ক্রিকেটের ‘আহত নায়ক’ যাঁরা

এক হাত ব্যান্ডেজে ঝোলানো। সোয়েটারে মোড়ানো। অন্য হাতে ব্যাট। ভারতের বিপক্ষে ওভাল টেস্টের শেষ দিনে ক্রিস ওকসকে দেখে মনে হচ্ছিল কোনো সিনেমার দৃশ্য। যেখানে আহত হয়েও নায়ক লড়ে যাচ্ছেন শেষ শক্তি দিয়ে। আসলে সিনেমার দৃশ্য নয়, এটা ছিল বাস্তব। ক্রিকেট মাঠে এক সাহসী খেলোয়াড়ের গল্প।

বাঁ কাঁধের হাড় নড়ে গিয়েছিল। ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা, তবু দলকে জেতাতে ব্যাট হাতে মাঠে নামেন ওকস। হয়তো এটাই ছিল তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংস। আগামী বছর মার্চে ৩৭-এ পা দেবেন, ইংল্যান্ডের ‘বাজবল’ দলে হয়তো তাঁর জায়গা আর হবে না।

যদি গতকাল শেষ হওয়া ওভাল টেস্টই ওকসের শেষ ম্যাচ হয়ে থাকে, তাহলে তাঁর বিদায়টাও হয়ে থাকবে একেবারে ‘নায়কোচিত’। দলকে জেতাতে পারেননি তো কী হয়েছে, এমন সাহসই বা কজন দেখাতে পারে! ক্রিকেট ইতিহাসে ওকসের মতো এমন সাহসী গল্প লিখেছেন আরও কজন। ব্যথা নিয়ে খেলেছেন, এক হাতে ব্যাট করেছেন, সেই আহত নায়কদের গল্প—

কলিন কাউড্রে (ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ১৯৬৩)

কলিন কাউড্রে

ওভাল টেস্টের মতোই তখন শেষ বিকেল, ম্যাচ প্রায় শেষ। লর্ডস টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের জিততে দরকার ৬ রান, হাতে ৩ বল।  হঠাৎ ডেরেক শ্যাকলেটন রানআউট হয়ে যাওয়ায় হাতে থাকে মাত্র এক উইকেট। আগেই চোট পাওয়া অধিনায়ক কলিন কাউড্রেকে তাই আবার নামতে হয় মাঠে। বাঁ হাত ভাঙা। প্লাস্টার মোড়ানো সেই হাত নিয়েই হাসিমুখে নন-স্ট্রাইকার প্রান্তে দাঁড়ান কাউড্রে। স্ট্রাইকে থাকা ডেভিড অ্যালেন শেষ দুই বল ঠেকিয়ে ম্যাচ ড্র করেন। জিততে পারেনি ইংল্যান্ড, কিন্তু অধিনায়ক কাউড্রে সেই সাহস দিয়ে জায়গা করে নেন ইংল্যান্ড সমর্থকদের মনে।

ম্যালকম মার্শাল (ওয়েস্ট ইন্ডিজ-ইংল্যান্ড, ১৯৮৪)

ম্যালকম মার্শাল

হেডিংলিতে গালিতে ফিল্ডিং করার সময় বাঁ হাতের আঙুল ভেঙে যায় কিংবদন্তি ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ফাস্ট বোলার ম্যালকম মার্শালের। তাতে কী! প্লাস্টার করা হাতে এক হাতে ব্যাট ধরে চার মেরেছিলেন, পরে বল হাতে নিয়েছিলেন ৭ উইকেটও! টেস্টটা ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতেছিল ৮ উইকেটে।

সেলিম মালিক (পাকিস্তান-ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ১৯৮৬)

সেলিম মালিক

নামটা শুনলেই এখন তাঁর ম্যাচ ফিক্সিংয়ের কথা হয়। কিন্তু একসময় এই সেলিম মালিকও দলের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। বাঁ হাত ভাঙা, তবুও ব্যাট হাতে নেমেছিলেন ফয়সালাবাদ টেস্টে। ৪১ মিনিট ধরে লড়াই করে ১০ নম্বরে থাকা ওয়াসিম আকরামের সঙ্গে ৩২ রানের এক মহামূল্য জুটি গড়েছিলেন। সেই ইনিংসের কল্যাণেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৪০ রানের লক্ষ্য দিয়েছিল পাকিস্তান, পরে টেস্ট জিতেছিল ১৮৬ রানে!

গ্রায়েম স্মিথ (দক্ষিণ আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়া, ২০০৯)

গ্রায়েম স্মিথ

সিডনিতে প্রথম ইনিংসে মিচেল জনসনের শর্টপিচ বল লাগে গ্রায়েম স্মিথের গ্লাভসে। তাঁর হাত ভেঙে যায়, চোট পান কনুইতেও। ব্যথায় কুঁচকে মাঠ ছাড়েন। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, আর ব্যাটিং করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয় ইনিংসে পুরোটা সময় চুপচাপ বসে ছিলেন। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার ৯ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর দলের হার এড়ানোর চেষ্টায় ব্যথা আর ঝুঁকি উপেক্ষা করে স্মিথ ব্যাট করতে নামলেন। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের দর্শক, এমনকি অস্ট্রেলিয়ান সমর্থকেরাও উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিলেন। ম্যাচটা অবশ্য অস্ট্রেলিয়াই জিতেছিল, মন জিতেছিলেন স্মিথ।

তামিম ইকবাল (বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা, ২০১৮)

তামিম ইকবাল

২০১৮ এশিয়া কাপ, দুবাই। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ইনিংসের শুরুতেই তামিমের হাতে সজোরে লাগে বল, আঙুল ভেঙে যায়। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে পাঠানো হয়। সবাই ভেবেছিল, তামিমের টুর্নামেন্ট শেষ। কিন্তু দুই ঘণ্টা পর সবাইকে চমকে দিয়ে মাঠে ফিরে এলেন তামিম! কাটা গ্লাভস পরে আঙুল বের করে ব্যাটিং করেন এক হাতে। ব্যথা পাওয়ার আগে ৩ বলে ২ রান করেছিলেন। নবম উইকেট পড়ার পর আবার নেমে খেলেছেন এক বল, আউট হননি। মুশফিকুর রহিমের ঝোড়ো ব্যাটিংয়ের সুবাদে তাঁদের শেষ উইকেট জুটিতে যোগ হয়েছিল ১৬ বলে ৩২ রান। বাংলাদেশ ম্যাচটা জিতেছিল ১৩৭ রানে।