
সব সামলে নেওয়া তেজা নিদামানারুর সবচেয়ে বড় পরিচয় এখন নেদারল্যান্ডস জাতীয় দলের ক্রিকেটার। ওই সূত্রেই বাংলাদেশের বিপক্ষে তিন ম্যাচের টি–টোয়েন্টি সিরিজ খেলতে তিনি এখন সিলেটে।
গল্পের শুরু ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে। যাত্রাবিরতিতে গল্পটা থেমেছিল নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে। কয়েক বছরের ওই বিরতির সময়টাই তাঁর চোখে পাকাপাকিভাবে বুনে দেয় ক্রিকেটের স্বপ্ন। চূড়ান্তভাবে খুঁজে পাওয়া গন্তব্যটার নাম অবশ্য নেদারল্যান্ডস। গল্পটা যাঁর, সেই তেজা নিদামারামুর ভাষায়, আমস্টারডামে পৌঁছেই তাঁর ক্রিকেট–যাত্রার ‘চক্রপূরণ’।
অভিবাসী একা জীবন, পড়াশোনা আর সঙ্গে একটা পূর্ণকালীন চাকরি—সব সামলে নেওয়া তেজার সবচেয়ে বড় পরিচয় এখন নেদারল্যান্ডস জাতীয় দলের ক্রিকেটার। ওই সূত্রেই তিন ম্যাচের টি–টোয়েন্টি সিরিজ খেলতে তিনি এখন সিলেটে।
তিন দেশ ঘুরে যেটার ‘চক্রপূরণ’, সেই ক্রিকেটটা যে তাঁর পূর্ণকালীন পেশা নয়, তা বোঝাতে বোঝাতেই গতকাল সিলেটের একাডেমি মাঠে দাঁড়িয়ে তেজা বলছিলেন কথাগুলো, ‘আমি কিন্তু এখানেও ল্যাপটপ নিয়ে এসেছি, এত দূরে বসেই সবকিছু সামলে নিতে হয়। অনুশীলনের পর গিয়ে দেখব, অনেক ই–মেইল আর হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ জমে আছে, ওগুলোর উত্তর দিতে হবে, মিটিং করতে হবে, আরও কত কী!’
নেদারল্যান্ডসের বেশির ভাগ ক্রিকেটারের গল্পই এমন। অলরাউন্ডার তেজা বরং নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন তাঁর চাকরির সঙ্গে ক্রিকেটেরও একটা যোগসূত্র থাকায়। আমস্টারডামের ঐতিহ্যবাহী ক্লাব ভিআরএ ক্রিকেটের মহাব্যবস্থাপকের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। সেখান থেকে সময় বের করে মাঝেমধ্যে কোচদের কাছে যান অনুশীলন করতে, অনেক সময় জাতীয় দলের কোচরাও নাকি তাঁর কাছে এসে তাঁকে অনুশীলন করিয়ে যান!
ব্যক্তিগত অনুশীলন করাতে কোচরা ক্রিকেটারের কাছে যান? অবিশ্বাসের সুরে করা প্রশ্নটা পুরো শেষ হওয়ার আগেই তেজা বলতে শুরু করেন, ‘নেদারল্যান্ডসে ক্রিকেট খেলে যে বড়জোর ঘোরাঘুরির খরচ ওঠানো সম্ভব, সংসার চালানো যাবে না—তা কি আর কোচরা বোঝেন না! আমাদের সংসার চালাতে অন্য কিছু করতে হয়, তাঁরা তা জানেন। এ জন্যই চলে আসেন।’
ভারতে ছোটবেলায় দাদার হাত ধরে ক্রিকেটে হাতেখড়ি। কিন্তু বাবার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ছয় বছর বয়সেই তাঁকে নিয়ে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে চলে যান মা। একটা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে চাকরি শুরু করেন। বছর দশেক পর মা ফিরে আসেন ভারতে। শুরু হয় তেজার একার লড়াই।
নিউজিল্যান্ডে তত দিনে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয়ে গেছে তেজার, কিন্তু থিতু হতে পারছিলেন না। মন দেন পড়াশোনায়। ক্রীড়া ব্যবস্থাপনা ও বিপণন বিষয়ে পড়াশোনা শেষে শুরু করেন চাকরিও।
ক্রিকেট ক্যারিয়ার এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন যখন ধূসর হতে শুরু করেছে, তখনই নেদারল্যান্ডসের এক ক্লাব থেকে প্রস্তাব পান ৬ মাস তাঁদের হয়ে খেলার। নেদারল্যান্ডসে যান ‘ওয়ার্ক’ ভিসা নিয়ে। এরপর সেই ৬ মাস এখন ছয় বছর পেরিয়ে গেছে।
নেদারল্যান্ডস জাতীয় দলের হয়ে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছেন, খেলেছেন দুটি বিশ্বকাপেও। ২০২৩ সালে যার শুরুটা হয়েছিল জন্মভূমি ভারতেই। ‘সে ছিল এক ভিন্ন রকম রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। আমার পরিবারের সবাই খেলা দেখতে এসেছিল’—রোমাঞ্চের সেই গল্পের কথা শোনাচ্ছিলেন তেজা।
৩১ বছর বয়সী তেজা এখন আমস্টারডামে একটা বাড়ির মালিক। একটু রসিকতার ছলেই জানতে চাওয়া, ‘ক্রিকেটের টাকা দিয়ে কিনলেন?’ চওড়া হাসি দিয়ে উত্তরটা দিলেন সিরিয়াস ভঙ্গিতে, ‘আরে নাহ! বাড়ি কেনার বেশির ভাগ টাকাই এসেছে আমার চাকরি থেকে। ক্রিকেট থেকে যা পাই, তা সামান্যই।’
ওই ‘সামান্য’টা অবশ্য কেবল টাকার অঙ্কই, তেজার কাছে ক্রিকেটটা হলো ‘প্যাশন’, যেটা তাঁর কাছে এখন সবার আগে।