লম্বা দৌড় শেষে ব্যাটসম্যানের দিকে তেড়েফুঁড়ে বল ছুড়ে মারা—এই ছিল মাঠের শোয়েব আখতারের চেনা চেহারা। ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বর্ণিল চরিত্রগুলোর একটি পাকিস্তানের এই ফাস্ট বোলার। ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট দিয়ে দলে অভিষেক, খেলেছেন ২০১১ বিশ্বকাপ পর্যন্ত। রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস নামে পরিচিত এই ফাস্ট বোলার অবসরের কয়েক মাসই পরই প্রকাশ করেন ‘কন্ট্রোভার্সালি ইয়োরস’ নামের আত্মজীবনী। সেই বইয়ের ‘আ স্টার ইজ বর্ন’ অধ্যায়ে শোয়েব তুলে ধরেছেন কীভাবে ভারতের বিপক্ষে নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ তাঁকে তারকাখ্যাতি এনে দিয়েছিল।
আমি প্রথমবার ভারত সফরে যাই ১৯৯৯ সালের শুরুর দিকে। প্রথমে ছিল দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ, এরপর এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ যেখানে অংশ নেবে ভারত, শ্রীলঙ্কা আর পাকিস্তান। আমাদের দলে তখন একঝাঁক তরুণ—শহীদ আফ্রিদি, সাকলায়েন মুশতাক, আজহার মেহমুদ, আবদুল রাজ্জাক আর আমি। সবাই ভীষণ রোমাঞ্চিত। কারণ, পাকিস্তান–ভারত ক্রিকেটের লড়াই অন্য কিছুর সঙ্গে তুলনাই চলে না।
হ্যাঁ, অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের অ্যাশেজ আছে, কিন্তু উপমহাদেশের ইতিহাস ক্রিকেটকে এতটাই বড় করে তুলেছে, যা হয়তো তার চেয়েও বেশি গুরুত্ব পেয়ে যায়। কোনো দল বা খেলোয়াড় সফল হলে মাসের পর মাস ধরে নায়ক বানানো হয়। আবার উল্টোটা ঘটলে অর্থাৎ প্রতিপক্ষের কাছে হারলে, সেটাকে জাতীয় ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হয়। এই প্রচণ্ড চাপ দুই দলের খেলাকেই ভিন্ন মাত্রা দেয়। আমার কাছে, এর চেয়ে বড় উত্তেজনা পৃথিবীতে নেই। গ্যালারি সব সময় উপচে পড়ে সমর্থকে।
আসলে ভারতই প্রথম জায়গা, যেটাকে মুঝে কুচ আপনা সা লাগা, মানে নিজের মতো মনে হয়েছিল। ওরা আমার প্রতিভা ভালোবাসে, কিন্তু পাকিস্তানের কাছে হার মেনে নিতে পারে না। ঠিক যেমন আমরাও ভারতের কাছে হার মানতে পারি না। আমি যখন দেশের হয়ে খেলি, আবেগটা অন্য রকম হয়। তাই ভারতে খেলার মধ্যে আলাদা একটা বিশেষত্ব আছে।
সেবার প্রথম দুটি টেস্টে আমাকে খেলানো হয়নি। আসলে আমাকে ড্রেসিংরুমে ঢুকতেও দেওয়া হয়নি। আমি যখন ভেতরে যেতাম, সিনিয়ররা বলত,‘তু আন্দার কেয়া কর রাহা হ্যায়? বাহার বৈঠ!’ (তুই ভেতরে কী করছিস? বাইরে গিয়ে বস!)
কোনো নাম না নিয়ে শুধু এটুকুই বলতে পারি যে এরা আমার সিনিয়র ছিল এবং বাইরে গিয়ে ওয়ার্মআপ আর অনুশীলন করা ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না। তরুণদের জন্য আমাদের ড্রেসিংরুমের পরিবেশ নিঃসন্দেহে কঠিন ছিল। আপনি সবকিছু ঠিকঠাক করেন এবং বিনয়ী থাকেন, তবু তারা আপনাকে কষ্ট দেয়।
আমি দলে ছিলাম, কিন্তু দলের অংশ ছিলাম না। আমার সঙ্গে এত খারাপ ব্যবহার করা হয়েছিল যে আমি ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। তারপর একদিন সেলিম মালিক আমার কাছে এসে বললেন, ‘শোনো, তুমি কলকাতায় খেলার সুযোগ পাবে, মনোবল ধরে রাখো।’
এরই মধ্যে আফ্রিদি ভারতে একটা ইতিবাচক ছাপ ফেলেছে, প্রচুর ভক্তও তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু আমাকে তখনো কেউ চিনত না।
এদিকে আমরা দিল্লির টেস্ট হেরে যাওয়ার পর ওয়াসিম আকরাম ও ওয়াকার ইউনিসের মধ্যে তর্ক শুরু হলো। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে গেল যে গুজব ছড়িয়ে পড়ল, ওয়াকারকে দেশে ফেরত পাঠানো হবে। কিন্তু পুরো দল চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম টেস্টের জন্য কলকাতার উদ্দেশে রওনা হলো। ড্রেসিংরুমের ভেতরে পরিস্থিতি তখন থমথমে।
আমার মনে পড়ে না যে তখন যতটা উত্তেজনা ছিল, এমনটা আর কখনো হয়েছিল কি না। দুই সিনিয়র ছিল যুদ্ধরত, আর আমরা ছিলাম একটা তরুণ ও নতুন দল। সবাই প্রচণ্ড চাপের মধ্যে। এর মাঝেই সিদ্ধান্ত হলো, আমি কলকাতায় খেলব।
ওয়াকার সব সময় নরম সুরে কথা বলতেন। শান্ত মেজাজের মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আমার তাঁকে খুব ভালো লাগত। দুর্ভাগ্যবশত দলে তাঁর জায়গা হারানোর জন্য আমিই কারণ হয়ে গেলাম। আমার মনে হয় না তিনি কখনো এটা মেনে নিতে পেরেছেন।
২০১০-১১ মৌসুমে যখন তিনি কোচ হিসেবে পাকিস্তান দলে ফিরেছিলেন, তখন তিনি খেলোয়াড় হিসেবে আমার ফিটনেস ও সামর্থ্য নিয়ে সবাইকে বলে বেড়াতেন। কিন্তু ১৯৯৯ সালের ওই সময়টায় ওয়াকার ছিলেন আমার আদর্শ। তাঁকে বাদ দিয়ে দিয়ে যে আমাকে খেলানো হচ্ছিল, এ নিয়ে খুব অস্বস্তিতে ভুগছিলাম।
আমি তাঁর কাছে গিয়ে বললাম, ‘স্যার, আমি আপনার সমকক্ষ নই। আপকে প্যায়র কি জুতি কে বরাবর ভি নহি হু!’ (আমি আপনার পায়ের জুতার সমানও নই!) তিনি দ্রুত বললেন, ‘না, না, তুমি যাও এবং খেলা উপভোগ করো। যেন ভালো খেলতে পারো সেদিকে মনোযোগ দাও।’
অনেক বড় সফর ছিল এটা। যেখানে এক লাখ দর্শক মাঠে এবং আরও অনেকে বাইরে থেকে আমাদের দেখছিলেন। পুরো ভারত এবং পাকিস্তান খেলা দেখছিল। আমি ভীষণ নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম। খেলার দিন যখন স্টেডিয়ামে ঢুকি, আমার হাঁটু কাঁপছিল। পা টলমল করছিল। বুঝলাম, আমাকে এই নার্ভাসনেস ঝেড়ে ফেলতে হবে। আর সেটার জন্য শুধু একটা উপায়ই জানা ছিল।
(খেলা শুরুর আগে) ভারতের ব্যাটসম্যানদের ওয়ার্মআপ চলছিল। ব্যাট নিয়ে টুকটুক করছে। আমি শচীন টেন্ডুলকারের কাছে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি আমাকে চেনেন?’ তিনি মাথা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘না।’ আমি তাঁকে বললাম, ‘খুব শিগগিরই চিনবেন!’
এরপর ম্যাচে শচীন যে প্রথম বলটা খেললেন, সেটিতেই আমি তাঁকে আউট করলাম। পরে তিনি আমাকে বললেন, ‘এখন থেকে তোমাকে মনে রাখব।’
কয়েক বছর পর আমি শচীনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তাঁর এই ঘটনা মনে আছে কি না। তিনি বলেছিলেন যে তাঁর মনে নেই। কিন্তু দেখুন, এটাই আমি! আমি একজন স্ট্রিট হুড, একজন বড় ভাইয়ের মতো আচরণ করি, কারণ আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর এটাই একমাত্র উপায় বলে আমি জানি। আমার পা কাঁপছিল, কিন্তু আমি জানতাম যে শচীনই সেই ব্যক্তি, যাঁকে আমাকে কাবু করতে হবে। আসলে আমি তাঁদের সবাইকে (আউট করতে) চাইছিলাম, আমি এতটাই ক্ষুধার্ত ছিলাম।
ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে সাকলায়েনের সঙ্গে আমার একটা বাজি হয়। সে আমাকে বলেছিল যে সে শচীন টেন্ডুলকারের মূল্যবান উইকেটটি নেবে। আমি বললাম, ‘না, এটা আমার। তুমি এটা নিতে পারবে না। কারণ এখন এটা আমার সময়!’ সে বলল, ‘সত্যি?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ, সত্যি!’ বাজি পাক্কা।
আমার মনে পড়ে, আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম, কখন আমার হাতে বল তুলে দেওয়া হবে। অবশেষে বলটা যখন আমার কাছে এল, আমি জানতাম এটা আমার ইচ্ছেমতো সুইং করবে। আমি ভি ভি এস লক্ষ্মণের উইকেট পেলাম এবং আমার স্নায়ু শান্ত হতে শুরু করল।
আমার পরবর্তী শিকার ছিল রাহুল দ্রাবিড়। বছরের পর বছর ধরে যিনি এমন একজন মানুষ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, যাঁকে সহজে আউট করা যায় না। মাঠে ওর সঙ্গে আমার কিছু কথা–কাটাকাটি হয়। আমি আক্রমণাত্মকই ছিলাম। তবে সেটা ব্যক্তিগত কিছু ছিল না। আমার মনে হয় দ্রাবিড় ঘটনাটা মনে রেখেছিলেন। কারণ, তাঁকে বেশ বিরক্ত দেখা গিয়েছিল। আমার একটি ডেলিভারি কলার মতো সুইং করে তাঁর বেলের পাশ দিয়ে চলে গেল।
এরপর শচীন মাঠে এলেন, স্টেডিয়াম যেন ফেটে পড়ল। আমি এত জোরে শব্দ আর কখনো শুনিনি। আমার মনে আছে আমি ভাবছিলাম, ‘ইয়ে কৌন আ রাহা হ্যায়, ভাই’—কে আসছে এটা?
সাকলায়েন আমার পাঁজরে গুঁতা মেরে বলল, ‘ওহ দেখ, আ রাহা হ্যায় প্রাইজ উইকেট!’ (ওকে দেখো, প্রাইজ উইকেট আসছে)। আমি মাথা নেড়ে তাঁকে শান্ত হতে বললাম। এরপর ওপরের তাকিয়ে প্রার্থনা করলাম, ‘বস, আমার এটা চাই! প্রথম ডেলিভারিতেই আমাকে তাকে আউট করতে হবে।’
আমি স্পষ্টভাবে সেই ওভারটা মনে করতে পারি। আমি যত দ্রুত সম্ভব দৌড়ালাম এবং শচীনের দিকে বলটা ছুড়ে মারলাম। তিনি তাঁর স্ট্রোকটা বেশ হেলাফেলায় খেললেন এবং বলের থেকে এক মাইল দূরে মিস করলেন। প্রাইজ উইকেটটা আমার হলো! আমি সিজদায় মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম, বললাম, ‘ধন্যবাদ, বস! ধন্যবাদ!’
শচীনের উইকেটটা আমাকে সত্যিই আনন্দ দিয়েছিল, কিন্তু আমার মতে, দ্রাবিড়কে যে বলটা করেছিলাম, সেটা আরও ভালো ডেলিভারি ছিল। যখন দ্রাবিড় আউট হলেন, ইডেন গার্ডেন চুপ হয়ে গিয়েছিল। আর যখন শচীন আউট হলেন, তখন পিন পড়লেও শব্দ শোনা যেত। কিন্তু যখন আমি ওভার শেষ করলাম, দর্শক দাঁড়িয়ে আমাকে স্ট্যান্ডিং ওভেশন দিল। কৃতজ্ঞতায় আমার হৃদয় ভরে উঠল।
এই দুটি বলের পেছনে একটি ইতিহাসও আছে। ওয়াসিম আকরাম বিশ্বকাপে এমন কিছু করেছিলেন। আমিও একই কাজ করতে চেয়েছিলাম। একটা ব্যাপারও ছিল। দ্রাবিড় এবং টেন্ডুলকারের এই দুটি উইকেট ম্যাচের মোড় আমাদের দিকে ঘুরিয়ে দিল। যদি তারা জুটি গড়তে পারত, আমরা হেরে যেতাম। এই ম্যাচেই আমি জানলাম যে আমার ম্যাচ জেতানোর ক্ষমতা আছে। আমি মোট ৮ উইকেট নিয়েছিলাম।
একই ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে শচীনকে রানআউট করার পেছনেও আমি জড়িত ছিলাম। সে খেলার পর বল বাউন্ডারির দিকে ছুটে যাচ্ছিল। আমার পিঠ ছিল শচীনের দিকে। তাকিয়ে আছি রিটার্ন থ্রোয়ের দিকে। জানতাম না যে শচীন আমার পেছনে।
কোনো এক ভাবে আমার পায়ের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিল। থ্রোটা ছিল দুর্দান্ত, বাউন্ডারি থেকে এসে সরাসরি স্টাম্পে। আবারও আমি একটি বিতর্কের মধ্যে জড়িয়ে পড়লাম, দর্শক মনে করেছিল আমি ইচ্ছাকৃতভাবে শচীনকে বাধা দিয়েছি। এটা সম্পূর্ণ ভুল। আমি তাকে দেখিনি। আর কাজটা ইচ্ছাকৃতও ছিল না। কিন্তু দর্শক রাগে উন্মত্ত হয়ে উঠল। একপর্যায়ে দেখি স্টেডিয়ামে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
আমরা দ্রুত মাঠ ছাড়লাম। জানতাম না এরপর কী হবে। পরে অবশ্য স্টেডিয়াম পরিষ্কার করে আমার ম্যাচ শুরু হয়েছিল। আমরা জিতেছিলাম। এই জয়ের যে আনন্দ, এমন উচ্ছ্বাস আমি আর কখনো দেখিনি। টিম হোটেলে একটা ক্লাব ছিল। সেখানে গিয়ে পুরো দল নাচানাচি আর আনন্দে আত্মহারা হয়ে সারা রাত কাটিয়ে দিল। যখন সবাই রুমে ফিরি, ততক্ষণে সকাল ছয়টা। আমরা সেদিন এতটাই খুশি ছিলাম।
১৯৯৭ থেকে ২০১১—১৪ বছরের ক্যারিয়ারে তিন সংস্করণে মোট ২২৪ ম্যাচ খেলেছেন শোয়েব, নিয়েছেন ৪৪৪ উইকেট। তবে উইকেট ছাড়িয়েও সবচেয়ে বিখ্যাত ২০০৩ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নিক নাইটকে করা একটি ডেলিভারি, স্পিডমিটারে যার গতি উঠেছিল ঘণ্টায় ১৬১.৩ কিলোমিটার, যা এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি গতির ডেলিভারি।
আর ভারত–পাকিস্তান ক্রিকেট লড়াইয়ের সবচেয়ে আইকনিক মুহূর্তগুলোর একটি হয়ে আছে ১৯৯৯ সালে কলকাতায় রাহুল দ্রাবিড় ও শচীন টেন্ডুলকারকে বোল্ড করা সেই দুটি ডেলিভারি। বর্তমানে ইউটিউব, টক শো এবং ধারাভাষ্যে ব্যস্ত সময় কাটান শোয়েব। ‘কন্ট্রোভার্সালি ইয়োরস’ বইয়ের মতো সেখানেও অকপট, সোজাসাপটা শোয়েবেরই দেখা মেলে, যেমনটা ছিলেন বোলিংয়ে।