বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও প্রথম আলো আয়োজিত ‘আইন, নীতি ও বাস্তবতায় নগর জলাশয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ১ ডিসেম্বর ২০২৪, ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও প্রথম আলো আয়োজিত ‘আইন, নীতি ও বাস্তবতায় নগর জলাশয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ১ ডিসেম্বর ২০২৪, ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে

আইন, নীতি ও বাস্তবতায় নগর জলাশয়

অংশগ্রহণকারী

ইশরাত ইসলাম

অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, বুয়েট

শামসুল হুদা

নির্বাহী পরিচালক, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি)

বদরুল হাসান লিটন

পরিচালক (পরিকল্পনা), পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো)

কাজী কামরুল হাসান

পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত), ইকোলজি, ফরেস্ট্রি অ্যান্ড বায়োডাইভারসিটি, সিইজিআইএস

আদিল মুহাম্মদ খান

সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)

মোহাম্মদ শাকিল আখতার

অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, বুয়েট

ইকবাল হাবীব

সহ সভাপতি, বাপা

মো. মুস্তাফিজুর রহমান

উপ নগর–পরিকল্পনাবিদ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)

মোহাম্মদ এজাজ

চেয়ারম্যান, রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার

শামসুল হক

সাধারণ সম্পাদক, নদী ও পরিবেশ উন্নয়ন পরিষদ, সাভার

তাসলিমা ইসলাম

প্রধান নির্বাহী (ভারপ্রাপ্ত), বেলা

সঞ্চালনা: ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

ইশরাত ইসলাম

অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, বুয়েট

দুই দশকের বেশি সময় ধরে আমরা জলাশয় সংরক্ষণ নিয়ে কাজ চালিয়ে আসছি। ১৯৯২ সালের ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট পলিসি ও ন্যাশনাল ওয়াটার পলিসিতে জলাশয় সংরক্ষণের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার অভিজ্ঞতায় এসব নীতিমালা তৈরি হয়েছিল। তবে জলাশয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণে আমরা এখনো যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনি। এ সুযোগে অনেক অসাধু চক্র জলাশয় দখল ও ভরাটের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১০ সালে ঢাকায় জলাভূমির পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৫৫৬ একর, যা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৭৩ একর।

ঢাকার বাইরেও পরিস্থিতি খুব একটা ভিন্ন নয়। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে পুরোনো খালগুলো ভরাট করা হয়েছে। সারা দেশে একই ধরনের সংকট দেখা যাচ্ছে।

ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচার পলিসিতে খাদ্য নিরাপত্তায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা রয়েছে। জলাশয়ের সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তার সম্পর্ক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

ন্যাশনাল ল্যান্ড ইউজ পলিসি ২০০১ এ–ও জলাশয় সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট পলিসি ২০১৮-তে এ বিষয়ে আরও আধুনিক ধারণা যুক্ত করা হয়েছে।

স্বাধীনতার সময় আমাদের দেশে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ কতখানি কৃষিজমি ও অন্যান্য জমির মালিক হতে পারবে, সে বিষয়ক আইন ও নীতি ছিল। পারবে। এ গুরুত্বপূর্ণ নীতি পরবর্তী সময়ে আর কার্যকর রাখা হয়নি। এ ধারণাটি পুনরায় চালু করা দরকার।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশে ভারী বৃষ্টিপাত একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশের ওপর সৃষ্ট চাপ মোকাবিলায় জলাশয় সংরক্ষণ অপরিহার্য। এ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনেও জলাশয় সংরক্ষণ আবশ্যক। জলাশয় সংরক্ষণ শুধু পরিবেশ না, কৃষি, অর্থনীতি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি অপরিহার্য বিষয়।

উন্নয়ন নীতির বাস্তবায়ন, আইনের সঠিক প্রয়োগ, ট্যাক্সেশন নীতিমালার সংস্কার ও স্থানীয় জনগণকে পরিকল্পনার অংশীদার করে একটি সমন্বিত নীতি গ্রহণই এসব সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হতে পারে। তবে এ জন্য প্রয়োজন প্রশাসনিক জবাবদিহি, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জনগণের ব্যাপক সচেতনতা।

ঢাকার নগর পরিকল্পনার দীর্ঘ ইতিহাসে স্ট্রাকচার প্ল্যান ও ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) সঠিক বাস্তবায়ন সব সময়ই চ্যালেঞ্জের ছিল। স্ট্রাকচার প্ল্যান তৈরি হলেও তা কখনো গ্যাজেট আকারে প্রকাশিত হয়নি। স্ট্রাকচার প্ল্যানে ভালো কিছু প্রতিশ্রুতি ছিল, তবে ড্যাপে সেসবের যথাযথ প্রতিফলন ঘটেনি। এতে ‘মুখ্য জলস্রোত’ ও ‘সাধারণ জলস্রোতের’ ভাষাগত অস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন জটিল করে তোলা হয়েছে। এ ধরনের শব্দ আইনি কাঠামোয় নির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত না হওয়ায় আদালতেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না।

ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান বাস্তবায়নে স্থানীয় জমিমালিকদের অংশগ্রহণ ও প্রণোদনা প্রদান গুরুত্বপূর্ণ। ড্যাপে এবার সে রকম একটি ধারণা যুক্ত করা হয়েছে, যা প্রশংসনীয়। কিন্তু এটি কীভাবে কার্যকর করা হবে, সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট নীতিমালা নেই।

যারা জমি ভরাট করে, তাদের সংখ্যা কম হলেও নেটওয়ার্ক অত্যন্ত শক্তিশালী। তাই তাদের নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। অন্যদিকে যারা জলাশয় সংরক্ষণের জন্য কাজ করেন, তাদের সংখ্যা অনেক বেশি হলেও নেটওয়ার্ক ও কণ্ঠস্বর অত্যন্ত দুর্বল।

জলাশয় সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আইনের প্রয়োগ। প্রথমত, সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে যেন জলাশয় ভরাট বা ধ্বংসের মতো কর্মকাণ্ড বন্ধ করা যায়। দ্বিতীয়ত, জলাধারের সঠিক সীমারেখা নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। তৃতীয়ত, ভূমি উন্নয়নের ক্ষেত্রে এমন নীতি গ্রহণ করা উচিত, যা জলাভূমি ধ্বংসের প্রবণতা কমায়।

দেশের জলাশয় সংরক্ষণের জন্য সঠিক নীতি ও দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। এটি শুধু পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য না; বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও জলাশয় সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি।

শামসুল হুদা

নির্বাহী পরিচালক, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি)

বাংলাদেশে প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে জলাশয় রক্ষার বিষয়টি সরাসরি সম্পর্কিত। কিন্তু আমাদের আলোচনায় প্রায়ই গ্রামীণ জনপদের সমস্যাগুলো উপেক্ষিত হয়। ঢাকা শহরের মতো জায়গায়ও বস্তিবাসীদের বাসস্থান ও জীবন-জীবিকা নিয়ে পর্যাপ্ত আলোচনা হয় না। ঢাকা শহরের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ বস্তিতে বাস করছে। কিন্তু এসব মানুষের সমস্যাগুলো কখনোই আলোচনায় আসে না। একইভাবে গ্রামের মানুষের কৃষি, সেচ, জীবনযাত্রা ও বাসস্থানের সমস্যাও গুরুত্ব পায় না। আমাদের আলোচনা নগরকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে, যা প্রকৃত সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট নয়।

জলাশয় কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়; বরং নদী, বন, পাহাড় ও ভূমি—সব মিলিয়েই আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ। এ বিষয়ে দেশে যথেষ্ট আইন ও নীতিমালা থাকলেও সেগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন হচ্ছে না। দেশে কৃষিজমি সুরক্ষার কোনো নির্দিষ্ট আইন নেই। ১৪ বছর ধরে বিভিন্ন খসড়া আইন প্রস্তুত হলেও তা কার্যকর হয়নি।

জলাশয়, বন, পাহাড় ও ভূমি সংরক্ষণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত একটি সমন্বিত পরিকল্পনা ও আইন প্রণয়ন জরুরি। জমি ব্যবস্থাপনা সংস্কারের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত জমি কেনাবেচার প্রক্রিয়া সীমিত করা উচিত। কেবল রাষ্ট্রের মাধ্যমে জমি বিক্রির কার্যক্রম চলা দরকার। এর মাধ্যমে জমি ব্যবহারের উদ্দেশ্য নির্ধারণ ও অপব্যবহার রোধ সম্ভব। জমি ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ভূমি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।

বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর ব্যাপকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। নদীগুলো ধ্বংস করে মাছ চাষের জন্য লেকে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ, আমলাতন্ত্র ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এ জলাশয় ও নদী ভরাট প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। নদীগুলোকে বাঁচানোর জন্য আমাদের ঐতিহ্যবাহী নদীপথ পুনরুদ্ধার ও নৌ যোগাযোগ ফিরিয়ে আনার দাবি জানাই। এটি বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। 

জলাশয় রক্ষার প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নে জবাবদিহির ওপর জোর দিতে হবে। নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রুতিগুলো রক্ষা করতে হবে। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ঢাকা শহরের ধোলাই খালসহ অন্যান্য খাল পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বাস্তবে খালগুলো আরও বেশি ভরাট হয়েছে।

নদী রক্ষা কমিশনকে শক্তিশালী করতে বাজেট, লোকবল ও বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্তি জরুরি। একই সঙ্গে প্রতিটি সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

প্রতিটি প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার জন্য সমন্বিত নীতি, কার্যকর আইন ও জবাবদিহি ব্যবস্থা থাকা অত্যন্ত জরুরি। আইন ও নীতিমালার বাস্তবায়ন জোরদার করার পাশাপাশি প্রাকৃতিক সম্পদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।

আদিল মুহাম্মদ খান

সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)

গণমাধ্যমে জলাশয় সংরক্ষণ নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু এ আলোচনার ৭০ শতাংশই ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকার বাইরের জলাশয় সংরক্ষণের বিষয়টি বেশির ভাগ সময়ই উপেক্ষিত থাকে। ঢাকার বাইরে থাকা অনেক জলাশয় ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে, আর বাকিগুলো

রক্ষার জন্য কার্যকর উদ্যোগের অভাব রয়েছে। বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতায় পরিবেশ ও জলাশয় রক্ষার একটি বড় সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু দুঃখজনকভাবে এখন পর্যন্ত বড় দখলদারদের আইনের আওতায় আনার দৃষ্টান্ত তৈরি হয়নি।

জলাশয় দখলকারীদের মধ্যে আবাসন ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা এগিয়ে আছেন, কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। নদী কমিশনের কাছে দখলদারদের তালিকা থাকলেও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের আইন প্রয়োগে নীরবতা জলাশয় রক্ষার পথে বড় বাধা। এ ক্ষেত্রে শুধু রাজউক বা পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিকল্পনা যথেষ্ট নয়; স্থানীয় প্রশাসনের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন।

পরিকল্পনাকারীরা রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক চাপ উপেক্ষা করতে পারেন না। এ কারণে তাঁদের সুরক্ষা ও শক্তি বাড়ানোর প্রয়োজন।

শুধু আইন বা প্ল্যান দিয়ে জলাশয় রক্ষা সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষের ঐক্য ও সচেতনতার মাধ্যমে জলাশয় রক্ষা করা সম্ভব। মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলে তারা নিজেদের প্রয়োজনে জলাশয় রক্ষায় সংগ্রাম করতে পারবে।

সিলিকন সিটির মতো উন্নয়ন প্রকল্প ঢাকার বড় জলাশয় দখল করেছে। এসব প্রকল্প কৃষিজমি ধ্বংস করছে। রাষ্ট্র এ বিষয়ে সজাগ না। জলাশয় রক্ষায় রাষ্ট্রকে জাগাতে হবে। জলাশয় দখলকারীদের জীবন্ত সত্তা হত্যাকারী হিসেবে আইনের আওতায় আনতে হবে।

জলাশয় রক্ষার জন্য আইন সংস্কার, প্রশাসনিক সক্রিয়তা ও সাধারণ মানুষের শক্তিকে একত্র করার কোনো বিকল্প নেই।

কাজী কামরুল হাসান

পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত), ইকোলজি, ফরেস্ট্রি অ্যান্ড বায়োডাইভারসিটি, সিইজিআইএস

সম্প্রতি আমরা ঢাকা শহরের ওপর একটি গবেষণা করেছি। এ গবেষণায় সবুজাঞ্চল (গ্রিন স্পেস), জলাধার (ব্লু এরিয়া) ও শহরাঞ্চলের (আরবান এরিয়া) পরিবর্তনগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ঢাকা শহরে বর্তমানে সবুজাঞ্চল মাত্র দশমিক ৭ শতাংশ। সবুজাঞ্চল কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ শতাংশ হওয়া উচিত। জলাধারের পরিমাণ মাত্র ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। এ ঘাটতি আমাদের পরিবেশ ও জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এটি অবিলম্বে সমাধান করা না হলে শহরের তাপমাত্রা আরও বেড়ে ‘হিট অ্যালার্ট’ অবস্থার সৃষ্টি হবে।

ঢাকা শহরের জলস্রোত শীতলক্ষ্যা, বালু ও বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে মিশে যায়। এ এলাকাগুলো এখনই রক্ষা করা না হলে আপস্ট্রিম বন্যা ও বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।

রাজারবাগে আগে চার থেকে ছয়টি পুকুর ছিল। এ পুকুরগুলো বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে সাহায্য করত। এখন সেখানে মাত্র একটি পুকুর আছে। কলাবাগানের বিশাল দিঘিটি পর্যটনের জন্য আকর্ষণীয় স্থান হতে পারত, কিন্তু সেটি রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের কারণে ভরাট হয়ে গেছে। এর ফলে বৃষ্টির পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।

আমাদের পানি আইন, পরিবেশ নীতি ও ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যানে (ন্যাপ) জলাধার রক্ষার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। এসব নীতির কার্যকর বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

কৃষিকাজে পানির অপচয় কমিয়ে আনার জন্য কৃষকদের ‘ওয়েট অ্যান্ড ড্রাই মেথড’ প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। এ পদ্ধতিতে চাষাবাদে চার ভাগের এক ভাগ পানি ব্যবহার করেও ভালো ফলন সম্ভব।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাব মোকাবিলায় এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পারলে ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলাধারের সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। এ উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতে আমাদের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর আরও গুরুতর প্রভাব পড়বে।

বদরুল হাসান লিটন

পরিচালক (পরিকল্পনা), পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো)

অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পানি ও জলাভূমি সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩-এ জলাধার ও জলাভূমির সংজ্ঞা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

জলাধার বলতে প্রাকৃতিক বা কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট যেকোনো নদী, খাল, বিল, হাওর, বাঁওড়, পুকুর বা অনুরূপ জলাধারকে বোঝায়। আর জলাভূমি হলো এমন ভূমি, যেখানে পানির উপরিতল ভূমিতলের কাছাকাছি থাকে এবং এ ভেজা মাটিতে বিশেষ ধরনের উদ্ভিদ জন্মায়।

জলাভূমি ও জলাধার ভরাট করা হলে আমরা মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হব। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও রাজশাহীর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। ঢাকাসহ অন্য জেলাগুলোর অবস্থাও ক্রমেই করুণ হয়ে উঠছে।

ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামার কারণে আর্সেনিক ও আয়রনের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষিকাজে ৮১ শতাংশ পানি ভূগর্ভস্থ থেকে উত্তোলন করা হয়, যা এ পানির স্তরের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বড় সংকট তৈরি করছে।

জলাভূমি সংরক্ষণের জন্য প্রতিটি উপজেলায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় অন্তত একটি জলাধার রাখতে হবে। পুরোনো জলাশয়গুলোর সংস্কার ও নতুন জলাশয় তৈরি করতে হবে। ভূমিস্থ পানির ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর জন্য ভূগর্ভস্থ পানির পরিবর্তে পুকুর, হাওর ও নদী থেকে পানি ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। পানির সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে স্থানীয় জনগণ ও কৃষি বিভাগকে শিক্ষিত ও সচেতন করতে হবে।

শিল্পকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য নদীর পানিকে দূষিত করছে। এ দূষণ থেকে শাকসবজি ও জলজ প্রাণীর মাধ্যমে রোগবালাই বাড়ছে। পানিদূষণ বন্ধ করতে না পারলে আমাদের জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হবে।

পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও জলাভূমি সংরক্ষণ আমাদের টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। এ জন্য এখন থেকেই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি নিরাপদ ও টেকসই পরিবেশে বাঁচতে পারবে।

মোহাম্মদ শাকিল আখতার

অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, বুয়েট

আমাদের নীতিমালা ও পরিকল্পনা তৈরির উপাত্ত নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে। ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান বা রাজউকের ড্যাপ তৈরিতে ওয়ার্কিং পেপার থাকা উচিত ছিল। রাজউকের তথ্যভান্ডারেরও স্বচ্ছতা নেই। গবেষকদের জন্য প্রয়োজনীয় উপাত্ত সহজলভ্য নয়।

আমাদের দেশে প্রচুর পরিকল্পনা তৈরি হয়, কিন্তু সেগুলোর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। ছোট শহরে জলাভূমি ভরাট করে স্টেডিয়াম তৈরি করা হচ্ছে। ঢাকার খালগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মতো স্থাপনার কারণে খাল নষ্ট হয়েছে। অর্থাৎ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে পেশাদারত্বের অভাব রয়েছে।

ঢাকার ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) কাঠামোগত পরিকল্পনার অভাব প্রকট। ২০১০ সালে ড্যাপ প্রণয়নের সময় কাঠামোগত পরিকল্পনা অনুমোদন করা হয়নি। বর্তমানে রাজউক কাঠামোগত পরিকল্পনা এড়িয়ে চলছে। এর ফলে পরিকল্পনার কার্যকারিতা হ্রাস পাচ্ছে।

রাজউককে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করতে হবে, ‘ডেভেলপারের’ নয়। রাজউক বর্তমান ভূমিকা ভূমি ব্যবস্থাপনা সংকট তৈরি করছে।

রিহ্যাবের (রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) তথাকথিত ‘সেকেন্ড হোম’, ‘থার্ড হোমের’ ধারণা মানুষকে আরও অপ্রয়োজনীয় আবাসন ক্রয়ে উদ্বুদ্ধ করছে। এ অবস্থায় রাজউক ও নদী কমিশনের ভূমিকা কার্যকর ও স্বচ্ছ হওয়া জরুরি।

ড্যাপ ও অন্যান্য পরিকল্পনার প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ডেটা অ্যাকসেস নিশ্চিত করা, গণমাধ্যমের কার্যকর ভূমিকা ও রাজউককে একটি সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলা জরুরি। নীতিমালা বা আইনের অভাব নেই। কিন্তু সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন, ডেটার স্বচ্ছতা ও পরিকল্পনার দীর্ঘমেয়াদি সুফল নিশ্চিত করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

এ অসংগতিগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরতে গণমাধ্যম ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করা উচিত।

ইকবাল হাবীব

সহ সভাপতি, বাপা

ঢাকা মহানগরীর প্রথম ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) ৬৬ শতাংশ প্লাবন ভূমি ও জলাধার সংরক্ষণের অঙ্গীকার করা হয়েছিল। তবে বাস্তবে তা মাত্র ১৩ দশমিক ১০ শতাংশে কমে এসেছে। জলাধার সংরক্ষণের পরিবর্তে ভূমি উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনাকে

ভেস্তে দিয়েছে। উন্নয়নের নামে এ ভূমি দখল প্রক্রিয়ায় ডেভেলপারদের দুর্বৃত্তায়নই প্রধান ভূমিকা পালন করছে।

এখনো আমরা সারা দেশে নদী ও জলাধারের একক অভিভাবক তৈরি করতে পারিনি। নদী কমিশনকে শক্তিশালী, স্বশাসিত ও অর্থায়নপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে এ কমিশনকে আইনগত ক্ষমতা দিতে হবে, যেন তারা জলাধার, জলাশয় ও নদীগুলোর দায়িত্ব সুনির্দিষ্টভাবে পালন করতে পারে।

রাজউক ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড থেকে সরিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দায়িত্বশীল সংস্থা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নদী ও জলাধারের দুর্নীতি, দখল ও উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংসে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখতে হবে। আমাদের সবার লক্ষ্য হতে হবে পরিকল্পিত ও টেকসই নগরায়ণ, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশের সুরক্ষা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে।

মো. মুস্তাফিজুর রহমান

উপ নগর–পরিকল্পনাবিদ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)

আমাদের দেশে ভূমির মালিকানা ও উন্নয়ন স্বত্ব নিয়ে একটি বড় সমস্যা রয়েছে। জমির মালিকেরা মনে করেন, মালিকানা স্বত্ব মানেই উন্নয়ন স্বত্ব। অথচ অন্যান্য অনেক দেশে উন্নয়ন স্বত্ব আলাদা কিনতে হয় এবং তা সরকারের নীতিমালার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। আমাদের দলিল রেজিস্ট্রেশনের সময় ‘মালিকানা স্বত্ব মানেই উন্নয়ন স্বত্ব নয়’—এ বিষয়টি স্পষ্ট করে উল্লেখ করা উচিত।

আমাদের ওয়েবসাইটে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত আবাসন প্রকল্পের তালিকা প্রকাশিত রয়েছে। তবে অনেক অনিবন্ধিত প্রকল্প ব্যক্তিগত জমি ব্যবহার করে বিক্রি করে, যেখানে প্রকল্পের কোনো বৈধতা থাকে না। এ ধরনের প্রকল্পগুলো শনাক্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কাজ আমরা ইতিমধ্যে শুরু করেছি।

রাজউক এলাকায় ১১০০ কিলোমিটার ব্লু নেটওয়ার্ক বাস্তবায়নের প্রস্তাব রয়েছে। এর মধ্যে কিছু প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া একটি ডোনার এজেন্সির সহায়তায় পুরো এলাকায় একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরির পরিকল্পনা চলছে, যেখানে জলাশয়, সবুজ এলাকা ও পাবলিক স্পেসের সমন্বয় থাকবে।

পেশাদার নৈতিকতা, জনগণের সচেতনতা ও সরকারের নীতিমালার কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঢাকা শহরের জলবায়ু ও পরিবেশ রক্ষা সম্ভব। জলাশয় রক্ষায় শুধু সরকারি সংস্থার দায়বদ্ধতা যথেষ্ট নয়। পেশাদার, সাধারণ জনগণ ও অন্য সংস্থাগুলোর সহযোগিতা অপরিহার্য। সবাই একসঙ্গে কাজ করলেই এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব।

মোহাম্মদ এজাজ

চেয়ারম্যান, রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার

নদী ও জলাশয় দখল কার্যক্রম শুধু ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ নয়, ঢাকার বাইরের এলাকাগুলোর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। খুলনার ময়ূর নদটি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এ নদীর জায়গায় নতুন শহর গড়ে উঠেছে। ফলে খুলনায় জলাভূমি ও পরিবেশের ওপর চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে।

ঢাকার আশপাশে জমি ভরাট ও ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষ সচেতন নয়। রাজউকের উচিত স্থানীয় পর্যায়ে নিয়মিত শুনানি ও তথ্য প্রচারের মাধ্যমে তাদের সচেতন করা। হাতিরঝিল প্রকল্পে বড় ধরনের বিনিয়োগ হলেও স্থানীয় মানুষের জন্য এর অ্যাকসেস সীমিত করা হয়েছে। এ ধরনের প্রকল্পে জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে হবে।

জলাশয়ের পরিবেশগত ভূমিকার পাশাপাশি এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বকেও বিবেচনায় নিতে হবে। শুধু পানি বা বন্যা প্রতিরোধের দৃষ্টিকোণ থেকে জলাশয় নিয়ে পরিকল্পনা করলে পুরো ইকোসিস্টেম ধ্বংস হতে পারে। ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) ও ফ্লাড ফ্লো জোনের পরিকল্পনাগুলোতে কমিউনিটির অংশগ্রহণ জরুরি।

জলাশয় রক্ষায় সমন্বিত পরিকল্পনা ও স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণের ওপর জোর দিতে হবে। তথ্যের অভাব ও পরিকল্পনার দুর্বলতার কারণেই জলাশয় রক্ষা আজ চ্যালেঞ্জের মুখে। জলাশয় রক্ষা কেবল আইন বা পরিকল্পনার বিষয় নয়; জনসচেতনতা, জনসম্পৃক্ততা ও সঠিক পরিচালনার সমন্বয়ে জলাশয় রক্ষা সম্ভব।

শামসুল হক

সাধারণ সম্পাদক, নদী ও পরিবেশ উন্নয়ন পরিষদ, সাভার

নদী রক্ষা, খাল-বিল সংরক্ষণ ও টেকসই নগর উন্নয়নের জন্য আমাদের কঠোর আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। জনগণকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বা মিথ্যার আবরণে কার্যক্রম চালিয়ে আর সামনে এগোনো সম্ভব নয়।

 সাভারের নদী, খাল-বিল সব ধ্বংস হয়ে গেছে। ফসলের জমি হারিয়ে গেছে। কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও তাদের সহযোগী আমলাদের কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। সাভারের পরিবেশ ও নগরায়ণের বর্তমান চিত্র, নদী, খাল, বিল, ফসলি জমি ধ্বংসের জন্য প্রভাবশালী গোষ্ঠী ও তাদের সহযোগী আমলারা দায়ী। এসব বন্ধ করতে হলে কোনো দিক না দেখে আইনের কঠোর বাস্তবায়ন করতে হবে।

মধুমতি টাউন প্রকল্প নিয়ে আদালতের রায় আমাদের পক্ষে থাকলেও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর কারণে জনগণকে ঢাল বানিয়ে আন্দোলন সৃষ্টি করার আশঙ্কা আছে। এ ধরনের ঘটনা আমাদের সতর্ক হতে বাধ্য করে। আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই। তাতে জনগণের একাংশ কষ্ট পেলেও, টেকসই উন্নয়নের জন্য এ পদক্ষেপ জরুরি।

তৃণমূল পর্যায়ের সমস্যা সমাধানের জন্য একসময় ‘বটম-আপ’ পদ্ধতির কথা বলা হলেও, বর্তমানে বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। এই মুহূর্তে আমাদের ‘টপ-ডাউন’ পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। সুন্দর পরিকল্পনার সঙ্গে আইন প্রয়োগের সঠিক পদ্ধতি ছাড়া আমরা এ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারব না। সময় এসেছে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার।

তাসলিমা ইসলাম

প্রধান নির্বাহী (ভারপ্রাপ্ত), বেলা

এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স ২০২২ অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭৫তম। জলাধার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমরা ১১২তম অবস্থানে আছি। গত ৮ বছরে ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) ১৫৮ বার পরিবর্তন হয়েছে। যার মধ্যে শুধু জলাধার সংক্রান্ত পরিবর্তন হয়েছে ৩৪ বার।

ড্যাপে জলাধারকে মুখ্য ও সাধারণ জলস্রোত হিসেবে বিভক্ত করা হয়েছে। ড্যাপে দেখানো জলস্রোতের ৭০ শতাংশ সাধারণ জলস্রোত। শর্তসাপেক্ষে এসব ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে বলে ড্যাপে উল্লেখ করা হয়েছে। এ শর্তের ফাঁকে আমরা সব জলাধার হারাব।

মুখ্য ও সাধারণ জলস্রোত হিসেবে ড্যাপে জলাধারের এ বিভক্তি দেশের প্রচলিত আইনের (ওপেন স্পেস অ্যান্ড ওয়েটল্যান্ড প্রটেকশন আক্ট-২০০০) সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমাদের দেশের বেশির ভাগ আইন অনেক পুরোনো। বেলার এক গবেষণায় এসেছে, বাংলাদেশের দুই শতাধিক আইন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এর মধ্যে ২৫ থেকে ৩০টি আইনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জলাধারের কথা বলা হয়েছে। আইনের ক্ষেত্রে আমরা অনেক সমৃদ্ধ; কিন্তু এসব আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান বেশ দুর্বল।

জলাধার সংরক্ষণে আমাদের আইনগুলো হালনাগাদ করতে হবে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বা অপরাধের দণ্ড আরও বৃদ্ধি করে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা দরকার। জলাধার রক্ষার কৌশল, ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনায় বাস্তুসংস্থানিক ও আর্থসামাজিক অবস্থা বুঝতে কমিউনিটির অন্তর্ভুক্তি জরুরি। এ সংশ্লিষ্ট সরকারের বিভিন্ন দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয় জরুরি। নদী একটি জীবন্ত সত্তা। তাই খাল, বিল, নদী রক্ষা করতে হবে এবং অবৈধ স্থাপনাসমূহ উচ্ছেদ করতে হবে।

সুপারিশ

  • জলাধার সংরক্ষণে জলাধারের সঠিক সীমারেখা নির্ধারণ করা জরুরি।

  • জলাভূমি সংরক্ষণে প্রতিটি উপজেলায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় অন্তত একটি জলাধার রাখতে হবে।

  • দেশের আইন, পরিবেশ নীতি ও জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা নীতির কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে নগর জলাশয় রক্ষা করা দরকার।

  • ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ ও টেকসই জীবন নিশ্চিত করতে জলাশয় রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

  • জলাশয় ভরাট করে উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধে আইনের হালনাগাদ করতে হবে।

  • জলাশয়ের পরিবেশ ভূমিকার পাশাপাশি এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বকে বিবেচনায় নিয়ে আইন, নীতিমালা, কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা সাজাতে হবে।