তামিম আনন্দ দিয়েছেন অনেক
তামিম আনন্দ দিয়েছেন অনেক

তামিম, আপনাকে মিস করবে সবাই

তামিম ইকবালের পরিচিতিটা তখনো নাফিস ইকবালের ভাই হিসেবে।

এর আগে ঘরোয়া ক্রিকেটে মারকুটে ব্যাটিং দিয়ে সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন। জাতীয় নির্বাচকেরা তাঁকে উপেক্ষা করতে পারেননি। সুযোগ দিয়েছেন ২০০৭ বিশ্বকাপ দলে। শাহরিয়ার নাফীস তখন প্রতিষ্ঠিত ওপেনার। তামিমের ভূমিকাটা তাঁর সঙ্গীর। কিন্তু সেই বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচেই নাফীসকে তিনি ছায়া বানিয়ে দিলেন। জন্ম দিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে চিরকালীন এক দৃশ্যপটের। ব্রায়ান লারার ত্রিনিদাদে পোর্ট অব স্পেনে জহির খানকে ডাউন দ্য উইকেটে এসে মেরেছিলেন ‘নির্মম’ এক ছক্কা। সেটি গিয়ে বাড়ি খেল স্টেডিয়ামের গ্যালারির ছাদে। নির্মম বলার কারণ, তামিমের সেই ছক্কায় মিশে ছিল জহির খানের প্রতি একধরনের পাল্টা অবজ্ঞা। ১৬ বছর আগের ওই সময়ে তামিমের সেই শরীরী ভাষা এ দেশের ক্রিকেট–অনুরাগীদের কাছে ছিল সম্পূর্ণ নতুন দৃশ্য।

১৬ বছর পর সেই তামিম যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায় নিলেন ১৫ হাজার আন্তর্জাতিক রান নিয়ে, তখন কেন যেন ২০০৭ সালের মার্চ মাসের সেই রাতটি খুব মনে পড়ছিল। কেন যেন চোখে ভাসছিল জহির খানকে অবজ্ঞা করে মারা সেই ছক্কার ছবি।

তামিম অনেক গল্পের জন্ম দিয়েছেন, যেগুলো প্রজন্মের স্মৃতি হয়ে টিকে থাকবে চিরকাল

‘নাফিস ইকবালের ভাই’ তামিম নিজের নামেই স্থায়ী আসন গড়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে। পোর্ট অব স্পেনে ভারতীয় বোলারদের নাস্তানাবুদ করে নিজের আগমন ঘোষণা করা সেই তামিম এমন অনেক গল্পের জন্ম দিয়েছেন, যেগুলো প্রজন্মের স্মৃতি হয়ে টিকে থাকবে চিরকাল। এ দেশের ক্রিকেটে হয়তো ভবিষ্যতে তামিমের চেয়েও প্রতিভাবান ক্রিকেটারের আবির্ভাব ঘটবে। কিন্তু পোর্ট অব স্পেন থেকে শুরু করে লর্ডস, ওল্ড ট্রাফোর্ড, ওভাল, ঢাকা—এমন অনেক জায়গায় তামিমের কীর্তিগুলো স্মৃতিমেদুর মুহূর্তের জন্ম দেবে। তামিমের অর্জনগুলো যে ১৫ হাজার রান, তিন সংস্করণেই তিন অঙ্কের সংগ্রহ কিংবা আরও কিছু সংখ্যায় আবদ্ধ করে রাখা যায় না। তামিম আরও বিস্তৃত আরও বড় এক স্মৃতির ক্যানভাস। তামিম একটা প্রজন্মের নস্টালজিয়াও—খেলোয়াড়ের জন্য এর চেয়ে বড় অর্জন আর কী হতে পারে!

সেই মুহূর্তগুলো মনে পড়ছে সবার

মাঝেমধ্যে তামিমের ওপর খুব রাগ হতো। কেন ইনিংসগুলোকে আরও বড় করতে পারেন না? কেন হুট করে আউট হয়ে যান! বীরেন্দর শেবাগকে টেনে তাঁকে নিয়ে কত আক্ষেপই না হয়েছে। মনে হতো, এই তামিম যদি ওয়ানডেতে পুরো ৫০ ওভার কিংবা টেস্টে লম্বা সময়ের জন্য ব্যাটিং করতেন, কত কিছুই না ঘটতে পারত! আজ কেন জানি মনে হচ্ছে, ভাবনাটাই ভুল ছিল। আমরা এসব ভেবে, এসব নিয়ে কথা বলে আসলে তামিমের ক্ষতিই করেছিলাম। তামিমের ব্যাটিংয়ের সৌন্দর্য কিংবা শক্তিমত্তাই ছিল অমন কিছু। ব্যাটিং নিয়ে বেশি কাটাছেঁড়া করে আমরা তাঁকে বাধ্য করেছিলাম খোলসের মধ্যে নিজেকে পুরে ফেলতে। জহির খানকে নির্দয়ভাবে পেটানো, কিংবা লর্ডস, ওল্ড ট্রাফোর্ডে ইংলিশ দর্শকদের মুগ্ধ করে আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে সেঞ্চুরি করা সেই তামিমই ক্যারিয়ারের পরের সময়টায় কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে ফেললেন। তামিম যদি তাঁর গোটা ক্যারিয়ারটাই ওই পোর্ট অব স্পেনের স্টাইলে খেলে যেতেন, তাহলে আন্তর্জাতিক রান হয়তো কম হলেও হতে পারত, কিন্তু আমাদের আনন্দের মাত্রাটা বাড়ত। কে জানে, আক্রমণাত্মক তামিম হয়তো খোলসবন্দী তামিমের চেয়ে আরও বেশি কার্যকর হতেন, হতেন আরও ভয়ংকর! হয়তো হয়ে উঠতেন আরেকজন বীরেন্দর শেবাগ। কে জানে!

বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে ওপেনিংয়ে তামিম একটা ধারার সৃষ্টি করেছিলেন, যা আগে দেখা যায়নি

কিন্তু তামিম শেবাগ হতে না পারলেও দুঃখ নেই। বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে ওপেনিংয়ে তামিম একটা ধারার সৃষ্টি করেছিলেন, যা আগে দেখা যায়নি। তাই নিজেই হয়ে উঠেছেন ‘ট্রেডমার্ক’—তামিম শেষ পর্যন্ত তামিমই হয়ে উঠতে পেরেছেন। সব ক্রীড়াবিদকে নিয়েই কিছু না কিছু আক্ষেপ থাকে, তামিমকে নিয়েও আছে। তবু বাংলাদেশের ক্রিকেটকে তামিম যত দূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন, সে জন্য তাঁকে টুপি খোলা অভিনন্দন। কাল চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলার সময় বাষ্পরূদ্ধ কণ্ঠে বলেছেন, ‘আমি কতটা ভালো খেলোয়াড় ছিলাম, আদৌ ভালো ছিলাম কি না, আমি জানি না। তবে সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছি। আমি যখনই মাঠে নেমেছি, আমি আমার শতভাগ দিয়েছি।’

তামিম, আপনি শতভাগ নয়, আরও অনেক বেশি দিয়েছেন। নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন দেশের জন্য, দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য। রাজকীয় ব্যাটিংয়ে সবাইকে কতটা আনন্দ দিয়েছেন, আপনি নিজেও জানেন না।

আমরা জানি। তাই আমরা আপনাকে মিস করব।