পথের রেখায় ক্লান্তির ছাপ নেই। শাঁই শাঁই করে ছুটে যায় গাড়ি। কিন্তু গন্তব্য কোথায়? তীব্র গরমের দেশে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত জীবনের আড়ালে রঙিন কোনো ভুবনেই হয়তো হারান ভ্রমণবিলাসীরা। মরুভূমির বালুচর দেখে মেটান মনের সাধ।
অচেনা সেই জগৎ আড়ালে রেখে দৃশ্যমান আবুধাবির দুনিয়ায় পথ চলতে চলতে যেখানেই যাবেন, খুঁজে পাওয়া যাবে শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানকে। আবুধাবি শহরটাই যেন জায়েদময়। ভিনদেশি পরিব্রাজক কিংবা দরকারি কাজে ছুটে এসে প্রথম যে গন্তব্যে নামবেন, সেটির নামই তো শেখ জায়েদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর!
সেখান থেকে বেরিয়ে পথ চলতে চলতে প্রায়ই দেখা মেলে রাস্তার ধারের বড় সাইনবোর্ড, যাতে লেখা ‘শেখ জায়েদ সড়ক’। পথের ধারে চিহ্ন এঁকে দেওয়া একটু পরপর—ডান কিংবা বাঁ দিকে গেলে ভিন্ন ভিন্ন যে গন্তব্য, সেসবের বেশির ভাগের নামেও জায়েদ। আরব সাগরের যে জেলে–জীবন তাঁদের একসময় বাঁচিয়ে রাখত, এখন সেখানে গড়ে ওঠা বন্দরটার নামও জায়েদ পোর্ট।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে এসে এশিয়া কাপ কাভার করতে গন্তব্য মাঠ, কী নাম? শেখ জায়েদ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। প্রেসবক্সে বড় করে ছবি টাঙিয়ে রাখা তাঁর। স্টেডিয়ামের বাইরেও সারি সারি মাঠ। চাইলে ভাড়া নিয়ে বাস্কেটবল, টেনিস কিংবা অন্য কোনো প্রিয় খেলা খেলা যায়। এই পুরো কমপ্লেক্সটারও একটা নাম আছে—শেখ জায়েদ স্পোর্টস হাব।
একটু অসতর্কতা ‘জায়েদ–বিভ্রাটে’ ফেলে পকেট থেকে বাড়তি দিরহামও খসিয়ে দিতে পারে। এক বিদেশি সাংবাদিক যেমন গাড়ি ভাড়ার অ্যাপে শেখ জায়েদ স্টেডিয়ামের জায়গায় তাড়াহুড়া করে জায়েদ বিমানবন্দরে ক্লিক করে ফেলেন। যতক্ষণে তা টের পাওয়া যায়, ততক্ষণে অনেক দেরি।
কিন্তু আবুধাবিতে এত ‘জায়েদ’ কেন? এক বাক্যে উত্তর—শহরটা তো জায়েদেরই! বছর ষাটেক আগেও পানি আর বিদ্যুৎহীন জেলেদের যাযাবর জীবন এখানকার মানুষের নিয়তি ছিল। পাতার তৈরি ছাদ আর তাঁবুতে ছিল থাকার ব্যবস্থা। সেই জীবনে ইমারত গড়ে দেওয়ার কৃতিত্বটা তো শেখ জায়েদ বিন সুলতান নাহিয়ান নামের স্বপ্নদ্রষ্টারই।
আবুধাবির রাজপরিবারের সদস্য জায়েদ শুরুতে ছিলেন ভাই শেখ শাখবাদের নিয়োগ করা গভর্নর। বছরে ৩ লাখ ৪০ হাজার পাউন্ড পেতেন সেই সূত্রে। ভোগ–বিলাস ছেড়ে তা বিনিয়োগ শুরু করেন কৃষি আর উন্নয়নকাজে। তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে তখনই।
এর মধ্যেই সৌভাগ্যের পরশ ছুঁয়ে যায় আরবকে। ১৯৫৮ সালে খুঁজে পাওয়া যায় তেলের খনি, বালু থেকে বেরিয়ে আসে তেল। সেটি যে পৃথিবীর গন্তব্যেও বদলের শুরু, তখন তা বুঝতে পেরেছিলেন খুব কম মানুষই। যেমন বুঝতে পারেননি আবুধাবির তখনকার শাসক শাখবাদও। আরবের হাজার বছরের ঐতিহ্যেকে আঁকড়ে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা করে গেছেন তিনি।
১৯৬৬ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শাখবাদকে সরিয়ে আবুধাবির নিয়ন্ত্রণ নেন জায়েদ। মানুষের ভাগ্য বদলানোর স্বপ্ন ছিল তাঁর আগে থেকেই। সুযোগটা এরপর তিনি কাজে লাগাতে শুরু করেন পুরোদমে। কিন্তু ধাক্কা খেতে শুরু করেন ১৯৬৮ সাল থেকে ব্রিটিশরা সৈন্য সরিয়ে নিতে শুরু করলে। আমিরাতের রাজ্যগুলোর অন্তঃকোন্দল থেকে দূরে সরিয়ে রাখছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশদের সঙ্গে করা ওই চুক্তি।
নতুন সংকট জায়েদের সামনে খুলে দেয় নতুন দিগন্তেরও। প্রায় ৩ বছরের চেষ্টায় ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর আরবের ছয় প্রদেশ আবুধাবি, দুবাই, শারজা, হুজাইরা, আজমান ও উম্মু আল খাইনকে জোড়া লাগিয়ে সৃষ্টি হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতের। অবধারিতভাবেই দেশটির প্রথম রাষ্ট্রপতি হন শেখ জায়েদ। পরের বছর আমিরাতে যোগ হয় রাস–আল খাইমা নামের আরও একটি প্রদেশ।
হাসপাতাল, স্কুল, রাস্তাঘাট নির্মাণ শুরু হয়। কাজের বিনিয়মে বেতন পেতে শুরু করে আমিরাতের মানুষ। তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে আমিরাতজুড়ে বাড়তে থাকে ইমারত, প্রশস্ত সড়ক। আমিরাতের মানুষের জীবনে নেমে আসে নতুন বসন্ত। বদলে যায় তাঁদের ভাগ্য।
মরুভূমির জীবনে ভর করে বিলাসিতা। তাতেও নেতৃত্ব দেন শেখ জায়েদ। তাঁর কীর্তিময় স্মৃতি ধরে রাখতেই আজ পথে পথে তাঁর নাম। শুধু তো আর আমিরাত নয়—পাকিস্তানের একটি বিমানবন্দর আর লন্ডনের স্কুল অব ইকোনমিকসের একটি লেকচার সেন্টারের নামকরণও হয়েছে তাঁর নামে।
২০০৪ সালের ২ নভেম্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করা শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান এখনো বেঁচে আছেন আমিরাতের স্থাপনা আর সড়কে। আরবদের কাছে যেন এই কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। তাতে যদি ভিনদেশি মানুষের একটু বিভ্রাট হয়ও, তাতে কী আর করা!