রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে ব্যবসা করেছেন, অন্যদেরও ব্যবসা করতে উৎসাহ দিয়েছেন। বংশের অন্যান্য সদস্যসহ বাপ-দাদারা ব্যবসায়ী হওয়ায় ছোটবেলা থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের রীতিনীতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন তিনি। মাত্র ১২ বছর বয়সে বাণিজ্য সফরে অংশ নিয়েছেন। ব্যবসায়ী পূর্বপুরুষদের সংস্পর্শে ছোট থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের কলাকৌশল রপ্ত করতে পেরেছিলেন। ইবনে সাদ (র.)-এর একটি বর্ণনা থেকে জানা যায়, ‘চাচা আবু তালেব কিংবা কুরাইশের অন্য ব্যবসায়িক সাথী-সঙ্গীদের সঙ্গে বাজারেও কর্মতৎপর ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। চাচার কাছ থেকেই মূলত তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাথমিক ধারণা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। (নবীয়ে রহমত, সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী (র.), অনুবাদ: আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃষ্ঠা: ১০৮)
নবুয়তপ্রাপ্তির আগে রাসুলুল্লাহ (সা.) ব্যবসার কায়দাকানুন জেনে অংশীদারি ব্যবসা করেছিলেন। যেসব অংশীদারের সঙ্গে তাঁর ব্যবসাবাণিজ্য করার ইতিহাস বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়, তারা হলেন আবদুল্লাহ ইবনে আবিল হামসা, সাইব ইবনে আবি সাইব, কায়স ইবনে সাইব মাখজুমি এবং আবু সুফিয়ান ইবনে হারব প্রমুখ। তাঁরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সততা ও কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ ছিলেন। ব্যবসাবাণিজ্যের এ ধারা নবুয়তপ্রাপ্তির পর ভিন্ন আঙ্গিকে অল্পস্বল্প চালু ছিল। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা: ১৬৭)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ব্যবসায়িক অংশীদার আবদুল্লাহ ইবনে আবিল হামসা বলেন, ‘নবুয়তের আগে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে আমার ব্যবসায়িক লেনদেন ছিল। আমি কিছু ঋণ পরিশোধ করি আর কিছু বাকি ছিল। একদিন আমি তাকে বললাম, এখানে একটু অপেক্ষা করুন আমি আসছি। কিন্তু ঘরে ফিরে সে কথা বেমালুম ভুলে গেলাম।
তিন দিন পর হঠাৎ কথাটি স্মরণ হলো এবং আমি দ্রুত ছুটে গিয়ে দেখি, রাসুলুল্লাহ (সা.) সেখানেই অপেক্ষমাণ। আমাকে দেখে কোনো ধরনের মন্দ কথা বললেন না তিনি। শান্ত মেজাজে বললেন, তুমি আমাকে অনেক অসুবিধায় ফেলে দিলে। তিন দিন ধরে আমি এখানেই তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। (আবু দাউদ, হাদিস: ৪৯৯৬)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এমন আচরণে মুগ্ধ হয়ে পরবর্তীকালে আবদুল্লাহ ইবনে আবিল হামসা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। (আল্লাহর পরে শ্রেষ্ঠ যিনি, ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ, পাথেয় পাবলিকেশন্স, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ৯৬)
সাইব ইবনে আবি সাইব নামে আরেক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ব্যবসায়িক অংশীদার ছিলেন। মক্কা বিজয়ের দিন উসমান ও জুহাইর (রা.) তাঁকে সঙ্গে নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এলেন। উপস্থিত সাহাবিরা তাকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে উদ্যত হলেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আমি তাকে তোমাদের চেয়ে ভালো চিনি। জাহেলি যুগে তিনি আমার ব্যবসার অংশীদার ছিলেন।’
সাইব তখন বললেন, ‘আপনার ওপর আমার মা-বাবা কোরবান হোক! আপনি সত্য বলেছেন। আপনি আমার ব্যবসায়িক অংশীদার ছিলেন। আপনি অনেক ভালো অংশীদার ছিলেন। আপনার লেনদেন অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ছিল। আপনি কখনো আমার সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করেননি এবং কখনো আপনি আমার সঙ্গে প্রতারণাও করেননি।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ৪,৮৩৬; মুসনাদে আহমাদ, ৩/৪২৫)
কায়স ইবনে সাইব মাখজুমি নামে এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে অংশীদার হিসেবে ব্যবসা করেছেন। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর লেনদেনের প্রশংসা করে বলেছেন, ‘লেনদেন মানুষের আসল চরিত্রের পরিচয় বহন করে।’ (আল্লাহর পরে শ্রেষ্ঠ যিনি, ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ, পাথেয় পাবলিকেশন্স, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ৯৭)
ইবনে কাসির (র.) লিখেছেন, ‘আবু সুফিয়ান ইবনে হারব নিজ বন্ধু উমাইয়া ইবনে আবিস সালাতের সঙ্গে ব্যবসার জন্য সিরিয়া গেলেন। দুই মাস অবস্থান করে মক্কায় ফিরে এলেন। এরপর ইয়ামানে বাণিজ্যিক সফরে গেলেন। পাঁচ মাস অবস্থান করে আবার মক্কায় ফিরলেন।
এরপর তিনি কাবা শরিফ তাওয়াফ করার জন্য গেলে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। রাসুলুল্লাহকে বললেন, ‘আপনার ব্যবসায়িক পণ্য অনেক হয়ে গেছে এবং তাতে অনেক মুনাফাও জমেছে। আপনি কাউকে পাঠিয়ে দিয়ে তা নিয়ে আসার ব্যবস্থা করুন। আমি সেই পারিশ্রমিকও নেব না, যা সবার কাছ থেকে সাধারণত নিয়ে থাকি।’
এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) তা নিতে অস্বীকার করে বললেন, ‘আপনি পারিশ্রমিক গ্রহণ না করলে আমি ব্যবসায়িক পণ্য নেব না।’
এ কথা শুনে আবু সুফিয়ান বললেন, ‘ঠিক আছে, সবার কাছ আমি যা থেকে নিই, আপনার কাছ থেকেও তা-ই নেব।’
কথামতো রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজের ব্যবসায়িক পণ্য আনালেন। আবু সুফিয়ানও পারিশ্রমিক নিলেন। (আনসাবুল আশরাফ, আল্লামা বালাজুরি, পৃষ্ঠা: ৪৮৬)
এ বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, আবু সুফিয়ানের সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর অংশীদারিত্বের চুক্তিতে ব্যবসা ছিল।
মিরাজ রহমান: লেখক