সালামের সৌন্দর্য ও সম্প্রীতি

একটা সময় ছিল, যখন সালাম দেওয়ার গুরুত্ব জানা সত্ত্বেও আমি কাছের মানুষ বা পরিচিতজন ছাড়া অপরিচিতদের সালাম দিতাম না। কারণ, একধরনের লজ্জা বা সংকোচ কাজ করত। মনে হতো, ‘মানুষটিকে তো চিনি না, সালাম দেব? দিলে কী ভাববেন? যদি বিরক্ত হন?’ আবার কখনো সালাম দেওয়ার পর জবাব না পেলে খারাপ লাগত, বিব্রত বোধ করতাম।

পরে ভেবে দেখলাম, সালাম দেওয়ার মাধ্যমে তো আমারই বেশি লাভ। আর আগে সালাম দিলে বাড়তি পুরস্কারও আমিই পাব। তখন থেকে লজ্জা, দ্বিধা বা সংকোচ দূরে রেখে সবাইকে সালাম দেওয়ার চেষ্টা শুরু করলাম। ইসলামের কাজগুলো এমনই। উত্তম কাজ আগে শুরু করলে মহান আল্লাহর কাছ থেকে বাড়তি পুরস্কার অবধারিত। আলহামদুলিল্লাহ।

সালাম কেন দেব

‘সালাম’ শব্দের অর্থ শান্তি। সালাম দেওয়া মানে অন্যের জন্য শান্তি কামনা করা, তার জন্য দোয়া করা। ইসলাম শান্তির ধর্ম বলেই একজন মুসলিম আরেকজন মুসলিমের সঙ্গে দেখা হলে বা কথোপকথনের শুরুতে শান্তির দোয়ার মাধ্যমে সুন্দরভাবে সম্পর্ক শুরু করেন।

ছোটরা বড়কে, পথচারী উপবিষ্টকে এবং অল্পসংখ্যক লোক বেশিসংখ্যক লোককে সালাম দেবে।
সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬২৩৪

সালাম দেওয়া মহান আল্লাহর নির্দেশ ও মহানবী (সা.)-এর সুন্নাহ। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যখন কোনো ঘরে প্রবেশ করবে, তখন নিজেদের ওপর সালাম দেবে, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বরকতপূর্ণ ও পবিত্র অভিবাদনস্বরূপ।’ (সুরা আন-নুর, আয়াত: ৬১)

এ ছাড়া মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘ছোটরা বড়কে, পথচারী উপবিষ্টকে এবং অল্পসংখ্যক লোক বেশিসংখ্যক লোককে সালাম দেবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬২৩৪)

তবু আজকাল অনেকে সালাম দিতে লজ্জা বা সংকোচ বোধ করেন। কেউ কেউ অলসতা করেন, আবার কারও মধ্যে অহংকার কাজ করে। অথচ সালাম দেওয়া মুসলিমদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সম্প্রীতি বাড়ায়।

কাকে সালাম দেব

পরিচিত-অপরিচিত সব মুসলিমকে সালাম দেওয়া একজন মুসলিমের ওপর আরেকজনের হক। এ হকের দাবিদার সবার আগে আমাদের পরিবারের সদস্যরা—মা–বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী বা সন্তান। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ঘরের মানুষকে সালাম দেওয়া তো দূর, বাইরের মানুষকেও সৌজন্যমূলকভাবে সালাম দেওয়া হয় না। আগে মুরুব্বি বা বয়স্কদের দেখলে সালাম দেওয়া হতো, কিন্তু বর্তমানে এ অভ্যাস যেন প্রায় বিলুপ্ত।

মহানবী (সা.) ছোট-বড় সবাইকে সালাম দিতেন। একবার তিনি কিছু বালকের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের সালাম দিয়েছিলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬২৪৭)

তোমরা যখন কোনো ঘরে প্রবেশ করবে, তখন নিজেদের ওপর সালাম দেবে, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বরকতপূর্ণ ও পবিত্র অভিবাদনস্বরূপ।
সুরা আন-নুর, আয়াত: ৬১

এ ছাড়া আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) বলেন, ‘এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, “ইসলামের সর্বোত্তম কাজ কী?” তিনি বললেন, ‘ক্ষুধার্তকে অন্নদান করা ও পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে সকলকে সালাম দেওয়া।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১২; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৩৯)

সালাম একটি উত্তম কাজ

মহানবী (সা.)-এর কাছে সালামের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তিনি বলেছেন, ‘সেই ব্যক্তি মহান আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় যে প্রথমে সালাম করে।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৫১৯৭; সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২৬৮৯) সালাম দেওয়া শুধু একটি অভিবাদন নয়, এটি মুসলিমদের মধ্যে শান্তি, ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা দৃঢ় করার একটি মাধ্যম।

সালামে বেশি নেকি

মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন তোমাদের সালাম দেওয়া হবে, তখন তার চেয়ে উত্তম সালাম দাও বা অন্তত তাই ফিরিয়ে দাও। নিশ্চয় মহান আল্লাহ সবকিছুর হিসাব রাখেন।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ৮৬)

হজরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-কে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে সালাম দিলে তিনি জবাব দিলেন এবং বললেন, ‘তার জন্য ১০টি নেকি।’ আরেকজন ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ’ বলে সালাম দিলে তিনি জবাব দিয়ে বললেন, ‘তার জন্য ২০টি নেকি।’ তৃতীয় ব্যক্তি ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ’ বলে সালাম দিলে তিনি জবাব দিয়ে বললেন, ‘তার জন্য ৩০টি নেকি।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৫১৯৫; সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২৬৮৯)

সালামের সঠিক উচ্চারণ

আমরা অনেকেই হয়তো সালাম দিতে বা সালামের উত্তর দিতে গিয়ে নিজেদের অজান্তেই ভুল করে ফেলি। সালাম দিতে হবে ও উত্তর দিতে হবে স্পষ্ট উচ্চারণে। কারণ, আরবি ভাষায় সামান্য উচ্চারণের পার্থক্যও অর্থের বিকৃতি ঘটাতে পারে।

সালাম একটি দোয়া। তাই কমপক্ষে এতটুকু বিশুদ্ধ উচ্চারণ জরুরি, যাতে এর অর্থ ঠিক থাকে।

সালামের সঠিক উচ্চারণ: আসসালামু আলাইকুম, অথবা আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ, অথবা আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।

সালামের জবাব: ওয়া আলাইকুমুস সালাম, অথবা ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ, অথবা ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।

‘আসসামু আলাইকুম’–এর অর্থ দাঁড়ায় ‘তোমার মৃত্যু হোক’, যাতে শান্তি কামনার বিপরীতে অশান্তি কামনা করা হয়। এ ছাড়া ‘স্লামালেকুম’, ‘স্লামালাইকুম’, ‘আসলামালাইকুম’, ‘আস সালামালাইকুম’—এগুলো সব ভুল সালাম।

সালামের ভুলগুলো

অনেকে হয়তো না জেনে সালাম দিতে গিয়ে মারাত্মক কিছু ভুল করেন। যেমন ‘আসসামু আলাইকুম’–এর অর্থ দাঁড়ায় ‘তোমার মৃত্যু হোক’, যাতে শান্তি কামনার বিপরীতে অশান্তি কামনা করা হয়। এ ছাড়া বহুল প্রচলিত ‘স্লামালেকুম’, ‘স্লামালাইকুম’, ‘আসলামালাইকুম’, ‘আস সালামালাইকুম’—এগুলো সব ভুল সালাম।

যদি ‘অলাইকুম সালাম’, ‘অলাইকুম আসসালাম’ ইত্যাদি জবাব দেওয়া হয়, তবে সেগুলোও ভুল হয়। এতে অর্থ পরিবর্তিত হয়ে শুধু সালামের সঠিকতা নষ্ট হয় না; বরং সালামের উদ্দেশ্য ও বরকতও নষ্ট হয়।

সম্প্রীতির বন্ধনে সালাম

সালাম মানুষের মধ্যে পরিচিতি ও ভালোবাসা বাড়ায়। এটি ফরজ নয়, তবে মহানবী (সা.)-এর একটি প্রিয় সুন্নাহ। সালামের মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে শান্তি ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই আসুন, ছোট-বড়, পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সঠিকভাবে সালাম দেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলি।

ঘরে প্রবেশ করলে, বাইরে কাউকে দেখলে, এমনকি দারোয়ান, রিকশাওয়ালা বা সহযোগীদেরও সালাম দিই। শিশুদের সালাম দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করি। এভাবে আমরা পারস্পরিক সম্প্রীতির একটি সুন্দর বন্ধন সৃষ্টি করতে পারি, ইনশাআল্লাহ।