১৯৯৫ সালের ঘটনা। ইমরান খান ক্যানসার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পরের বছর। পাকিস্তানে তখন ক্যানসারের চিকিৎসায় বিশেষায়িত একটাই হাসপাতাল—শওকত খানুম মেমোরিয়াল।
ইমরান খান সেদিন শিশুদের বিভাগটা ঘুরে দেখছিলেন। হঠাৎ এক বয়স্ক নারী তাঁকে থামালেন। কমলা রঙের ময়লা শাল জড়ানো নারীটিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, গ্রাম থেকে এসেছেন। তাঁর ছেলে ক্যানসারে আক্রান্ত। চিকিৎসা শুরু করতে করতে সময় ফুরিয়েছে। এখন আর তাকে বাঁচানো সম্ভব নয়।
নারীরও আর কোনো সহায়–সম্বল নেই। ছেলেকে বাঁচাতে জীবনের সব সঞ্চয় শেষ। শুরুতে ছেলেকে ভর্তি করেছিলেন লাহোরের সরকারি হাসপাতালে। চিকিৎসার পাশাপাশি ওষুধপথ্যের খরচ জোগাতে হয়েছে, ঘুষও দিতে হয়েছে চিকিৎসককে—যেন হাসপাতালের ভিড় ঠেলে তাঁর ছেলেকে একটু আগেই দেখা হয়। দেখা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু লাভ হয়নি। শেষ ভরসা হিসেবে যখন তিনি এসে পৌঁছান শওকত খানুম হাসপাতালে, তখন তাঁর হাতে টাকা নেই, ছেলের আয়ুও নেমে এসেছে ঘণ্টায়, বড়জোর দিনে।
‘সাহেব! একটু দ্রুত আসুন, ছেলেটা আমার মারা যাচ্ছে।’
ইমরানের সামনে করজোড়ে অশ্রুসিক্ত চোখে বললেন সেই নারী। ইমরানের পায়ে পড়তে যাচ্ছিলেন, কিন্তু দুজন নার্স তাঁকে থামালেন। এমন পরিস্থিতি ইমরানের অচেনা নয়। সান্ত্বনা–অসহায়ত্বের মিশেলে তিনি বললেন, ‘আমাদের চিকিৎসক আছে, খুব ভালো চিকিৎসক…।’
কিন্তু নারীটি নাছোড়, ‘না, আমার ছেলে সেসবের ঊর্ধ্বে চলে গেছে। ইমরান সাহেব, এখন শুধু আপনিই বাঁচাতে পারেন।’
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হাসপাতালের পরিচালক ড. নশেরওয়ান বুর্কি বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন, ‘এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। লোকে ইমরানের কাছে অলৌকিকতা প্রত্যাশা করে।’
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইনডিপেনডেন্ট ১৯৯৫ সালে এ ঘটনা তুলে ধরে লিখেছিল, ‘পাকিস্তানের অনেকে ইমরান খানকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী মনে করেন। দেশটা ভেঙে টুকরো হওয়ার আগেই তিনি বাঁচাবেন—এটাই তাঁদের বিশ্বাস।’
তত দিনে ইমরান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। মানুষকে তিনি স্বপ্নপূরণ করাতে পেরেছিলেন কি না, সেটা রাজনৈতিক প্রশ্ন। কিন্তু ক্ষমতা হারানোর পরও, জেলে বন্দী থেকেও পাকিস্তানিদের কাছে তাঁর মহিমা যেন আগের মতোই অটুট।
সংবাদমাধ্যমে খবর বের হলো—পেশোয়ারে হাজারো মানুষ ‘৮০৪’ লেখা স্যান্ডেল কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে! কারণ? কারাগারে এটাই ইমরানের কয়েদি নম্বর—‘৮০৪’।
ধীরে ধীরে পুরো পাকিস্তানে ছড়িয়ে গেল সেই স্যান্ডেল।
এর আগেও ২০১৪ সালে, পেশোয়ারের জুতা প্রস্তুতকারক নূর–উদ–দিন ‘কাপ্তান’ নামে স্যান্ডেল বানিয়ে দেশ–বিদেশে পরিচিতি পান। তাঁর দোকানের নামও রাখেন ‘কাপ্তান চপ্পল শপ’। গত বছর ঈদে এই নূর–উদ–দিনই বাজারে ছাড়েন ‘কয়েদি নম্বর ৮০৪’ স্যান্ডেল।
স্যান্ডেলের সঙ্গে হয়তো অলৌকিকতার সম্পর্ক নেই। কিন্তু মুক্তির আছে—ইমরানের মুক্তির দাবিতে মানুষের পায়ে পায়ে সেই স্যান্ডেল হয়ে ওঠে প্রতিবাদের প্রতীক।
জেলখানায় থেকেও মানুষের মনে এমন জোয়ার তোলা—এটাকে কি আর কিছু বলা যায়? হয়তো এটাকেই বলে অলৌকিকতা।
এই বিশ্বাসের শিকড় ইমরানের ক্রিকেট–জীবনে। তাঁর ভেতরের অলৌকিকতা আসলে জন্ম নিয়েছিল মাঠে। সেই গল্পের অনেকটা জানা, তবু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টা বললেই কারণটা স্পষ্ট হয়।
১৯৯২ বিশ্বকাপ।
পাকিস্তানের কি সেবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কথা ছিল? মোটেও না। মাঝারি মানের এক দলকে নিয়ে ইমরান যেন অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছিলেন। প্রথম পাঁচ ম্যাচে মাত্র এক জয়, চোট, কলহ—সব মিলে দল বিপর্যস্ত। বাঁচা–মরার ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টস করতে নামলেন বুকে বাঘ আঁকা টি–শার্ট পরে।
ধারাভাষ্যকার ইয়ান চ্যাপেল জানতে চাইলেন, অমন টি–শার্ট পরার কারণ কী। ইমরান বললেন, তিনি চান তাঁর দল কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ুক।
সেই কথা যেন ম্যাজিকের মতো কাজ করল। ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাকিস্তানের ২৪৯ রানের ইনিংসে সর্বোচ্চ রান ইমরানের (৭২)।
রমিজ রাজা বলেছিলেন, ‘অনেক মানুষ আমাদের জন্য প্রার্থনা করেছিল। নইলে এটা হওয়ার কথা নয়।’
পাকিস্তানের জন্য যত প্রার্থনা ছিল, তার বেশির ভাগই হয়তো ছিল ইমরানের জন্য।
এর আগেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন। তাঁর নীতি ছিল সরল—ফর্মের তুঙ্গে থেকেই অবসর নেবেন। সেই ভাবনায় ১৯৮৭ সালে অবসরও নেন।
কিন্তু জনতার ভালোবাসা তাঁকে ফিরিয়ে আনে। আত্মজীবনী অলরাউন্ড ভিউয়ে ইমরান লিখেছেন, ‘লোকজন আমার বাসার সামনে বসে থাকত। কেউ কেউ অনশনের হুমকি দিত। চিঠির বাক্স ভরে যেত, ফোন থামত না। সবচেয়ে বেশি চাপ আসত দল থেকেই…।’
শেষ পর্যন্ত তাঁকে রাজি করিয়েছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়া–উল–হক।
১৯৮৮ সালের এক ভোজসভায় জিয়া বলেছিলেন, ‘দেশের এখনো তোমাকে প্রয়োজন। কখনো কখনো নিজেকেও ছাপিয়ে যেতে হয়।’
রাষ্ট্রপ্রধানের এমন অনুরোধেই ফিরে আসেন ইমরান। অন্য ভাষায়, জিয়া–উল–হকও তখন সাধারণ মানুষের মতোই ‘জনতার ইমরান’–এর প্রেমে পড়েছিলেন।
আকিব জাভেদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ওই লোকটার কারণেই আমরা বিশ্বকাপ জিতেছিলাম। ইমরান ছিলেন সৎ, সাহসী আর কঠোর পরিশ্রমী—এই তিন জিনিসই তাঁকে বড় নেতা বানিয়েছে।’
লাহোরের জামান পার্ক—ইমরানের শৈশবের ঠিকানা। এখান থেকে উঠে এসেছে চল্লিশেরও বেশি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার, কয়েকজন খেলেছেন টেস্টেও।
ইমরানের মায়ের বংশ ‘বুর্কি’ পরিবার ক্রিকেটে কিংবদন্তি। খালাতো ভাই মাজিদ খান পাকিস্তানের সাবেক টেস্ট অধিনায়ক, নানা জাহাঙ্গীর খান খেলেছেন অবিভক্ত ভারতের হয়ে। আরও আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কেউ অক্সফোর্ড ব্লু, কেউবা হকি দলের অধিনায়ক। বলা যায়, খেলা, বিশেষ করে ক্রিকেট তাঁদের রক্তে।
জামান পার্কে ইমরানের ক্রিকেটে হাতেখড়ি হয় তাঁর খালাতো ভাই জাভেদ জামানের হাতে। সেখানে বয়সের পার্থক্য খুব একটা হিসাব করতেন না কেউ—টেস্ট ক্রিকেটার থেকে শিশু, সবাই একসঙ্গে খেলত। ‘অলরাউন্ড ভিউ’ বইয়ে ইমরান লিখেছেন, সেই প্রতিযোগিতার মাঠই তাঁকে যোদ্ধা বানিয়েছে।
স্বাধীনচেতা মনোভাবটা এসেছে মা–বাবার কাছ থেকে। পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর ইমরানের বাবা–মা দেখেছিলেন, অনেক আমলা ইংরেজদের মতো সাহেবসুলভ আচরণ করছে—সন্তানদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে, পোলো খেলে। ইমরানের বাবা–মা এসবের বিরোধী ছিলেন। সন্তানদের শেখাতেন পাকিস্তানি জাতীয়তা।
১৯৭১ সালে ইংল্যান্ড সফরে তাঁর আন্তর্জাতিক অভিষেক। সেখানে দেখেছিলেন, পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা ইংরেজদের সামনে কেমন হীনমন্যতায় ভোগে। এমনকি দলের ম্যানেজার পর্যন্ত বলেছিলেন, ইংরেজদের কাছ থেকে তারা ‘কীভাবে কাঁটাচামচ দিয়ে খেতে হয়’ শিখেছে!
এই মানসিকতা ভাঙার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন ইমরান। ১৯৮২ সালে অধিনায়ক হওয়ার পর পাকিস্তান দলের ভাবনা বদলে দেন। নিরপেক্ষ আম্পায়ারের প্রবর্তন, ইংরেজদের চোখে চোখ রেখে খেলা—সবকিছুতেই তিনি পথপ্রদর্শক।
আকিব জাভেদ একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের ক্ষেত্রে ‘লিডার’ লেখার সময় “এল” অক্ষরটা বড় করে লিখতে হয়।’
ইমরানের নেতৃত্বের পেছনে ভূমিকা ছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়েরও। সেখানে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি কাউন্টি ক্রিকেটে খেলে নিজেকে তৈরি করেছিলেন। অক্সফোর্ডের অধিনায়কত্ব ছিল নেতৃত্বে তাঁর প্রথম পাঠ।
১৯৭৬–৭৭ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে ঐতিহাসিক সিডনি টেস্টে ম্যাচ জেতানো আগুনে বোলিং করে স্বীকৃতি পান সত্যিকার এক ফাস্ট বোলার হিসেবে। পরে কেরি প্যাকার সিরিজে বিশ্বের দ্রুততমদের সঙ্গে গতি–প্রতিযোগিতায় নামেন—জেফ টমসনের পরই ছিলেন তিনি।
তবে এ লেখার মূল উপজীব্য পরিসংখ্যান নয়। মানুষ ইমরানের ভেতরটা বুঝতে হলে তাকাতে হয় ক্রিকেটের বাইরেও।
জাভেদ মিয়াঁদাদ তাঁর আত্মজীবনী ‘কাটিং এজ’–এ লিখেছেন, ‘ইমরান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরেছিলেন আসলে ক্যানসার হাসপাতালের তহবিল গড়ার জন্য।’
মা শওকত খানুম ১৯৮৫ সালে ক্যানসারে মারা যান। পাকিস্তানে তখন ক্যানসারের কোনো চিকিৎসা–সুবিধা ছিল না। তাই মায়ের নামে হাসপাতাল বানাতে চেয়েছিলেন তিনি।
পল এডওয়ার্ডস তাঁর ‘গ্রেটনেস অ্যান্ড ডেস্টিনি—ইমরান খান: আ ম্যান টু বর্ন’ বইয়ে লিখেছেন, পাকিস্তানের অভিজাত সমাজ ইমরানকে নিরুৎসাহিত করেছিল—কারণ, ‘৭৫ শতাংশ রোগীকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা দিলে হাসপাতাল টিকবে না।’
বাস্তবতা হলো, শওকত খানুম এখন পাকিস্তানের সেরা ক্যানসার হাসপাতাল। লাহোর ও পেশোয়ারে দুটি শাখা, আর ৭৫ শতাংশ রোগী বিনা মূল্যে চিকিৎসা পান।
ক্রিকেট, রাজনীতি, কিংবা বিতর্কিত ব্যক্তিগত জীবন—সবকিছুর ঊর্ধ্বে একটা জায়গায় ইমরান খান অদ্বিতীয়। তাঁর উপস্থিতিই ছিল এক অন্য রকম ঘটনা। ব্রিটিশ সাংবাদিক পিটার ওবর্ন একবার লিখেছিলেন, ‘ক্রিকেটে তাঁর মতো করে বিশ্ব ইতিহাসে জায়গা পাওয়া ব্যক্তিত্ব আর কেউ নেই।’
৭২ বছর আগে আজকের এই দিনে জন্মেছিলেন ইমরান খান।
হয়তো তাঁর জন্ম না হলে, পাকিস্তান কখনোই বিশ্বকাপ জিতত না।