চুপ থেকেই ব্যাটসম্যানদের ভয় দেখাতেন যে বোলার

স্যার ইয়ান টেরেন্স বোথাম। ইয়ান বোথাম—সর্বকালের সেরা ইংলিশ ক্রিকেটার। সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। মাঠে ও মাঠের বাইরে বর্ণাঢ্য এক চরিত্র। নন্দিত, বিতর্কিতও। ক্রিকেট মাঠের মতো নিজের লেখা বইয়ের পাতায়ও যিনি বেশ অকপট। অনেকগুলো বই লিখেছেন। তবে বোথাম নিজের সময়ের অন্য সেরা ক্রিকেটারদের সম্পর্কে কী ভাবতেন, সেটা বোঝা যাবে তাঁর “বোথাম’স সেঞ্চুরি: মাই হানড্রেড গ্রেট ক্রিকেটিং ক্যারেক্টারস” পড়লে। সেই বইয়েই একটা অধ্যায় আছে ক্রিকেটের আরেক বর্ণাঢ্য চরিত্রকে। অধ্যায়ের নাম ‘কার্টলি অ্যামব্রোস’।

অ্যামব্রোসকে নিয়ে বোথাম কী লিখেছেন

‘হেই, বিফি, ম্যান।’
গমগমে গলার এই ডাক শুধু একজনেরই হতে পারে—মহামান্য রাজা (পরে স্যার) ভিভিয়ান রিচার্ডস।
‘হ্যাঁ, স্মোকস,’ আমি বললাম।
‘বিফি, জানো, বিগ বার্ড অবসর নিচ্ছে।’

১৯৮৬ সালের কথা। খবরটা আমি আগেই শুনেছিলাম। সমারসেটে আমার প্রিয় বন্ধু এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ-ইংল্যান্ড ম্যাচের সময় আমার সবচেয়ে বড় শত্রু জোয়েল গার্নার ক্রিকেটকে বিদায় জানাতে চলেছে। বলা বাহুল্য, আমি বেশ মুষড়ে পড়েছিলাম। ক্রিকেট মাঠে তার সামনে নিজের জীবন বাজি রেখে ব্যাট করার সেই সুখ আর কোনো দিন পাব না!
‘হ্যাঁ, ভিভ, ’ আমি বললাম, ‘খুব খারাপ খবর।’
ভিভ দাঁত বের করে বলল, ‘মন খারাপ কোরো না। আমরা আরেকজনকে পেয়ে গেছি। কিন্তু সমস্যা হলো—ও ক্রিকেট পছন্দই করে না। উফফ, বিফি…ছেলেটা কী যে বাস্কেটবলের পাগল!’

ভিভ রিচার্ডস ও ইয়ান বোথাম। দুই কিংবদন্তি কাউন্টি ক্রিকেটে সতীর্থ ছিলেন, ছিলেন সবচেয়ে ভালো বন্ধুও

আহা, সত্যিই যদি তা-ই হতো! সেই ছেলে যদি ক্রিকেট না খেলে বাস্কেটবলটাই বেছে নিত! কত কত ইংলিশ ব্যাটসম্যান যে দুঃস্বপ্নের হাত থেকে বেঁচে যেত। কিন্তু অন্যভাবে ভাবলে, কার্টলি অ্যামব্রোস না থাকলে বিশ্ব ক্রিকেট কত দরিদ্র থেকে যেত!

অ্যান্টিগার সোয়েটেস নামের ছোট্ট গ্রামের মানুষগুলো হয়তো একই গল্প শুনতে শুনতে একটু বিরক্তই হয়ে গেছেন। কিন্তু আধুনিক ক্রিকেটের সবচেয়ে রোমান্টিক দৃশ্যগুলোর একটি হচ্ছে—যখনই রেডিওতে খবর আসত, ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে তাঁর ছেলে আরেকটি উইকেট পেয়েছে, তখনই কার্টলির মা তাঁদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টা বাজাতেন।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ৯৮ টেস্টে ৪০৫ উইকেট নিয়েছেন অ্যামব্রোস

১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষেক, ২০০০ সালে ওভালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ টেস্ট। এই দীর্ঘ পথচলায় কার্টলি আর তাঁর সঙ্গী কোর্টনি ওয়ালশ সবার কাছ থেকে যে সম্মান পেয়েছে, তা খুব ক্রিকেটারের ভাগ্যেই জোটে। প্রতিপক্ষ ও দর্শক সবাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়েছে তাদের, ক্রিকেটে যে দৃশ্য বিরল। এই দীর্ঘ সময়ে বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা সব ব্যাটসম্যানের জন্য সেই ঘণ্টা বেজেছে। কারও কারও জন্য বেজেছে বারবার। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা ৩০০-এরও বেশি (আসলে ৪০৫)।

কার্টলি আর জ্যামাইকার বিশালদেহী ভদ্রলোক কোর্টনি ওয়ালশ মিলে গড়ে তুলেছিল ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর ফাস্ট বোলিং জুটিগুলোর একটি। আন্ত-দ্বীপ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ব্যক্তিগত রেষারেষি থাকলেও তাদের এই জুটির ভিত্তি ছিল গভীর পারস্পরিক শ্রদ্ধা।

বোলার ও প্রতিপক্ষ হিসেবে কার্টলির যে ছবিটা আমার মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছিল, তা হলো ওর অদ্ভুত শান্ত স্বভাব। অথচ তাঁর বোলিং ছিল আগ্রাসী, ভয়ংকর। যত বোলারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে, তাঁদের মধ্যে কার্টলিই সবচেয়ে চুপচাপ। এমনকি দলকে দারুণ সাফল্য এনে দেওয়ার পরও তাকে মনে হতো সবচেয়ে অনিচ্ছুক ও নির্লিপ্ত নায়ক।

মাঠে খুব বেশি কথা বলতেন না কার্টলি অ্যামব্রোস

টেস্ট ক্রিকেটে তাকে আমি কখনো খারাপ বল করতে দেখিনি। ভীষণ মিতব্যয়ী ও নিখুঁত। আর ছিল ঘোড়ার মতো দম। ওকে দেখলে মনে হতো না যে কখনো মারার মতো কোনো বল দেবে। আর যখন তার মেজাজ বিগড়ে যেত, ১৯৯৪ সালে পোর্ট অব স্পেনে মাইক আথারটনের ইংল্যান্ডকে ৪৬ রানে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সময় যা হয়েছিল, তখন সে ঘূর্ণিঝড়ের মতোই নির্দয় আর ধ্বংসাত্মক হতে পারত। সেরা সময়ে, বিশেষ বিশেষ উইকেটে তাকে খেলা কার্যত অসম্ভব ছিল।

কিন্তু তার সব অস্ত্রের মধ্যে হয়তো সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল তার ওই নীরবতা। মাঠে সে প্রায় কথা বলতই না, আর মাঠের বাইরে তো একেবারেই চুপ। বিশেষ করে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে তো কিছুই বলত না। আসলে তার দরকারও পড়ত না। অনেক বোলারই নানা রকম কথা বলে, স্লেজিং করে, অঙ্গভঙ্গি করে ব্যাটসম্যানদের ভয় দেখাতে বা মনোযোগ নষ্ট করতে চাইতেন। কার্টলি ভয় দেখাত স্রেফ চুপ থেকে!

কার্টলি অ্যামব্রোস

মাঠে ‘স্লেজিং’ করাটা তার কাছে ছিল শক্তি, সময় আর নিশ্বাসের অপচয়। কোনো ব্যাটসম্যান যখন ব্যাট চালিয়েও বলে লাগাতে পারতেন না, তখন অন্য অনেকে হয়তো কথা বলতে বলতে গলদঘর্ম হয়ে যেত। কার্টলি হয় শুধু একটা ‘টুট-টুট’ শব্দ করত, নয়তো প্রশস্ত, দাঁত বের করা হাসিটা দিত, অথবা ভ্রু কুঁচকে এমনভাবে তাকাত, যেন জানতে চাইছে: ‘তুমি কি সত্যিই এত খারাপ ব্যাটসম্যান?’

মিডিয়ার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আর রসিকতা বোঝাতে একটা গল্পই যথেষ্ট। ১৯৯১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইংল্যান্ড সফরে নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর সাংবাদিক ডেভিড নরি চেষ্টা করছিলেন কার্টলিকে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি করাতে। সবাই জানত, তাঁকে মুখ খুলতে বাধ্য করা প্রায় অসম্ভব। তাই নরি সাহায্য চাইলেন ভিভ রিচার্ডসের। ভিভ বললেন, চেষ্টা করবেন। কিছুক্ষণ পর বিশালদেহী কার্টলি ড্রেসিংরুমের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। নরি খুশিতে নোটবুক বের করলেন।

মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক ফাস্ট বোলার কার্টলি অ্যামব্রোস

‘তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাও?’ কার্টলি জিজ্ঞেস করলেন।
‘হ্যাঁ’, নরি উত্তর দিলেন।
‘ঠিক আছে। কিন্তু নিয়মটা হলো তুমি যদি ভিভের সঙ্গে কথা বলতে চাও, ভিভকে বলবে। যদি কার্টলির সঙ্গে কথা বলতে চাও, কার্টলিকে বলবে।’
‘বুঝতে পেরেছি’, নরি বললেন, ‘ভুল-বোঝাবুঝির জন্য দুঃখিত। ভেবেছিলাম ভিভের মাধ্যমে গেলে ভালো হবে।’
‘ঠিক আছে, ’ বলল কার্টলি, ‘কোনো সমস্যা নেই।’
‘তাহলে, আমি কি তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারি?’
‘না, ‘কার্টলি কারও সঙ্গে কথা বলে না।’

অ্যামব্রোস ও ওয়ালশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিখ্যাত ফাস্ট বোলিং জুটি

পাঠকের জন্য তথ্য

স্যার কার্টলি এলকন লিনওয়াল অ্যামব্রোস। সর্বকালের সেরা ফাস্ট বোলারদের একজন। অ্যান্টিগায় জন্ম নেওয়া এই ক্যারিবীয় কিংবদন্তি ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ৯৮ টেস্টে নিয়েছেন ৪০৫ উইকেট। গড় ২০.৯৯। ১৭৬ ওয়ানডেতে ২৪.১২ গড়ে ২২৫ উইকেট। ক্যারিয়ারের বড় অংশজুড়েই আইসিসির বোলারদের র‌্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বরটা স্থানটা ছিল তাঁর দখলে। লম্বায় ৬ ফুট ৭ ইঞ্চি। বিশাল উচ্চতা থেকে আসা তাঁর বল, সঙ্গে গতি ও নিখুঁত লাইন-লেংথ মিলিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ব্যাটসম্যানদের দুঃস্বপ্ন। কোর্টনি ওয়ালশের সঙ্গে তাঁর জুটিও ছিল দুর্দান্ত। দুজন মিলে ৫২ টেস্টে নিয়েছেন ৪১২ উইকেট। গড় ২২। দুর্ভাগ্য দুজনের, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট তখন সেরা সময় পেছনে ফেলে এসেছে। ১৯৯২ সালে ‘উইজডেন’ তাঁকে বর্ষসেরা ক্রিকেটারদের একজন হিসেবে বেছে নেয়। অবসরের পর নাম ওঠে আইসিসি হল অব ফেমে। পরে পান নাইটহুডও।