
‘আমার মন ভালো নেই।
কেন?
জানি না।
আমি একজনকে ভালোবাসি।
সে কে?
কী করে বিল? আমি কি তাকে দেখেছি?
—বুদ্ধদেব বসু’
কথা কটা লেখা তার দরজার পাল্লায়, ভেতর দিকে, একটা আর্টকার্ডের ওপরে, সিগনেচার কলম দিয়ে।
লেখাটা চোখে পড়ল মুমুর।
মুমু পড়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইংরেজি সাহিত্যে। জাহাঙ্গীরনগরের বাসে করে সে ঢাকায় এসেছে, নীলক্ষেতে নেমেছে, তারপর একটা রিকশা নিয়ে তারা দুজন, মুমু আর শহীদ—এসেছে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি হলের ১২০৫ নম্বর রুমে।
এই রুমে মুমুর ছোট ভাই নয়ন থাকে তাদের বগুড়া জিলা স্কুলের এক বড় ভাই শাহিনের সঙ্গে, ডাবলিং করে। এখানে থাকে, আর বুয়েট অ্যাডমিশন কোচিং সেন্টারে ক্লাস করে।
শহীদ মুমুর ক্লাসমেট।
মুমু বলল, ‘শহীদ চল, নয়নের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে। বুয়েটের হলে যাব।’
শহীদ বলল, ‘চল। নিউমার্কেটে আমার কেনাকাটা আছে। একটা বই খুঁজতে হবে।’
শাহিন ভাইকে এর আগে দেখেনি মুমু। ফোর্থ ইয়ারে পড়েন। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং। তবে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মন নেই, কবিতা লেখেন। নয়নের মুখে কথাটা সে শুনেছে।
দরজার লেখাটা পড়ে মুমুর মনটা কেমন করে উঠল।
ফাল্গুন পড়েছে সবে। এখনো শীত শীত ভাব। বাইরে রোদ ঝলমল করছে। শুক্রবারের বেলা ১১টায় হলের ছেলেরা বারান্দায় গামছা হাতে বাথরুমে যাওয়া-আসা করছে।
দোতলার জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, শহীদ স্মৃতি হলের সামনের চত্বরের নারকেলগাছের পাতা রোদ্দুরে চনমন করছে। ক্রিসমাস ট্রিটাই বরং খানিকটা কালো, কিছুটা বিমর্ষ।
মুমুর চোখ পড়ল কাঠের কেবিনেটে। ওটার গায়েও একটা বোর্ডে কী যেন লেখা। পড়ল মুমু, ‘রূপসী ও বিষাদময়ী প্রায় সমার্থক। আর যে নারী চুম্বনযোগ্য, তার চোখ অশ্রুতে মলিন—বুদ্ধদেব বসু।’
নয়ন সামনে আরেকটা বিছানায় বসে। তার টাকার দরকার। বাবা বগুড়া থেকে মানি অর্ডার করে টাকা পাঠিয়েছেন। মুমু তাই দিতে এসেছে ছোট ভাইটিকে।
শহীদ বলল, ‘এই রুমের অরিজিনাল বোর্ডাররা কই?’
নয়ন লুঙ্গি পরে আছে, গায়ে একটা ফুলহাতা পুলওভার। বলল, ‘এই রুমে শুধু শাহিন ভাই থাকে আর আমি থাকি। শাহিন ভাইয়ের রুমমেট ঢাকার ছেলে। শুধু পরীক্ষার সময় হলে থাকে।’
মুমু বলল, ‘শাহিন ভাই কই?’
কী আশ্চর্য! এই কথাটা বলতে গিয়ে গলা কেঁপে উঠল মুমুর।
নয়ন বলল, ‘সকালবেলা উঠে বাইরে গেছে। কী জানি, প্যান্ট পরেই গেছে। মনে হয় এখন আর আসবে না।’
শাহিন ভাইয়ের গল্প নয়নের কাছে অনেক শুনেছে মুমু। কিন্তু কোনো দিন তাকে চোখে দেখেনি।
তাহলে কি নয়নও শাহিন ভাইয়ের কাছে তার গল্প করেছে? দরজায় শাহিন ভাই যে লিখে রেখেছেন, ‘আমি একজনকে ভালোবাসি, কাকে, কী করে বলব, তাকে কি আমি দেখেছি?’—এটা কি তাহলে মুমুর কথা ভেবে...
নয়ন ফোন করেছিল মুমুকে। কয়েনবক্স ফোন। হলের গেটে একটা কয়েনবক্স ফোন আছে। তাতে সিকি ভরে ফোন করতে হয়। সেই ফোন গেছে মুমুর হলের গেটে। দারোয়ান মুমুকে ডেকে দিয়েছে।
‘আপা, তুমি শহীদ স্মৃতি হলে আসো। টাকা দিয়ে যাও।’
মুমু বলল, ‘তুই চলে আয়। তোকে আমাদের জাহাঙ্গীরনগরের ক্যাফেটেরিয়ায় স্পেশাল খিচুড়ি খাওয়াব।’
‘না না, তুমি আসো। শাহিন ভাই তোমাকে দেখতে চেয়েছেন...’
শাহিন ভাই দেখতে চেয়েছেন, এই কথাটা আজ সারাটা পথে, বাসের ভেতরে সে যখন বসে ছিল—মুমুর মাথায় জলের মতো ঘুরে ঘুরে পাক তুলেছিল। মুমু কথাটা এড়াতে পারেনি। আসার আগে তাই যত্ন করে মুমু একটু সেজেও এসেছে। গতকাল বিকেলেই চুলে শ্যাম্পু করেছে সে।
মুমু আজ আসবে শাহিন ভাই কি সেটা জানেন না? তাহলে প্যান্ট পরে বাইরে গেলেন কেন?
মুমু তার ডায়েরিতে কথাটি টুকে নিল, ‘আমার মন ভালো নেই। কেন? জানি না। আমি একজনকে ভালোবাসি। কাকে? কী করে বলব। তাকে কি আমি দেখেছি?’ আরেকটা পৃষ্ঠায় লিখল ওই কথাটিও, ‘রূপসী ও বিষাদময়ী প্রায় সমার্থক, এবং যে নারী চুম্বনযোগ্য তার চোখ অশ্রুতে মলিন।’
শহীদকে মুমু বলল, ‘সুন্দর না কথাগুলো!’
শহিদ মাথা নাড়ল।
শাহিন ভাইয়ের সঙ্গে মুমুর দেখা হলো আরও দুই মাস পরে, আরেক শুক্রবারে।
নয়ন রুমে ছিল না। মুমু চলে এসেছে শাহিন ভাইদের হলের গেটে।
গার্ড আসলাম চিৎকার করে বলল, ‘শাহিন স্যার, আপনার গেস্ট।’
দোতলা থেকে নামল শাহিন। ভাগ্যিস, লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পরে নিয়েছিল।
দেখেই চিনল শাহিন-মুমুকে। নয়নের অ্যালবামে মুমুর ছবি সে দেখেছে।
তারও বুক কাঁপছে। কম্পিত গলায় মুমুকে সে বলল, ‘নয়ন তো রুমে নাই। মনে হয়, ফটোকপি করতে বকশীবাজার গেছে। চলেন, গেস্টরুমে বসি। আসলাম ভাই, দুটো সেভেনআপ এনে দেন না!’
মুমু আর শাহিন ঢুকল গেস্টরুমে। ছোট্ট একটা গেস্টরুম। দুইটা সোফা মাত্র এঁটেছে, মেরুন রঙের গদি। জানালার পর্দাও মেরুন। শাহিন জানালা খুলে দিল, পর্দা সরিয়ে দিল। বলল, ‘কেমন গুমোট হয়ে আছে গেস্টরুমটা, আর কী রকম মশা।’ বাতি জ্বালাল এরপর।
‘আপনি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ছেন; আমার খুব ঈর্ষা হচ্ছে, আমি তো কবিতা লিখি, কিন্তু পড়ি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং।’ বলল শাহিন।
মুমু বলল, ‘যে কবিতা লেখে, তাকে ইংরেজি সাহিত্য পড়তে হয় না।’
শাহিন বলল, ‘না না, বাংলা ভাষার সব বড় কবি ইংলিশ লিটারেচার পড়েছেন—বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক...’
মুমু বলল, ‘বুদ্ধদেব বসু আপনার খুব প্রিয়? আপনার দেয়ালে লিখে রেখেছেন?’
‘হ্যাঁ।’
বুদ্ধদেব বসুর ওই কোটেশনটা আমি আমার ডায়েরিতে টুকে রেখেছি।
‘কোনটা?’
‘আমার মন ভালো নেই। কেন? জানি না। আমি একজনকে...’ এই পর্যন্ত বলে মুমু থামল। তারপর বলল, ‘কাউকে ভালোবাসার জন্য তাকে দেখার দরকার পড়ে না?’
শাহিন বলল, ‘বুদ্ধদেব বসুর একটা কবিতা আছে, জানালায় এক জোড়া হাত দেখেছেন মাত্র, সেই হাতজোড়া দেখেই কবিতা লিখে ফেলা সারা। কবিতা লেখার জন্য যে ভালোবাসা, তার জন্য দেখা হওয়ার দরকার পড়ে না।’
মুমু চুপ।
শাহিন চুপ।
মুমু দেখল, ছেলেটার চুল কোঁকড়া, এলোমেলো, চোখে ভারী চশমা, মনে হচ্ছে সারাক্ষণই পড়ে, ইন্টেলেকচুয়াল। মুমুর ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে।
শাহিন দেখল, মেয়েটি শ্যামলা, তীক্ষ্ণ নাক, ভরা জলে ভরা দুটো বড় বড় চোখ, চুল ছেড়ে দেওয়া, হালকা নীল কামিজ, সাদা সালোয়ার, পায়ের পাতা দুটো...কালো স্যান্ডেলের দু-ফিতায় পা দুটোকে অপ্সরীর পা বলে মনে হচ্ছে।
‘আপনি দেখতে খুব সুন্দর’ শাহিন বলল।
মুমু মাথা নিচু করল। তার দু-চোখ ফেটে জল ঝরছে।
‘কাঁদছেন কেন?’
‘আমার ডায়েরির এই লাইনটা...আমি পড়তে পারব না। আপনি পড়ুন।’
শাহিন হাত বাড়িয়ে ডায়েরিটা নিল, ‘রূপসী ও বিষাদময়ী প্রায় সমার্থক। যে নারী চুম্বনযোগ্য তার চোখ অশ্রুতে মলিন।’
মুমুর চোখে জল। এখন কি শাহিনের উচিত মুমুকে চুমু খাওয়া? জীবনেও সে কোনো মেয়ের হাত ধরেনি। আর আজ একটা মেয়েকে প্রথম দেখায় সে ধপ করে চুমু খেতে পারে?
‘কাঁদছেন কেন?’ মুমুকে বলল শাহিন।
মুমু বলল, ‘জানি না কেন। আমার মন ভালো নেই, কেন, সে কি আমি জানি।’
শাহিন হাসল।
মুমু বলল, ‘গত সপ্তাহে আমি শহীদকে “হ্যাঁ” বলে দিয়েছি। শহীদ আমার ক্লাসমেট। এর আগের দিন আপনার এখানে এসেছিল। অনেক দিন ধরেই প্রপোজ করছিল আকারে-ইঙ্গিতে। সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। গত সপ্তাহে ওর জন্মদিন ছিল। বলল, বার্থডেতে একটা গিফট চাই। দিবি? না করি কী করে বলেন?’
শাহিনের মন খারাপ। সে ছাদে গিয়ে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আছে। চৈত্র মাস। আকাশে অনেক তারা।
সে বিড়বিড় করে বলল, ‘এই রাত তারকাখচিত আর সে আমার পাশে নাই। আজ রাতে আমি লিখে ফেলতে পারি বিষণ্নতম পঙ্ক্তিমালা...
সত্য বটে আজ আর আমি তাকে ভালোবাসি না, কিন্তু একসময় কী ভীষণ ভালোই না তাকে বেসেছিলুম।
ভালোবাসা ক্ষণিকের, ভুলে যাওয়া এত দীর্ঘ!’ (Love is so short, forgetting is so long)
সবই পাবলো নেরুদার লাইন...ধুরো, ভালোবাসা না-বাসা, দেখা না-দেখা, চুম্বনযোগ্য অশ্রুমাখা মলিন মুখখানা—এসব কিছুর ভার শাহিনের মনের ওপরে চাপ ফেলেছে, আর সে কথা বলছে কবি পাবলো নেরুদার ভাষায়...কেন?
মুমু গতকালও এসেছিল, শহীদকে নিয়ে, শাহিন তাদের দেখেছে, হুডখোলা রিকশায়...দূর থেকে...
এই রাত তারকাখচিত আর সে আমার পাশে নাই...
(আমার কবিবন্ধু শাহিন দুটো কবিতার বই বের করেছিল। পরে, অন্য অনেক ইঞ্জিনিয়ারের মতো সেও আমেরিকায় চলে যায়। সেখানে সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছে বলে শুনেছি। মুমু কোথায় আছেন আমি জানি না। শাহিনের ডায়েরির কয়েকটি পৃষ্ঠা আমার কাছে এখনো আছে। সেই ডায়েরি অবলম্বনে এই গল্প লিখলাম। পাঠক চাইলে ডায়েরিটির ফটো আমি ফেসবুকে দিয়ে দেব।—লেখক)