আল্লাহর সৃষ্টিজগতের এক চিরায়ত ধারা হলো বিবাহ। এটি শুধু মানবজাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমগ্র সৃষ্টিতে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করা হয়েছে। (সুরা যারিআত, আয়াত: ৪৯)
এবং এই বন্ধনই জীবনের পূর্ণতা এনে দেয়। বিবাহ হলো মানবসৃষ্ট কোনো চুক্তি নয়, বরং মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত এক পবিত্র বিধান। ইসলাম শুধু একজন ভালো ব্যক্তি সৃষ্টি করতে চায় না, বরং সেই ব্যক্তিকে নিয়ে একটি সুস্থ ও আদর্শ পরিবার নির্মাণ করতে চায়। আর এই পরিবার গঠনের ভিত্তি হলো বিবাহ।
ইসলামের এই পবিত্র বিধানের বিপরীতে মানব ইতিহাসে প্রাচীন ও আধুনিক—উভয় যুগেই এমন কিছু ভ্রান্ত চিন্তাধারা ছিল, যা বিবাহকে প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রাচীন পারস্যে ‘মানি’ ধর্মের মতো কিছু দার্শনিক মতবাদ জগৎকে মন্দ বা অকল্যাণকর মনে করে এর দ্রুত বিলুপ্তি চেয়েছিল, যার একটি মাধ্যম ছিল বিবাহ বর্জন।
ইসলাম যেমন ব্যক্তিকে গঠন করতে চায়, তেমনি পরিবারকেও গঠন করতে চায়, যা সমাজের প্রাথমিক ও অপরিহার্য ভিত্তি।শায়খ ইউসুফ কারজাভি (রহ.)
আবার, খ্রিষ্টান ধর্মের একটি অংশে কঠোর সন্ন্যাসবাদের প্রচলন ঘটে, যেখানে নারীকে প্রলুব্ধকারী হিসেবে দেখে বিবাহকে পাপ ও স্বর্গ থেকে দূরে থাকার কারণ মনে করা হতো। দুঃখজনক হলেও সত্য, আধুনিক পশ্চিমা সংস্কৃতিতে কিছু হতাশাবাদী দার্শনিক নারীকে পুরুষের স্বাধীনতা হরণের প্রতীক হিসেবে চিত্রিত করেছেন, যা কিছু 'আধুনিক' তরুণকে দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতার ভয়ে বিবাহ থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করে।
এই ধরনের মানুষ পবিত্র হালাল পথে না গিয়ে অনেক সময় পাপ ও অবৈধ পথের আশ্রয় নেয়।
অথচ ইসলাম মানুষকে এই সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করে বিবাহের মাধ্যমে এক সুন্দর ও সহজ জীবন প্রতিষ্ঠার সুযোগ দিয়েছে। শায়খ ইউসুফ কারজাভি যেমনটি বলেছেন, “ইসলাম যেমন ব্যক্তিকে গঠন করতে চায়, তেমনি পরিবারকেও গঠন করতে চায়, যা সমাজের প্রাথমিক ও অপরিহার্য ভিত্তি।” (আল-হালাল ওয়াল হারাম ফিল ইসলাম, পৃষ্ঠা ২১৩, মাকতাবা ওয়াহবা, কায়রো, ১৯৯৭ খ্রি.)
ইসলামে বিবাহ প্রবর্তনের পেছনে কেবল জৈবিক চাহিদা পূরণ নয়, বরং বহুবিধ সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক, আধ্যাত্মিক ও সৃষ্টিতাত্ত্বিক উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে।
এই মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্ট। (সুরা ইয়াসিন, আয়াত: ৩৬)
বিদ্যুৎ প্রবাহের জন্য যেমন ধনাত্মক ও ঋণাত্মক প্রান্তের মিলন প্রয়োজন, তেমনি মানবসত্তা তার শারীরিক ও মানসিক পূর্ণতা লাভের জন্য বিপরীত লিঙ্গের প্রতি এক সহজাত আকর্ষণ অনুভব করে। বিবাহের মাধ্যমেই এই আকর্ষণ এক সুন্দর ও সম্মানিত বন্ধনে আবদ্ধ হয়, যা ব্যক্তিকে মানসিক অস্থিরতা ও শূন্যতা থেকে মুক্তি দেয়।
আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, “আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে এটিও যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গিনীদের, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি লাভ করতে পারো। আর তিনি তোমাদের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন ভালোবাসা ও দয়া। নিশ্চয় এর মধ্যে চিন্তাশীল লোকদের জন্য রয়েছে বহু নিদর্শন।" (সুরা রুম, আয়াত: ২১)
এই আয়াত অনুযায়ী, বিবাহ বন্ধনে প্রধানত তিনটি বিষয় অর্জিত হয়: প্রশান্তি, ভালোবাসা এবং দয়া বা সহানুভূতি। এই তিনের সমন্বয়েই একটি সুখী দাম্পত্য জীবন গঠিত হয়।
বিবাহ একজন মুসলিমের জন্য তার চরিত্রকে কলুষমুক্ত রাখার এবং দীনের অর্ধেককে পূর্ণ করার মাধ্যম। বিবাহের মাধ্যমে মানুষ হালাল উপায়ে তার জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে পারে
বিবাহের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানবজাতির অস্তিত্ব ও বংশধারাকে নিরবচ্ছিন্ন রাখা। এর মাধ্যমে পৃথিবীর জীবনপ্রবাহ চলমান থাকে। ইসলামে সন্তান-সন্ততিকে আল্লাহর পক্ষ থেকে উপহার ও নেয়ামত হিসেবে দেখা হয়।
আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, “আর আল্লাহ্ তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের স্ত্রী থেকে পুত্র-পৌত্র সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ দান করেছেন। তবুও কি তারা বাতিলকে বিশ্বাস করে আর আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করে?” (সুরা নাহল, আয়াত: ৭২)
নবী-রাসুলগণও নেক সন্তান লাভের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। যেমন: নবী জাকারিয়া (আ.) দোয়া করেছিলেন, “হে আমার প্রতিপালক, আমাকে একা রাখবেন না, আর আপনিই তো শ্রেষ্ঠ ওয়ারিশ।” (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৮৯)
এবং “অতএব আপনি আপনার পক্ষ থেকে আমাকে একজন ওয়ারিশ দান করুন। সে আমার এবং ইয়াকুবের বংশের উত্তরাধিকারী হবে। আর হে আমার প্রতিপালক, আপনি তাকে সন্তুষ্ট করুন।” (সুরা মারইয়াম, আয়াত: ৫-৬)
রাসুলুল্লাহ (সা.) মুসলিম উম্মাহকে সংখ্যায় বৃদ্ধি করার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন, “তোমরা বিবাহ করো, কেননা আমি তোমাদের নিয়ে অন্যান্য উম্মতের ওপর গর্ব করব। তোমরা খ্রিষ্টানদের সন্ন্যাসীদের মতো হয়ো না।” (বায়হাকি, আস-সুনান আল-কুবরা, ৭/১৩১, দার আল-কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ২০০৩ খ্রি.; সহিহ আল-জামি’ আস-সাগির, হাদিস: ২৯৪০)
বিবাহ একজন মুসলিমের জন্য তার চরিত্রকে কলুষমুক্ত রাখার এবং দীনের অর্ধেককে পূর্ণ করার মাধ্যম। বিবাহের মাধ্যমে মানুষ হালাল উপায়ে তার জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে পারে এবং অবৈধ পথে পা বাড়ানো থেকে বিরত থাকতে পারে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “হে যুবসমাজ, তোমাদের মধ্যে যে বিবাহের সামর্থ্য রাখে, সে যেন বিবাহ করে। কেননা তা দৃষ্টিকে সংযত করে এবং যৌনাঙ্গকে পবিত্র রাখে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫০৬৬)
অন্যত্র তিনি বলেন, “যাকে আল্লাহ সৎ স্ত্রী দান করেছেন, তাকে তার দীনের অর্ধেকের ওপর সাহায্য করেছেন। অতএব, সে যেন বাকি অর্ধেকের ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করে।” (আল-হাফিজ আল-হাইসামি, মাজমা’ আয-যাওয়ায়েদ ওয়া মানবা’ আল-ফাওয়ায়েদ, ৪/ ২৬৫, দার আল-ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৪ খ্রি)
ইসলাম দুনিয়াবি সুখকে ঘৃণা করে না, বরং সৎপথে তা অর্জনের জন্য উৎসাহিত করে। বিবাহ একজন ব্যক্তির জন্য দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুখের কারণ হতে পারে।
নবীজি (সা.) বলেছেন, “দুনিয়া হলো সম্পদ। আর দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো সৎ স্ত্রী।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৪৬৮)।
অন্য হাদিসে সুখের উপাদানগুলোর মধ্যে সৎ জীবনসঙ্গীর কথা উল্লেখ আছে, “চারটি জিনিস হলো সৌভাগ্যের পরিচায়ক: সৎ স্ত্রী, প্রশস্ত বাসস্থান, সৎ প্রতিবেশী এবং আরামদায়ক বাহন।” (সহিহ আল-জামি’ আস-সাগির, হাদিস: ৮৮৭)
পরিবার হলো সমাজের মূল ভিত্তি এবং ক্ষুদ্রতম একক। একটি মানবিক ও উন্নত সমাজ কখনোই পরিবার ছাড়া গঠিত হতে পারে না। এই পরিবার বিবাহের মাধ্যমে তৈরি হয়। পরিবারে স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, ভাই-বোন—এই সম্পর্কগুলোর মাধ্যমে ভালোবাসা, আত্মত্যাগ, সহানুভূতি, সহযোগিতা ইত্যাদি মহৎ মানবিক মূল্যবোধগুলো বিকশিত হয়।
বিবাহ শুধু দুটি মানুষের মধ্যে বন্ধন সৃষ্টি করে না, বরং দুটি পরিবারের মধ্যেও আত্মীয়তার গভীর বন্ধন তৈরি করে। এর মাধ্যমে মানুষের সামাজিক পরিধি প্রসারিত হয় এবং বৃহত্তর সমাজে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়।
আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, “আর তিনিই পানি থেকে মানুষ সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি তাকে বংশগত ও বৈবাহিক সম্পর্কশীল করেছেন। আর আপনার রব হলেন সর্বশক্তিমান।” (সুরা ফুরকান, আয়াত: ৫৪)
এখানে আল্লাহ্ নসব (বংশগত) ও সিহর (বৈবাহিক)—এই দুটি বন্ধনকে মানুষের সামাজিক অস্তিত্বের ভিত্তি হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ইসলাম দুনিয়াবি সুখকে ঘৃণা করে না, বরং সৎপথে তা অর্জনের জন্য উৎসাহিত করে। বিবাহ একজন ব্যক্তির জন্য দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুখের কারণ হতে পারে।
বিবাহ একজন মানুষকে দায়িত্বশীল করে তোলে। বহু মানুষ বিবাহ এড়িয়ে চলে শুধু এই দায়িত্বের ভয়ে। অথচ বিবাহ হলো স্বামী হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে এবং পরবর্তীতে বাবা-মা হিসেবে দায়িত্ব বহন করার এক মহৎ অঙ্গীকার। এই দায়িত্বশীলতার মাধ্যমেই একজন ব্যক্তি পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্ব লাভ করে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “তোমাদের প্রত্যেকেই একজন রাখাল বা দায়িত্বশীল, আর তোমাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। পুরুষ তার পরিবারের জন্য রাখাল এবং সে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার স্বামী ও সন্তানের ঘরের জন্য রাখাল এবং সে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫১৮৮)
তিনি আরও বলেছেন, “একজন মানুষের জন্য এতটুকু পাপই যথেষ্ট যে, সে তার অধীনস্থদের খাদ্য বা জীবিকার সংস্থান করাকে উপেক্ষা করে।" (বায়হাকি, শুআবুল ঈমান, ৭/ ১৩৬, মাকতাবা আর-রুশদ, রিয়াদ, ২০০৩ খ্রি.)
বিবাহিত জীবনের স্থিতিশীলতা একজন মানুষকে বাইরের কর্মজীবনে আরও মনোযোগী হতে সাহায্য করে। যখন একজন পুরুষ নিশ্চিত থাকেন যে তার স্ত্রী ঘরের ভেতরে সবকিছু সুন্দরভাবে সামলাচ্ছেন এবং তার সম্পদ ও সন্তানদের যত্ন নিচ্ছেন, তখন সে নিশ্চিন্তে ও একাগ্রতার সাথে তার কর্মস্থলে মনোযোগ দিতে পারে। এই মানসিক শান্তি তার কাজের মান ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে।
অতএব, ইসলামে বিবাহ একটি অপশন বা সুযোগ নয়, বরং এটি একটি সৃষ্টিগত প্রয়োজন, সামাজিক ভিত্তি, আধ্যাত্মিক পূর্ণতা এবং ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধের প্রতীক। এটি মানবজীবনে শৃঙ্খলা, পবিত্রতা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।