মাঝরাতে সৌরভের ভূতের ভয় এবং ইংল্যান্ডে তাঁর জীবন বাঁচানো সেই মেয়ে

ক্রিকেট মহলে একটা কথা আছে, আপনি যদি স্যার ইয়ান বোথামের আশপাশে থাকেন, আপনার জীবন কখনো একঘেয়ে বা নীরস হতেই পারে না! ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সেরা অলরাউন্ডার, সম্ভবত সেরা ক্রিকেটার এবং অন্যতম সেরা এই ক্রীড়াবিদ তাঁর বন্ধু ও সতীর্থদের কাছে পরিচিত ‘বিফি’ নামে। মাঠে ও মাঠের বাইরে তাঁর মতো বর্ণাঢ্য চরিত্র ক্রিকেট ইতিহাসেই বিরল। ‘বিফি’স ক্রিকেট টেলস: মাই ফেবারিট স্টোরিস ফ্রম অন অ্যান্ড অফ দ্য ফিল্ড’—বইটাও যেন বোথামের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। বন্ধু, সতীর্থ, প্রতিপক্ষ—সবার গল্প নিয়ে বোথামের পছন্দের এক সংকলন।

পাঠকদের জন্য আজ থাকছে ‘বিফি’স ক্রিকেট টেলস: মাই ফেবারিট স্টোরিস ফ্রম অন অ্যান্ড অফ দ্য ফিল্ড’ বই থেকে সাবেক ভারত অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলীর কয়েকটা মজার গল্প—

সৌরভের মুখে তাঁর ইংল্যান্ড সফরের কিছু মজার স্মৃতি

২০০২ সালে ইংল্যান্ড সফর ছিল ভারত অধিনায়ক হিসেবে আমার জন্য কঠিনতম সময়গুলোর একটি।
লর্ডসে (ন্যাটওয়েস্ট) ওয়ানডে সিরিজে (ইংল্যান্ডের বিপক্ষে) ম্যাচ জিতে উদ্‌যাপনের মুহূর্তটা হয়তো অনেকেই মনে রেখেছেন। ওই সময়টায় আমি যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। তবে ওই সফরে আরও একটি ঘটনা আছে, যা আমি কোনো দিন ভুলতে পারব না।

ডারহামে চেস্টার-লে-স্ট্রিটে আমাদের একটি ম্যাচ ছিল। মাঠের পাশেই লামলি ক্যাসল নামে অসাধারণ সুন্দর একটি হোটেল, ওখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। অধিনায়ক হওয়ায় আমি পেলাম একটা বিশাল স্যুট। রাজকীয় ব্যবস্থা, যা যা চাই, সবই ছিল।

পরদিন সকালে খেলা। তাই অনুশীলন শেষে তাড়াতাড়ি চলে এলাম, ডিনার সেরে রুমে ফিরেই শুয়ে পড়লাম। চাইছিলাম পর্যাপ্ত ঘুমিয়ে ম্যাচের জন্য তরতাজা থাকতে। রুমের সব আলো নিভিয়ে পর্দা টেনে বিছানায় গেলাম। আমি আলো জ্বেলে একেবারেই ঘুমাতে পারি না।

ইংল্যান্ডে প্রথম সফরের সময় সৌরভ গাঙ্গুলী

ঘুমের মধ্যেই হঠাৎ কানে এল বাথরুমের কল থেকে পানি পড়ার শব্দ। ঘুম ভেঙে গেল। উঠে আলো জ্বালালাম এবং কল বন্ধ করতে গেলাম। গিয়ে দেখি সব কল তো বন্ধই! ভেবেছিলাম হয়তো স্বপ্ন দেখেছি বা পাশের ঘর থেকে এসেছে শব্দ। আবার ঘুমোতে গেলাম।

প্রায় আধঘণ্টা পর আবার পানি পড়ার শব্দে ঘুম ভাঙল। তাড়াতাড়ি উঠলাম এবং কল বন্ধ করতে গেলাম। এবারও একই ব্যাপার, কল তো বন্ধই ছিল! এবার ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত লাগছিল। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এবার মনে হলো, আলো জ্বালিয়েই শুয়ে পড়ি। কিন্তু আলো জ্বালানো থাকায় আর ঘুমই এল না। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, এসব আমার মনের ভুল। কিন্তু লাভ হলো না। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিলাম। সব বন্ধ করে আবার চোখ বুজলাম।

তৃতীয়বার যখন জল পড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল, লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে রুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম। সত্যি বলতে, আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সোজা রবিন সিংয়ের রুমে গেলাম। দরজায় নক করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার রুমে এসে থাকতে পারি?’ সে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’ এখন অধিনায়ক হয়ে তো আমি বলতে পারি না যে ভূতের ভয় পেয়েছি! তাই বললাম, আমার রুমের হিটার নষ্ট, ভেতরে গরম লাগছে। তাই তোমার রুমে থাকতে চাই, মেঝেতে শুয়ে থাকব।  
রবিন ভীষণ ভদ্রভাবে বলল, ‘আরে, কোনো সমস্যা নেই! কিন্তু আপনি কেন মেঝেতে শোবেন? আমার বিছানায় শুয়ে পড়ুন, আমি মেঝেতে শুচ্ছি।’ আমি বললাম, ‘না না, আমি মেঝেতেই শুচ্ছি।’ সে যে আমাকে থাকতে দিয়েছিল, তার জন্য আমি সত্যিই তার কাছে কৃতজ্ঞ।

রবিন সিং ও সৌরভ গাঙ্গুলী

এর পর থেকে আমি আর কখনো লামলি ক্যাসলে থাকিনি। পরে শুনেছিলাম, ২০০৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়া দলের খেলোয়াড়দের ওই হোটেলে একই রকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল। শুনে বেশ হেসেছিলাম। হয়তো লামলির ভূতটা বন্ধুসুলভই ছিল, তবে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার সাহস আমার ছিল না।

এবার অন্য একটা গল্প। একবার ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে ডারহামে খেলছিলাম। আমার মা–বাবা আমাকে দেখতে লন্ডনে আসবেন। কিন্তু আমি তাঁদের বিমানবন্দর থেকে নিয়ে আসার জন্য কোনো ব্যবস্থা করতে ভুলে গেলাম। মনে হলো, আমারই যাওয়া উচিত। কিন্তু ডারহাম থেকে লন্ডনের হিথরো অনেক দূরের পথ। তার ওপর তখন আমার খেলা চলছিল। কী আর করা! সন্ধ্যা ৬টায় দিনের খেলা শেষ হলো। গাড়িতে উঠে সোজা হিথরো গেলাম। মা–বাবাকে নিয়ে রাত ৩টায় ডারহামে ফিরলাম। পরদিন তো আবার খেলা ছিল। বলা বাহুল্য, ওই দিনটা খুব একটা ভালো কাটেনি।

আমার জীবনের অন্যতম ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডে। যার পর থেকে এখন ইংল্যান্ডে গেলে আমি প্রায় সব সময় নিজেই গাড়ি চালাই। ঘটনাটা ১৯৯৬ সালের। ইংল্যান্ডে আমার প্রথম সফর। আমরা পিকাডিলির ক্যাভেন্ডিশ হোটেলে ছিলাম। এক বিকেলে কিছুটা সময় ফাঁকা পেলাম। উত্তর লন্ডনের পিনারে কিছু আত্মীয়স্বজন থাকত। ভাবলাম, ওদের সঙ্গে দেখা করে আসি। নভজ্যোৎ সিং সিধু বললেন, তিনিও আমার সঙ্গে যাবেন।

সৌরভ গাঙ্গুলী ও নভজ্যোৎ সিং সিধু

পিনারে যেতে আমরা টিউবে উঠলাম। আমাদের কামরায় একদল কিশোর-কিশোরী ছিল, দুটি ছেলে ও তিনটি মেয়ে। ওরা মদ খাচ্ছিল। আমরা বসেছিলাম ওদের উল্টো দিকে। দেখলাম, তাদের মধ্যে একটা ছেলে বিয়ার খেতে খেতে আমাদের দিকে কীভাবে যেন তাকাচ্ছে।

ছেলেটাকে আমার ভালো লাগছিল না। তাই অন্যদিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম। ট্রেন চলছে। কেন জানি মনে হলো ছেলেগুলো বেশ ছটফট করছে। হঠাৎ ছেলেটা তার বিয়ার শেষ করে ক্যানটা সোজা আমাদের দিকে ছুড়ে মারল। আমি শান্ত থেকে সিধুকে বললাম, ঝামেলায় যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু সিধু রেগে গিয়ে ছেলেটাকে কিছু একটা বলে বসলেন। বুঝলাম, ঝামেলা হতে চলেছে। চশমাটা খুলে রাখলাম এবং যা হতে যাচ্ছে তার জন্য প্রস্তুত হলাম। কয়েকটা ঘুষি চালাচালি হলো।

ট্রেন যখন পরের স্টেশনে পৌঁছাল, আমি ছেলেটাকে ধাক্কা দিলাম এবং সে পড়ে গেল। উঠে দাঁড়ানোর পর দেখি সেই ছেলে আমার মুখের সামনে একটি বন্দুক তাক করে আছে। মুহূর্তের জন্য মনে হলো, এখানেই শেষ, এই ট্রেনের ভেতরেই আমার জীবন শেষ হতে চলেছে।

ঠিক তখনই একটা শক্তপোক্ত মেয়ে ছেলেটার হাত থেকে বন্দুকটা ছিনিয়ে নিল এবং টেনে তাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দিল। আমি তখনো কাঁপছি, খুবই ভয় পেয়েছিলাম। একটু এদিক-ওদিক হলে হয়তো আজ এই গল্পটা বলার সুযোগই থাকত না।

এর পর থেকে আমি ইংল্যান্ডে গেলে নিজেই গাড়ি চালাতাম। ল্যাঙ্কাশায়ারে খেলার সময় গাড়ি ছিল প্যাকেজের অংশ। মাঠের পাশেই ওল্ড ট্র্যাফোর্ড ফুটবল স্টেডিয়ামের খুব কাছে একটি ফ্ল্যাটে থাকতাম। মাঝেমধ্যে খুব একা লাগত, কারণ ইংল্যান্ডে আমার বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সদস্যরা থাকত পিনারে।

এক বৃহস্পতিবার আমি ভাবলাম পরিবারের সঙ্গে দেখা করে আসি। আমাদের পরের ম্যাচ ছিল রোববার। ঠিক করলাম, শনিবার রাতেই ফিরে আসব। তো শনিবার রাতে একটা ছোটখাটো পারিবারিক আয়োজন ছিল। তাই ভাবলাম, রাতে থেকে যাই এবং পরদিন সকালে খুব ভোরে উঠে ম্যানচেস্টারে ফিরে যাব। সকাল সাড়ে ছয়টার মধ্যে রওনা হলে ১১টায় খেলার আগে সহজেই পৌঁছে যাব। অ্যালার্ম দিয়ে শুয়ে পড়লাম।

ইংল্যান্ডে গেলে এখন নিজেই গাড়ি চালান সৌরভ

সকাল সাড়ে আটটায় আমার মামা চা হাতে এসে ঘুম ভাঙালেন। আমি অ্যালার্ম মিস করেছি। তাড়াহুড়া করে গাড়ি নিয়ে বের হলাম। কোচ বব সিম্পসন যদি আমাকে বাদ দেন, এই ভয়ে পাগলের মতো গাড়ি চালাতে লাগলাম। অ্যাক্সিলারেটর চেপে যাচ্ছি এবং প্রার্থনা করছি, যেন ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারি।

১০টার দিকে ফোন এল, আমি কোথায়। বললাম, ম্যানচেস্টারেই আছি, তবে ট্রাফিক একটু বেশি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাব। আবার ফোন এল সাড়ে ১০টায়। এবার জিজ্ঞেস করা হলো কোথায় আছি এবং ওয়ার্ম-আপ কেন মিস করছি। আমি বললাম, ‘ভয়ংকর যানজট!’ আমাকে বলা হলো, সাড়ে ১১টার মধ্যে পৌঁছালে দলে থাকব, না হলে বাদ। ভেবেছিলাম, হয়তো পৌঁছাতে পারব না। তারপরও আমার মার্সিডিজ গাড়ি থেকে শেষ শক্তিটুকু নিংড়ে নিলাম। ঠিক ১০টা ৪৪–এ গাড়ি পার্কিংয়ে পৌঁছালাম।

বব সিম্পসন বুদ্ধিমান মানুষ। মাঠে নামার ঠিক আগে তিনি আমাকে বললেন, ‘এই সময়ে হাইওয়েতে খুব বাজে যানজট হয়, তাই না সৌরভ?’
‘হ্যাঁ, কোচ, খুব বাজে,’ আমি একটু নার্ভাস।
‘বিশেষ করে এম-১ হাইওয়ে, তাই না?’
‘হ্যাঁ, বিশেষ করে এম-১, কোচ।’
তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বুঝতে পারলাম, ধরা পড়ে গেছি। তিনি ঠিকই জানেন আমি কেন দেরি করেছি, আমাকেও সেটা বুঝিয়ে দিলেন। তবে কোচ আমাকে কোনো বকা দেননি বা পরে এ নিয়ে আর কোনো কথা বলেননি।
কিন্তু আমি বুঝেছিলাম, এটা আমার জন্য একটি সতর্কবার্তা।
এরপর আর আমি কোনো দিন দেরি করিনি। অন্তত বেশ কিছুদিন পর্যন্ত!