
নাসির হোসেন উইকেটটা পেয়ে দারুণ খুশি। কুমার সাঙ্গাকারা এত বড় ব্যাটসম্যান। চার শ রান তো করতে পারলেন না! নাসিরের বলটা লং অন দিয়ে তুলে মারতে গিয়েই বাউন্ডারিতে সোহাগ গাজীর হাতে ক্যাচ।
এর আগের পুরোটাই ইতিহাসে ঠাঁই পাওয়ার মতো এক ক্রিকেট কাব্য। বাংলাদেশের বিপক্ষে দুটিসহ এর আগে ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন আটটি। কাল নবম ডাবল সেঞ্চুরি করে ব্রায়ান লারাকে তো ছুঁলেনই, সাঙ্গাকারা নিজের প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরিটাও করে ফেললেন। এমন একজন ব্যাটসম্যানের উইকেট পাওয়া যেকোনো বোলারের জন্যই আনন্দের। দিন শেষের সংবাদ সম্মেলনে সেই আনন্দ নাসিরের চোখে-মুখে। অবশেষে সাঙ্গাকারাকে তো আউট করা গেল!
জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে গত দুই দিন সাঙ্গাকারাই মূল বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাংলাদেশ দলের সামনে। প্রথম ইনিংসে শ্রীলঙ্কার ৫৮৭ রানের মধ্যে তাঁর একারই ৩১৯ রান! বাকি সবার মিলিত সংগ্রহ ২৬৮। আগের দিন অবিচ্ছিন্ন থাকা ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে কিথুরুয়ান ভিথানাগের সঙ্গে ৯০, সপ্তম উইকেটে অজন্তা মেন্ডিসের সঙ্গে ১০০ এবং শেষ উইকেটে নুয়ান প্রদীপের সঙ্গে ৫৪ রানের জুটিতে সাঙ্গাকারাই টেনে নিয়েছেন দলকে।
নবম উইকেটে সুরাঙ্গা লাকমালের আউটের সময় সাঙ্গাকারার রান ছিল ২৭৭। শেষ ব্যাটসম্যানকে নিয়ে সেখান থেকে ট্রিপল সেঞ্চুরি পূর্ণ করাটা সহজ ছিল না। কিন্তু সাঙ্গাকারা করলেন এবং যেন আগে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েই করলেন। ওই সময়টাতে প্রদীপকে স্ট্রাইকে না আনতে একাই খেললেন বাংলাদেশি বোলারদের বেশির ভাগ বল। সাকিব-সোহাগকে ড্রাইভ করে কখনো বল পাঠালেন লং অফে, কখনো মিড উইকেটে। কিন্তু ওভারের শেষ বল বা বড়জোর এর আগের বল ছাড়া দৌড়ে রানই নিচ্ছিলেন না সাঙ্গাকারা। ফিল্ডাররা হেলতে-দুলতে বল নিয়ে কিপার-বোলারের কাছে থ্রো করছেন, সাঙ্গাকারা তবু নিজের ক্রিজে অটল। ওই সময় বাংলাদেশ দলের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক তামিম ইকবালের ফিল্ডিং সাজানোটাও ছিল অদ্ভুত। কোথায় ফিল্ডিং গুটিয়ে এনে মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করবেন ব্যাটসম্যানের ওপর, তা নয়, সব ফিল্ডার ছড়িয়ে দিলেন বাউন্ডারিতে! ডান হাতের কড়ে আঙুলে পাওয়া আগের দিনের চোটটা কাল ব্যথা বাড়ানোতে সারা দিনে ফিল্ডিং করতে নামেননি অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম। দলের দায়িত্ব তাই ছিল সহ-অধিনায়ক তামিমের কাঁধে।
তামিমের ও রকম ফিল্ডিং সাজানোর পরও সাঙ্গাকারা ছিলেন ধীরস্থির। যেন মিরপুরের একাডেমি মাঠে ম্যাচ পরিস্থিতিতে ব্যাটিং অনুশীলন করছেন কেউ! কিংবা পণ করেছিলেন ট্রিপল সেঞ্চুরির আগে চার-ছক্কা ছাড়া রানই নেবেন না।
দ্বিতীয়টাই হবে হয়তো। ব্যক্তিগত ২৮৬ রান থেকে ট্রিপল সেঞ্চুরিতে গেলেন শুধুই চার আর ছয় মেরে। সাকিবের করা ওই ওভারের তৃতীয় বলে মিড উইকেট দিয়ে চার মেরে প্রথমে অতিক্রম করে গেলেন টেস্ট ক্রিকেটে নিজের সর্বোচ্চ রানের (২৮৭) মাইলফলকটা। পরের বলে লং অনের ওপর দিয়ে ছক্কা মেরে ২৯৪, এর পরের বলে মিড উইকেট দিয়ে আবারও ছক্কা হাঁকিয়ে পূর্ণ করলেন ক্যারিয়ারের প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরি। বাংলাদেশ দলের একটা গর্বও শেষ হয়ে গেল ওই ছক্কাতে। টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে এক বাংলাদেশের বিপক্ষেই এত দিন কোনো ডাবল সেঞ্চুরি ছিল না। এবার সেটাও হলো। সাঙ্গাকারার ৩১৯ বাংলাদেশের মাটিতে কোনো ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানও।
সাঙ্গাকারার ব্যাটের নিচে চাপা পড়ে গেছে টেস্টে সাকিব আল হাসানের ১১তম পাঁচ উইকেট পাওয়ার সাফল্য। অবশ্য সাকিবের ওপর দিয়ে সাঙ্গাকারা-ঝড়টাও কম যায়নি। ৩১৯ রানের মধ্যে চার ৩২টি ও ছক্কা ৮টি। ৮ ছক্কার ৫টিই সাকিবের বলে।
সাঙ্গাকারার অমন ব্যাটিং দেখার পরও দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুটা বাংলাদেশ দল করল বাজেভাবে। সুরাঙ্গা লাকমলের করা দিনের চতুর্থ বলেই বোল্ড তামিম। বলটা নিচু হয়ে গিয়েছিল একটু, আর তামিম তো জায়গায়ই দাঁড়িয়ে থাকলেন। পরে পরিস্থিতি ভালোই সামলে নিয়েছেন আরেক ওপেনার শামসুর রহমান ও দুই বছর পর টেস্ট খেলতে নামা ইমরুল কায়েস। ৮৬ রানের জুটিতে অবিচ্ছিন্ন আছেন দুজনে। অবশ্য দুই ব্যাটসম্যানই একবার করে আউট হওয়ার সুযোগ দিয়েও বেঁচে না গেলে দিনের শেষে হতাশার গানই বাজত বাংলাদেশ ড্রেসিংরুমে। ব্যক্তিগত ৩১ রানের সময় অজন্তা মেন্ডিসের বলে মিড অনে ইমরুলের সহজ ক্যাচ ছেড়েছেন প্রদীপ। দিলরুয়ান পেরেরার বলে স্লিপে জয়াবর্ধনের হাত থেকে শামসুর জীবন পেয়েছেন ব্যক্তিগত ৩৭ রানের সময়। জীবন ফিরে পাওয়ার পরও দুই ব্যাটসম্যান যে রকম চালিয়ে খেলছিলেন, সেটা আজও বজায় থাকলে কুমার সাঙ্গাকারার অমন শিক্ষণীয় ইনিংসটা কেবল উপহাসই করবে বাংলাদেশ দলের ব্যাটসম্যানদের।
দ্বিতীয় দিন শেষে
শ্রীলঙ্কা ১ম ইনিংস: ৫৮৭
বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ৮৬/১