ইমরানের রাজনীতির ‘শিকার’ মিয়াঁদাদ, পাকিস্তান ক্রিকেটের ধ্বংসের শুরু

জাভেদ মিয়াঁদাদ ও ইমরান খান—পাকিস্তান ক্রিকেটের দুই কিংবদন্তি। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯২ সাল সময়ে একসঙ্গে পাকিস্তান দলে খেলা এ দুই ক্রিকেটারের সম্পর্ক মাঠের বাইরেও গভীর ও জটিল। যে সম্পর্ক নিয়ে মিয়াঁদাদ অনেক কিছুই লিখেছেন ‘কাটিং এজ: মাই অটোবায়োগ্রাফি’ বইয়ে। এর মধ্যে ‘ইমরান অ্যান্ড আই’ অধ্যায়ে বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের প্রশংসা করলেও ‘আ ডিফিকাল্ট রিটায়ারমেন্ট’ অধ্যায়ে তুলে ধরেছেন ভিন্ন এক ইমরানকে। আজ পাঠকদের জন্য থাকছে পরের অংশটুকু।

জাভেদ মিয়াঁদাদ কী লিখেছেন

১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ জয়ের পর আমি ইমরান খানের জায়গায় পাকিস্তানের অধিনায়ক হই। অন্য যে কারও চেয়ে পাকিস্তান দলকে আমি ভালোভাবে জানতাম, সামনের কয়েক বছরে দলকে কোথায় নিয়ে যেতে চাই তার একটা পরিকল্পনাও আমার ছিল। আমার সব ধরনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের সাফল্যের ধারা এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্য ছিল আমার।

বিশ্বকাপ সাফল্যের পর আমার নেতৃত্বে পাকিস্তান দল ইংল্যান্ডে পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ জেতে ২-১ ব্যবধানে। এরপর যাই নিউজিল্যান্ডে, সেখানে হ্যামিল্টনে সিরিজের একমাত্র টেস্টেও জিতি। ম্যাচটিতে আমি ৯২ রান করি।

আমার ভাবনাজুড়ে তখন পাকিস্তান ক্রিকেটের আগামীর দিনগুলো। অপেক্ষায় ছিলাম, নিরবচ্ছিন্নভাবে অধিনায়কত্ব করতে পারব, এবং ইমরান ও আমি আগের দশকে পাকিস্তান ক্রিকেটের জন্য যে ভিত্তি স্থাপন করেছিলাম তা আরও শক্ত করে তোলার সুযোগ পাব।

কিন্তু নিউজিল্যান্ড থেকে ফিরে আসার পর আমি পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি আবহ পেলাম। বোর্ডের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তাঁদের মনোভাব ছিল নেতিবাচক। কেউই আমার নেতৃত্ব বা আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ইতিবাচক কিছু বলেননি। আমি যে আর বোর্ডের পছন্দের অধিনায়ক নই, এটা বুঝতে আইনস্টাইন হওয়ার দরকার ছিল না।

আমাকে সরিয়ে ওয়াসিম আকরামকে পাকিস্তানের নতুন অধিনায়ক করার একটি পদক্ষেপ চলছিল। এই পদক্ষেপের উৎস শেষ পর্যন্ত ইমরানের কাছেই খুঁজে পাওয়া যেতে পারে, পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডে যাঁর প্রভাব তখনো খুব শক্তিশালী। ইমরান বোর্ডের সব শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার (যার মধ্যে চেয়ারম্যান ও সেক্রেটারিও) ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পেয়েছিলেন।

আমি জানি না ইমরানের উদ্দেশ্য কী ছিল; আমি শুধু অনুমানই করতে পারি। সম্ভবত তিনি মনে করেছিলেন মিয়াঁদাদ নির্বিঘ্নে অধিনায়কত্ব করলে তাঁর লিগ্যাসি ম্লান হয়ে যাবে। ইমরান ১৯৯২ বিশ্বকাপের পর আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নেননি। বিশ্বকাপের সময় তাঁর কাঁধে চোট লেগেছিল, তত দিনে মোটামুটি পরিষ্কার ছিল যে ক্যারিয়ারের একেবারে শেষ প্রান্তে আছেন। ইংল্যান্ডে টেস্ট সিরিজের জন্য রওনা হওয়ার ঠিক আগে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের সেক্রেটারি শহীদ রাফি আমাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, আমি যত দিন খেলব তত দিন পাকিস্তানের অধিনায়ক থাকব। ইমরানের নেতৃত্বে ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই।

জাভেদ মিয়াঁদাদ ও ইমরান খান।

১৯৯২ সালের গ্রীষ্মের শুরুতে যখন আমি দল নিয়ে ইংল্যান্ডে গেলাম, তখন ইমরান সেখানে খুব সক্রিয় ছিলেন। তিনি ইংরেজি সংবাদপত্রে কলাম ও নিবন্ধ লিখছিলেন। কয়েকটি লেখায় তিনি আমাদের দুর্বলতা এবং কৌশল প্রকাশ করারও চেষ্টা করছিলেন। একটি কলামে তিনি লিখেছিলেন যে সিম বোলারদের জন্য সহায়ক উইকেটে পাকিস্তানি ব্যাটিং সবচেয়ে বেশি উন্মোচিত হবে। ব্যাপারটা এমন নয়, তিনি শত্রুর কাছে রাষ্ট্রের গোপনীয়তা প্রকাশ করছিলেন। তবে একজন অধিনায়ক আপনি সর্বশেষ অধিনায়কের কাছ থেকে এমন কিছু নিশ্চয়ই আশা করবেন না।

সেই সফরে ইমরান দলের বেশ কয়েকজন সদস্যের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতেন, বিশেষ করে জুনিয়রদের সঙ্গে। এমনকি তিনি একটি পার্টিরও আয়োজন করেছিলেন, যেখানে তিনি রমিজ রাজা, সেলিম মালিক এবং আমাকে ছাড়া পুরো দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমার কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুতই লাগে। এই লোকটি কয়েক মাস আগেও একটি উচ্চ পদ থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, দলের তরুণদের সঙ্গে কথা বলার সময়ও দিতেন না। এখন তিনি এই একই নিম্নপদস্থ তরুণদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন এবং তাদের রাতের খাবারের জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। এই ব্যাপারটায় কিছু একটা ছিল।

আমার অনুমান, ইমরানের ওই প্রচেষ্টার লক্ষ্য ছিল আমার অধিনায়কত্বের বিরুদ্ধে একটি ক্ষেত্র তৈরি করা। ১৯৯২ সালে ইংল্যান্ডে আমার সফরটা দারুণ ছিল, অধিনায়কত্ব নিয়ে কোনো ভয় বা সংশয় ছিল না। সেই সময়ে ইমরানের এই কাজগুলো অতটা গুরুতর কিছু মনে হয়নি। তবে নিউজিল্যান্ড থেকে ফেরার পর যখন আমার নিরবচ্ছিন্ন অধিনায়কত্বের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, তখন সবকিছুই নিখুঁতভাবে বোঝা গেল।

এক ফ্রেমে (বাঁ থেকে) জাভেদ মিয়াঁদাদ, ওয়াসিম আকরাম ও ওয়াকার ইউনিস। ছবিটি ১৯৯২ বিশ্বকাপের সময় ক্যানবেরায় তোলা।

যেমনটা আমি বলেছি, ইমরানের আচরণের পেছনে একটি কারণ ছিল আমি তাঁর লিগ্যাসিকে ম্লান করে দেব—এই ভয়। আমার মনে হয়, তাঁর নিজের অধিনায়কত্বের শেষ দিনগুলো যেভাবে কেটেছিল, তা নিয়ে অসন্তোষও এর একটি কারণ। তাঁর অধীনে আমরা ১৯৯২ বিশ্বকাপ জিতেছি, কিন্তু সেই দলের মধ্যে তিনি সর্বজনীনভাবে প্রশংসিত ছিলেন না। ইমরান একজন চমৎকার ক্রিকেট–নেতা ছিলেন, এতে কারও সন্দেহ নেই। তবে ক্যানসার হাসপাতালের তহবিল সংগ্রহ নিয়ে তাঁর বাড়াবাড়িতে খেলোয়াড়েরা ধৈর্য হারাতে শুরু করেছিল। খেলোয়াড়েরা তার একটা ডাকনাম দিয়েছিল—‘মিটার’। মানে এমন একটি অর্থ গণনাকারী যন্ত্র, যা সব সময় টিকটিক করে চলছে। ইমরান ভালো করেই জানতেন যে তাঁকে চলে যেতে দেখে কোনো খেলোয়াড়ই দুঃখিত হয়নি।

যেমনটা বললাম, আমি শুধু ইমরানের উদ্দেশ্য অনুমান করছি। যদিও আমি নিশ্চিত যে অধিনায়কত্ব থেকে আমার চূড়ান্ত বিদায়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে আমি নিউজিল্যান্ড থেকে ফেরার পর বোর্ডের আসল উদ্দেশ্য প্রকাশ পেতে বেশি দেরি হয়নি। দ্রুতই আকরামকে নতুন অধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। সেই মুহূর্তে আমি বোর্ড চেয়ারম্যান বিচারপতি নাসিম হাসান শাহ এবং বোর্ড সেক্রেটারি শহীদ রাফির মুখোমুখি হয়েছিলাম। তাঁদের বলেছিলাম, ‘আজ আপনারা পাকিস্তানের ক্রিকেটকে ধ্বংস করেছেন।’

ওয়াসিম আকরাম ও জাভেদ মিয়াঁদাদ।

ওয়াসিম আকরামকে আমার জায়গায় অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আমি আমার অনুভূতি জানিয়েছিলাম। এমন নয় যে আকরাম যোগ্য প্রার্থী ছিলেন না। তবে তিনি শুধু সেই মুহূর্তে অধিনায়কত্বের যোগ্য ছিলেন না। আমি দৃঢ়ভাবে অনুভব করেছিলাম যে দলের স্থিতিশীলতার স্বার্থে আমার অধিনায়কত্ব চালিয়ে যাওয়া উচিত ছিল।

আমাকে অপসারণ করার পর দলের স্থায়িত্ব এবং নির্ভরযোগ্যতার দিক থেকে আমরা যে ভিত কষ্ট করে গড়ে তুলেছিলাম, তা নষ্ট হয়ে যায় এবং দল বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। পাকিস্তান ক্রিকেটের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা পরিস্থিতিকে মারাত্মকভাবে ভুলভাবে পড়েছিল, এর জন্য আমাদের ক্রিকেটকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে।

১৯৯২-৯৩ মৌসুসের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর থেকে শুরু করে দশকের শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে অধিনায়কত্বের কোনো অর্থই ছিল না। অধিনায়কত্ব হয়ে উঠেছিল একরকম মিউজিক্যাল চেয়ারের খেলা। এই সময়ে সাতজন ব্যক্তির মধ্যে চৌদ্দবার নেতৃত্ব বদল হয়েছিল। আকরাম তো ছিলই, এরপর সেলিম মালিক, রমিজ রাজা, আবার আকরাম, সাঈদ আনোয়ার, আবার রমিজ, তারপর আবার আকরাম...এভাবেই চলছিল। এই সার্কাসের মধ্যে রশিদ লতিফ এবং আমির সোহেলকেও অধিনায়ক হিসেবে চেষ্টা করা হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই এতে পাকিস্তান ক্রিকেটেরই ক্ষতি হয়েছে।

পাঠকের জন্য তথ্য:

জাভেদ মিয়াঁদাদ তাঁকে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ইমরান খানকে দায়ী করলেও এ বিষয়ে ইমরানের কোনো প্রকাশ্য মন্তব্য দেখা যায়নি। তবে মিয়াঁদাদের পর যিনি পাকিস্তান অধিনায়ক হয়েছিলেন, সেই ওয়াসিম আকরামের দাবি ছিল, ইমরানের কোনো হাত ছিল না। ওই সময় ইমরান ক্যানসার হাসপাতালের প্রকল্প নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। আর মিয়াঁদাদের ‘খেলোয়াড়–ব্যবস্থাপনা’ও ভালো ছিল না।

অবশ্য ওই সময়ের আরেক পাকিস্তান ক্রিকেটার সেলিম মালিক ২০২২ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, জাভেদ মিয়াঁদাদকে অধিনায়কত্ব থেকে সরানো ভুল ছিল। বলে রাখা ভালো, জাভেদ মিয়াঁদাদ সেই ১৯৭৯–৮০ সালেই প্রথমবার অধিনায়ক হয়েছিলেন। যদিও তা ছিল অন্তর্বর্তী দায়িত্বে। এভাবে ১৯৯২ বিশ্বকাপের আগেই মোট ১১ দফায় সিরিজ বা ম্যাচের জন্য অধিনায়কত্ব করেছিলেন মিয়াঁদাদ। এই লেখায় নব্বইয়ের আগের দশকে তাঁর ও ইমরানের দল গড়ে তোলার প্রসঙ্গ বলতে সেটাই বুঝিয়েছেন মিয়াঁদাদ।