
কাশ্মীরে হামলা নিয়ে দুই প্রতিবেশীর উত্তেজনার শুরু; যেটা এখন পরিণত হয়েছে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে। কাল গভীর রাতে পাকিস্তানের ছয়টি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ভারত। পাল্টা হামলায় জবাবটা রাতেই দিয়েছে পাকিস্তান। এতে দুই দেশের ক্রিকেট ম্যাচ নিয়েও নতুন করে এক শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
স্রেফ রাজনৈতিকভাবে বৈরী সম্পর্কের কারণে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বছরের পর বছর দ্বিপক্ষীয় সিরিজ দেখা যায় না। আইসিসি ও এসিসির ইভেন্ট ছাড়া মুখোমুখি হয় না দুই দল। সেখানে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় পরিস্থিতি এখন আরও কঠিন। তাই এই প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ক্রিকেট ম্যাচ আর দেখা যাবে তো?
অতীতে কিন্তু যুদ্ধ পরিস্থিতি কিংবা যুদ্ধ লাগলে ক্রিকেট মাঠে মুখোমুখি হয়নি দুই প্রতিবেশী। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের বিপক্ষে ভারতের জড়িয়ে পড়ার কারণে ১৯৬২ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যে এ দুই দেশের মধ্যে কোনো ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়নি। আর বর্তমান পরিস্থিতির পটভূমিও দীর্ঘকাল ধরে নেতিবাচক।
নিরাপত্তাজনিত ব্যাপার ও বৈরী রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে ২০১৩ সালের পর আর দ্বিপক্ষীয় সিরিজে মুখোমুখি হয়নি ভারত-পাকিস্তান। আইসিসি আয়োজিত টুর্নামেন্ট এবং এসিসি আয়োজিত এশিয়া কাপেই শুধু মুখোমুখি হতে দেখা যায় তাঁদের। কিন্তু পরিস্থিতি যেখানে গড়িয়েছে, তাতে ভবিষ্যতে আইসিসি ও এসিসি টুর্নামেন্টেও এই দ্বৈরথ না দেখার শঙ্কা আছে।
ভারতের কোচ গৌতম গম্ভীর যেমন সাফ বলে দিয়েছেন, সন্ত্রাসী হামলা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো কিছুই হওয়া উচিত না। কাল দিল্লিতে এবিপি গ্রুপের এক অনুষ্ঠানে গম্ভীরের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, পাকিস্তানের সঙ্গে নিরপেক্ষ ভেন্যুতেও খেলা উচিত কি না ভারতের? গম্ভীরের উত্তর, ‘আমার ব্যক্তিগত উত্তর হলো, একদমই না। এসব (সন্ত্রাসী হামলা) বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কিছুই হওয়া উচিত নয়।’
দ্বিপক্ষীয় সিরিজ বন্ধের পর আইসিসি ও এসিসির টুর্নামেন্টে নিরপেক্ষ ভেন্যুতে মুখোমুখি হয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। গত মার্চে শেষ হওয়া চ্যাম্পিয়নস ট্রফির কথাই ধরুন। পাকিস্তান আনুষ্ঠানিক আয়োজক হওয়ায় নিরাপত্তাজনিত বিষয় দেখিয়ে সেখানে খেলতে যেতে রাজি হয়নি ভারত। অনেক তর্কবিতর্কের পর হাইব্রিড পদ্ধতিতে টুর্নামেন্টটি আয়োজন করা হয়, যেখানে ভারত নিজেদের ম্যাচগুলো খেলেছে দুবাইয়ে।
২০২৩ এশিয়া কাপেও ভারত আয়োজক দেশ পাকিস্তানে খেলতে যেতে রাজি হয়নি। বাধ্য হয়েই হাইব্রিড পদ্ধতিতে ভারতের ম্যাচগুলো শ্রীলঙ্কায় আয়োজন করা হয়।
গম্ভীর এখন নিরপেক্ষ ভেন্যুতেও ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ দেখতে রাজি নন। যদিও এই মন্তব্য তিনি করেছেন ভারত-পাকিস্তান হামলা-পাল্টা হামলার আগে। গতকাল গভীর রাতে হামলার ঘটনা ঘটার পর ভারতের প্রধান কোচের অবস্থান নিশ্চয়ই আরও কঠোর হয়েছে। যদিও সবকিছু দেশের সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন গম্ভীর।
এর আগে ভারত ক্রিকেট দল যতবার নিরাপত্তাকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে পাকিস্তানে যেতে আপত্তি জানিয়েছে, প্রতিবারই তাঁরা এ বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্তকে সামনে টেনে এনেছেন। অর্থাৎ, নিরাপত্তাজনিত বিষয়ে সরকারের অনুমতি নেই। সেটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মানে এমনিতে যে বৈরী সম্পর্ক থাকে তখন। কিন্তু এখন যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় ভবিষ্যতের জন্য ‘ক্রিকেট ডিপ্লোমেসি’তে ভারত সরকার যে আরও কঠোর হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সে ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ভেন্যুতেও দুই দলকে মুখোমুখি হতে না-ও দেখা যেতে পারে।
ভারত এত দিন পাকিস্তান সফরে যে অনড় অবস্থান দেখিয়েছে, সেটা এখন দেখাতে পারে পাকিস্তান। গত ডিসেম্বরে বিসিসিআই ও পিসিবির মধ্যে চুক্তিপত্রে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, যেহেতু চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলতে ভারতীয় দল পাকিস্তানে যাবে না, তাই ২০২৭ সাল পর্যন্ত ভারতে হতে চলা কোনো বৈশ্বিক আসরে খেলতে পাকিস্তানের কোনো দল (নারী-পুরুষ উভয়ই) সে দেশে যাবে না। ২০২৭ সালের মধ্যে ভারতে দুটি বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট হবে—২০২৫ নারী বিশ্বকাপ এবং ২০২৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। এ ছাড়া চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে এশিয়া কাপ, যেটা হওয়ার কথা ভারতে, সহ-আয়োজক হিসেবে শ্রীলঙ্কার নামও এসেছে।
ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে গত ২২ এপ্রিল সন্ত্রাসী হামলা ২৬ জনের মৃত্যুর পর পাকিস্তানের ওপর আরও কঠোর হয় ভারত সরকার। বাবর আজম, ওয়াসিম আকরাম, মোহাম্মদ রিজওয়ান, শোয়েব আখতারদের মতো দেশটির ক্রিকেট তারকাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম চ্যানেল নিজেদের ভূখণ্ডে ‘ব্লক’ করে দেয় ভারত। তখন থেকেই যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল দুই দেশের মধ্যে। আর গতকাল রাতে হামলাটি যেহেতু আগে করেছে ভারত, পাকিস্তান সরকার তাই তাঁদের দেশের ক্রিকেট দলকে ভারতে যাওয়া দূরের কথা নিরপেক্ষ ভেন্যুতেও খেলার অনুমতি না-ও দিতে পারে।
কিংবা কিছুদিন আগে ‘স্পোর্টস টুডে’কে বলা সুনীল গাভাস্কারের কথাগুলোই যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলেও শঙ্কার জায়গা থাকে। ভারতীয় কিংবদন্তি বলেছিলেন, বর্তমান পরিস্থিতির উন্নয়ন না ঘটলে পাকিস্তানকে তিনি এ বছরের এশিয়া কাপে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেখেন না। অর্থাৎ পাকিস্তানকে এশিয়া কাপ থেকে বের করে দেওয়া হতে পারে কিংবা এসিসি ভেঙেও যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছিলেন গাভাস্কার। শেষ কথায় গাভাস্কার বলেছিলেন, ‘যদি দুটি দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করে, তাহলে একে অপরের সঙ্গে খেলাধুলা করা একটু কঠিন।’
গাভাস্কারের এমন মন্তব্য বিশ্বাস হয়নি পাকিস্তান কিংবদন্তি জাভেদ মিয়াঁদাদের। তবে বিষয়টি কূটনৈতিক জায়গা থেকে দেখলে সত্যিই দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ সময়ের জন্য খেলাধুলা না হওয়ার শঙ্কাও থাকে। পাকিস্তানের কথাই ধরুন। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ভারতে এমনিতেই খেলতে যাবে না পাকিস্তান। সহ-আয়োজক শ্রীলঙ্কা তাহলে তাঁদের নিরপেক্ষ ভেন্যু। কিন্তু সাম্প্রতিক উত্তপ্ত পরিস্থিতি এবং বর্তমান সময়ে যে যুদ্ধ চলছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সঙ্গে নিরপেক্ষ ভেন্যুতেও পাকিস্তান মুখোমুখি না-ও হতে পারে। ভারত যে এ বিষয়ে এককাঠি এগিয়ে থাকবে, সেটা তো গাভাস্কারের কথাতেই পরিষ্কার।
ভারতীয় ক্রিকেটের কিছু সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড়েরা এরই মধ্যে পাকিস্তানে নিজ দেশের সামরিক হামলার সমর্থন করেছেন। পাকিস্তানেও নিশ্চয়ই একই জনমত তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ, অচলাবস্থা তৈরি হয়ে গেছে কিংবা হলো বলে! মুখোমুখি দাঁড়ানো দুটি দেশের জনমত ও খেলোয়াড়দের মতামত এবং যুদ্ধ এড়িয়ে দুই দেশের সরকারপ্রধানেরা নিশ্চয়ই খেলাধুলায় শান্তি খুঁজতে যাবেন না।