
ঘড়িতে সময় সকাল ৭টা ৫০ মিনিট। আকাশে মেঘের দল। সূর্যের আলো তখনো ভালোভাবে উঁকি দিতে পারেনি। শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ক্যামেরা হাতে তৈরি সংবাদমাধ্যমের দুই আলোকচিত্রী। তাঁদের মুখে ঘুম ঘুম ভাব—রাত জাগা শহরে তখনো বেশির ভাগই হয়তো বিছানায়, কারও হাতে চা বা কফির কাপ। যাঁদের ওই সৌভাগ্য, সুযোগ কিংবা সময় নেই, তাঁরা ছুটছেন কর্মস্থলে।
এ তালিকায় যদি আপনিও থাকেন, খুব কি মন খারাপ হবে? আপনি যাঁদের টিভি কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের রঙিন দুনিয়ায় দেখে তাঁদের আয়েশি জীবনের কথা ভাবেন— সেই ক্রিকেটাররাও আছেন আপনার দলেই।
একই পোশাক (জাতীয় দলের অনুশীলন কিট) পরে ক্রিকেটাররা শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের জিমে ছুটছিলেন সতীর্থদের কাঁধে হাত রেখে। পাশেই ইম্পেরিয়াল স্কুলে তখন বাজতে থাকা জাতীয় সংগীত, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…’ সুর ভেসে আসছিল তাঁদের কানেও।
তা শুনতে শুনতে বহু বছর আগে স্কুলের পিটিতে দাঁড়ানোর আগে বন্ধুত্বের গল্প জুড়ে দেওয়ার সময়টাতেও তাঁরা ফিরে গেলেন কি না, প্রশ্নটা করা গেল না। ক্রিকেটারদের তাড়া তখন জিমে ছুটে যাওয়ার। জাতীয় সংগীত, শপথ শেষ হলো স্কুলে। শেষ হলো জাকের আলী–নাজমুল হোসেনদের জিম সেশনও।
তখনো দৃশ্যপটে নেই স্কুলের সেই প্রিয় পিটি স্যার। যিনি আসবেন একটা কেতাদুরস্ত ভাব নিয়ে। তাঁর হুকুমে ক্লাস শুরুর আগেই নাড়াতে হবে আলসেমি ভর করা শরীর। চনমনে ভাব নিয়ে আসতে যা ‘জরুরি’ মনে করেন তিনি—ক্লাসটা মন দিয়ে করা গেলে ভালো হবে পরীক্ষাও।
এতক্ষণ আড়ালে থাকা পিটি স্যার, মানে জাতীয় দলের ফিটনেস ট্রেনার নাথান কেলি দৃশ্যপটে হাজির হলেন ঘড়ির কাঁটায় যখন সময় ৮টা ২৮ মিনিট। তাঁর শারীরিক কসরতের ক্লাস শুরু হতে আর মিনিট দুয়েক বাকি। পরিচিত একজনের সঙ্গে পথে দেখা হলো, কথাও—কিন্তু ‘পিটি স্যারের’ দায়িত্ব পেয়ে যাওয়া কেলি থামতে পারলেন না মুহূর্তের জন্যও। তাঁর ছাত্ররা যে তখন একাডেমি মাঠের সামনের কাজ শেষ করে ক্লাসের জন্য তৈরি মূল মাঠে।
সকাল ৮টা ৩০। সামনে দাঁড়িয়ে কেলি। ক্রিকেটাররা সারিবদ্ধভাবে তাঁর সামনে এক লাইনে। কয়েক শ ফুট দূরেও ভেসে এল কেলির কণ্ঠ, ‘সবাই তৈরি তো…?’ কী কী করতে হবে, কতক্ষণ—তাঁর একটা সারাংশও তিনি বললেন।
শুরু হলো প্রথম শারীরিক কসরত—পিটি স্যারের দেওয়া কসরতের নাম ‘ডায়নামিক আর্ম সুইং’। সামনে অনেকগুলো মার্কার রাখা। হেঁটে হেঁটে ক্রিকেটারদের গন্তব্য ওখানেই। শুধু পথে হাতটা নিচে নামিয়ে ঢেউয়ের মতো খেলতে হবে। দৌড় বা আরও কঠোর অনুশীলনের আগে হাত ও কাঁধের জড়তা কাটানোই উদ্দেশ্যে।
সময় এগিয়ে গেল আরও। সকাল ৮টা ৪০ মিনিট—নতুন ব্যয়াম। এক পায়ে ভর দিয়ে অন্য পা’টা সামনে এগিয়ে দিতে হবে, এই ব্যায়ামের নাম ‘ডাইনামিক লেগ সুইং’। কয়েকবার এমন করেই ছোট্ট একটা দৌড়। আপনার প্রিয় ক্রিকেটারদের হ্যামস্ট্রিং চোটের কথা শুনে থাকবেন প্রায়ই। তেমন কিছু থেকে বাঁচতেই এই অনুশীলন। এতে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়, শরীরটাকে তৈরি করে ক্লাস বা ক্রিকেটের স্কিল অনুশীলনের জন্যও।
এই ব্যয়াম চলল লম্বা সময়। পিটিতে আপনার আলসে বন্ধুর মতো তখন এখানেও কারও আর মনে বসছে না। পেয়ে বসা আলসেমি কাটাতে কেউ কেউ মিমিক্রি করলেন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধু বা সতীর্থের। কেউ দলীয়ভাবে শুরু করার আগেই স্যারের দেখিয়ে দেওয়া কসরতটাকে মিলিয়ে নিতে চাইলেন নিজের সঙ্গে।
এরপর শুরু আরও কঠিন পরীক্ষা—দৌড়। এতক্ষণ অনুশীলন হয়েছে একজনের পেছনে অন্যজনের ছুটে। সবার সামনে ছিলেন জাকের আলী। এবারও তা–ই। তাঁর কি একটু অভিমানই পেয়ে গেল? দূর থেকে দেখে মনে হলো না তেমন। দিন দশেকের ছুটিতেও নিয়মিত মিরপুরের জিমে এসে জড়তা কাটিয়ে ফেলেছেন। কঠিন পরীক্ষার আগেও তিনি তাই চনমনে।
পাশে তখন পিটি স্যার কেলির হাঁকডাক শুরু হয়েছে—তাঁর হাতে বাঁশি নেই, তাতে বরং সুবিধাই হলো। শহীদ জুয়েল স্ট্যান্ডে বসেও মাঠের ওই প্রান্তে কয়েক শ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কেলির কণ্ঠটা শোনা গেল, ‘স্টার্ট…’
শুরু হলো লম্বা দৌড়। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। ১০ সেকেন্ড…৫ সেকেন্ড…গন্তব্যে থামতেই বাজতে শুরু করল কেলির কণ্ঠে অ্যালার্ম ঘড়ি। ‘স্টার্ট’ বলতেই ছুটতে হলো আবার। পানি পানের কয়েক সেকেন্ডের বিরতি দিয়ে এই দৌড় কয়েকবার দিতেই হাল ছেড়ে দিলেন কেউ কেউ। ছু্টি কাটিয়ে ফেরার দ্বিতীয় দিনে যা খুব স্বাভাবিকও।
কেউ শুয়ে পড়লেন, কারও এল বমির ভাবও। পাশে দাঁড়িয়ে সতীর্থদের সহানুভূতি পেয়ে আবার শুরু হলো…দৌড়। সময় আর দৌড়ের সংখ্যা যত বাড়ল, দৃশ্যপট থেকে হারাতে শুরু করলেন একজন একজন করে। কেউ দৌড় শুরু করলেন ধীরগতিতে, কেউ থেমে গিয়ে বসেই পড়লেন। পানিতে ভেজানো রুমাল মুখে দিলেন কেউ কেউ। ক্রিকেট মাঠে লম্বা সময় থাকা, দৌড়ে রান নেওয়া, বোলিং, ফিল্ডিংয়ের ক্ষিপ্রতার জন্য তাঁদের ফিটনেস অনুশীলনে সময় দরকার আরও।
আজ আপাতত এতটুকুই। সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে ছুটি হলো তাঁদের। ক্রিকেটাররা ছুটলেন ড্রেসিংরুমে। ক্রিকেটারদের এই পিটি ক্লাস চলবে আরও সপ্তাহখানেক। এরপর শুরু হবে অন্য ক্লাস। সেই ক্লাসে পাওয়ার হিটিং কোচ জুলিয়ান উড–মনোবিদ ডেভিড স্কটের সঙ্গে থাকবেন প্রধান ‘শিক্ষক’ ফিল সিমন্স ও অন্যান্য নিয়মিত ‘শিক্ষকেরা’।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের পরীক্ষা শুরু ১১ সেপ্টেম্বর—এশিয়া কাপে হংকংয়ের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। সে জন্যই এই প্রস্তুতি।