ধর্ম–দর্শন

ভারসাম্যপূর্ণ ইবাদতই ইসলামের কাম্য

অনেক সময় ধর্মচর্চাকে আমরা কেবল অতিরিক্ত নামাজ, রোজা ও তেলাওয়াতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে ফেলি। কিন্তু ইসলাম এমন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যেখানে ইবাদত মানে কেবল আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক নয়; বরং মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করাও ইবাদতেরই অংশ।

সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.)–এর জীবনের এই ঘটনা সেই ভারসাম্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

আবদুল্লাহ ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক, আত্মসংযমী ও ইবাদতপ্রবণ সাহাবি। তাঁর পিতা আমর ইবনুল আস ছিলেন একজন অভিজ্ঞ, প্রজ্ঞাবান ও বাস্তবমুখী মানুষ। রাজনীতি, কূটনীতি ও সামরিক ক্ষেত্রে তাঁর বিচক্ষণতা ছিল সর্বজনবিদিত।

পুত্রের অতিমাত্রার ইবাদতপ্রবণতা তিনি যে হালকাভাবে নেননি, তা এই ঘটনাতেই স্পষ্ট। ছেলেকে বিয়ে দিয়ে আলাদা ঘর করে দেওয়ার পর তিনি দেখতে গেলেন, সংসার কেমন চলছে। সেখানে তিনি যে বাস্তব চিত্রটি উপলব্ধি করলেন, তা বাহ্যিক প্রশংসার আড়ালে এক গভীর সমস্যার ইঙ্গিত বহন করছিল।

পুত্রবধূ মুখে সরাসরি কোনো অভিযোগ করেননি। কিন্তু তিনি যে ভাষায় স্বামীর প্রশংসা করলেন—সারারাত নামাজে থাকা, সারাদিন রোজা রাখা—তা একজন অভিজ্ঞ মানুষের কাছে নিছক প্রশংসা বলে মনে হয়নি।

বরং বোঝা গেল, এই অতিরিক্ত ইবাদত তার দাম্পত্য জীবনের স্বাভাবিক অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করছে। স্ত্রী হিসেবে স্বামীর সান্নিধ্য, সময় ও মনোযোগ পাওয়াও তার ন্যায্য অধিকার। হযরত আমর ইবনুল আস (রা.) এই সূক্ষ্ম বিষয়টি উপলব্ধি করেই সরাসরি ছেলেকে দোষারোপ না করে আল্লাহর রাসুলের শরণাপন্ন হলেন।

পুত্রবধূ মুখে সরাসরি কোনো অভিযোগ করেননি। কিন্তু তিনি যে ভাষায় স্বামীর প্রশংসা করলেন—তা একজন অভিজ্ঞ মানুষের কাছে নিছক প্রশংসা বলে মনে হয়নি।

এখানেই ইসলামের সৌন্দর্য ও প্রজ্ঞা ফুটে ওঠে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বিষয়টিকে কোনোভাবেই একপেশে করে দেখেননি। তিনি ইবাদতের আগ্রহকে নাকচ করেননি, আবার পারিবারিক ও মানবিক অধিকারের বিষয়টিকেও অবহেলা করেননি। তিনি হযরত আবদুল্লাহ (রা.)-কে ডেকে এনে প্রশ্ন করলেন—তিনি কী পরিমাণ ইবাদত করেন।

উত্তরে যখন জানা গেল যে তিনি সারারাত নামাজ পড়েন, তখন রাসুল (সা.) স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন, এটি সঠিক পন্থা নয়। কারণ মানুষের শরীরের যেমন অধিকার আছে, তেমনি স্ত্রীরও অধিকার আছে। অতিরিক্ত ইবাদত যদি শরীরকে দুর্বল করে এবং সংসারকে উপেক্ষিত করে তোলে, তবে তা ইসলামসম্মত নয়।

রোজার ক্ষেত্রেও একই দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। আবদুল্লাহ (রা.) ধারাবাহিকভাবে রোজা রাখতেন। রাসুল (সা.) প্রথমে তাকে সহজ পথের দিকে আহ্বান করলেন—মাসে মাত্র তিনটি রোজা। কিন্তু আবদুল্লাহর প্রবল আগ্রহ ও আত্মসংযমের মানসিকতা দেখে তিনি ধাপে ধাপে অনুমতি বাড়াতে থাকলেন।

শেষ পর্যন্ত দাঊদ (সা.)–এর রোজার কথা উল্লেখ করলেন, যা একদিন পরপর। এখানেও লক্ষ্য করা যায়, রাসুল (সা.) কখনোই অতিরিক্ত কষ্টকর ইবাদতে উৎসাহ দেননি; বরং মানুষের সামর্থ্য, স্থায়িত্ব ও ভারসাম্যের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছেন।

কোরআন তেলাওয়াতের ক্ষেত্রেও একই নীতি প্রয়োগ করা হয়েছে। দৈনিক পুরো কোরআন পড়া নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়; কিন্তু তা যদি জীবনের অন্য দায়িত্বগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তবে তা কাঙ্ক্ষিত নয়।

রাসুল (সা.) ধীরে ধীরে সময়সীমা নির্ধারণ করে দিলেন—মাসে একবার, তারপর পনেরো দিনে, দশ দিনে এবং সর্বশেষ সাত দিনে এক খতম। এর বেশি না। এখানে উদ্দেশ্য ছিল, তেলাওয়াত যেন নিয়মিত, অর্থবহ ও দীর্ঘস্থায়ী হয়; কেবল সংখ্যা পূরণের প্রতিযোগিতা না হয়ে দাঁড়ায়।

এই ঘটনার সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী অংশ আসে আবদুল্লাহর জীবনের শেষপ্রান্তে। দীর্ঘ জীবন পার করে তিনি যখন বার্ধক্যে পৌঁছান, তখন নিজের যৌবনের সিদ্ধান্ত নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেন। তিনি উপলব্ধি করেন, নবীজি (সা.) যে সহজ ও সহনীয় পথের দিকে আহ্বান করেছিলেন, তা গ্রহণ করলেই প্রকৃত কল্যাণ ছিল।

ইবাদত তখনই সুন্দর, যখন তা মানুষকে আল্লাহর নিকটবর্তী করার পাশাপাশি মানুষ হিসেবেও পরিপূর্ণ করে তোলে।

যৌবনের উদ্দীপনায় তিনি কঠোর নিয়মে নিজেকে বেঁধে ফেলেছিলেন, যার ভার শেষ বয়সে বহন করা তার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু একবার যেহেতু তিনি রাসুলের সঙ্গে অঙ্গীকার করেছিলেন, তাই সেই অঙ্গীকার রক্ষা করাকেই তিনি নিজের জন্য আবশ্যক মনে করেছেন।

এই আক্ষেপ আসলে আমাদের সবার জন্য এক গভীর শিক্ষা। ইসলাম চায় না যে মানুষ নিজেকে এমনভাবে ক্লান্ত করুক, যাতে ইবাদতই তার জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। বরং ইসলাম চায় স্থায়ী, পরিমিত ও ভারসাম্যপূর্ণ ইবাদত। যেখানে আল্লাহর হক যেমন আদায় হবে, তেমনি বান্দার হক—স্ত্রী, পরিবার, শরীর ও সমাজের অধিকারও সংরক্ষিত থাকবে।

এই ঘটনাটি স্পষ্ট করে দেয়, ইবাদত ও মানবাধিকারের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। বরং প্রকৃত ইবাদত সেইটাই, যা মানুষের মানবিক দায়িত্বকে শক্তিশালী করে। স্ত্রীর অধিকার রক্ষা, শরীরের যত্ন নেওয়া, সংসারের দায়িত্ব পালন—এসবই ইসলামের দৃষ্টিতে ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর রাসুল (সা.) নিজের জীবনে এই ভারসাম্যের অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন এবং সাহাবিদের জীবনেও তা বাস্তবায়ন করেছেন।

এই ঘটনাটি আমাদের শেখায়—ধর্মচর্চা মানে কেবল অতিরিক্ত আমল নয়; বরং সুস্থ জীবনব্যবস্থা গড়ে তোলা। আবেগের বশে কঠোরতা আরোপ না করে নববী নির্দেশনার সহজতা ও প্রজ্ঞাকে গ্রহণ করাই প্রকৃত তাকওয়ার পরিচয়। ইবাদত তখনই সুন্দর, যখন তা মানুষকে আল্লাহর নিকটবর্তী করার পাশাপাশি মানুষ হিসেবেও পরিপূর্ণ করে তোলে।

সূত্র: সহিহ বুখারি, হাদিস: ১,৯৭৫। মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ৬,৪৭৭।

আহমাদ সাব্বির : আলেম ও লেখক