবদুল কাদির তাঁর এই ঐতিহ্য বহন করেন।

মৃত্যু

১৭৬২ সালের ১৭ আগস্ট (২৬ মহররম ১১৭৬ হিজরি) শাহ ওয়ালিউল্লাহ ইন্তেকাল করেন। তিনি চার ছেলে রেখে যান—শাহ আবদুল আজিজ, শাহ রফিউদ্দিন, শাহ আবদুল কাদির ও শাহ আবদুল গনি, যাঁরা তাঁর জ্ঞানের পতাকা বহন করেন। আলেম আবদুল হাই কান্নানি বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর মাধ্যমে ভারতে হাদিস ও সুন্নাহকে পুনর্জাগরণ করেছেন। তাঁর বই ও সনদগুলো এখনো সেই দেশে প্রভাব বিস্তার করে।’

শাহ ওয়ালিউল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে শাহ আবদুল আজিজ ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দেন। তাঁর প্রভাবে ভারতে ইসলামি জাগরণের একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়।