একজনের নাম চেতেশ্বর পূজারা, যাঁর ক্যারিয়ার আর জীবনটাকে অনেকেই দেখেছেন টিভি পর্দায়। ভারতীয় টেস্ট দলের তিন নম্বর ব্যাটসম্যান। ধৈর্যের প্রতিমূর্তি। একের পর এক শরীরের ওপর বল নিয়ে, দাঁতে দাঁত চেপে লড়েছেন দলের জন্য।
ঠিক তাঁর পাশেই থাকেন আরেকজন, যিনি এসব দেখে লিখে রাখতেন চুপি চুপি—পূজা পূজারা, চেতেশ্বরের স্ত্রী। সেই ডায়েরির পাতাগুলো একসময় হয়ে উঠল একটি বই ‘দ্য ডায়েরি অব আ ক্রিকেটার্স ওয়াইফ’। বইটি প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি।
বিয়ের আগে ক্রিকেট নিয়ে কোনো ধারণাই ছিল না পূজার। চেতেশ্বরের নামও শোনেননি। বিয়ের পর প্রথমে আগ্রহ, পরে ভালোবাসা, আর শেষমেশ একটা অভ্যাস হয়ে যায় ক্রিকেট—খুব কাছ থেকে দেখা, শোনা, বুঝে ফেলা। এমবিএ শেষ করে করপোরেট চাকরি করতেন পূজা, পছন্দও করতেন সেটা। কিন্তু বিয়ের পর সেটি ছেড়ে দেন। তাঁদের প্রথম কন্যা যখন তিন বছরের, তখন আবার কাজে ফেরার ইচ্ছা জাগে। তবে তত দিনে চেতেশ্বরের ম্যানেজার হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। ব্যস্ততা এত বেশি ছিল যে পূর্ণকালীন কোনো কাজ করা সম্ভব ছিল না।
যখন চেতেশ্বরের সঙ্গে ট্যুরে যেতেন, হাতে অনেক সময় থাকত। এ ফাঁকেই ডায়েরির পাতায় পাতায় জমতে থাকে ছোট ছোট নোট। শ্বশুর অরবিন্দ পূজারা তাঁর ছেলে আর পরিবারের সংগ্রামের গল্প বলতেন, আর পূজা সেগুলো শুনে শুনে লিখে রাখতেন।
২০২১ সালে চেতেশ্বরই একদিন বললেন, ‘এসব লেখা একত্র করে বই বানাও না একটা।’ ইচ্ছাটা আসলে পূজারও শুরু থেকেই ছিল—এগুলো একদিন বই হবে, যদিও কাউকে বলেননি।
সেই বই এখন বাস্তব, যেখানে এক ক্রিকেটারের স্ত্রীর চোখে ফুটে উঠেছে পরিবারের ওঠানামা, মানসিক চড়াই-উতরাইয়ের গল্প। সেই গল্প এখন পড়ছে পুরো ক্রিকেট–বিশ্ব।
চেতেশ্বর শুরুতে কিছুটা অস্বস্তিতে ছিলেন, বই বের হলে মানুষ কী ভাববে? কিন্তু পূজা নিশ্চিত করেছিলেন, তাঁকে শুধু সাধু বানানো হবে না, বরং পুরো মানুষটা তুলে ধরা হবে—ভালোমন্দ মিলিয়ে।
পূজা বলেছিলেন, ‘তোমার এই পথচলা ভীষণ প্রেরণাদায়ক। আমি চাই কেউ সেটা থেকে অনুপ্রাণিত হোক। আমি শুধু তোমার উত্থান নয়, পতনের দিকটাও দেখাব।’
২০১৫ সালে সিডনি টেস্টে দল থেকে বাদ পড়েছিলেন চেতেশ্বর। সে সময় অস্ট্রেলিয়ায় ছিলেন পূজা। ইএসপিএনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, ‘আমার মনে হচ্ছিল, পৃথিবীটাই উল্টে গেছে। ম্যাচ দেখতে সিডনি যাওয়ারই ইচ্ছা হয়নি।’ পরে বুঝলেন, নিজে ভেঙে পড়লে বরং চেতেশ্বরের ওপর চাপ বাড়বে। তখন ঠিক করলেন, স্বামীকে যতভাবে পারা যায় সমর্থন দিতে হবে, নিজের কষ্ট লুকিয়ে রাখতে হবে।
পূজা বলেছেন, ‘একটা দলে মাত্র ১১ জনই তো খেলতে পারে। যে জায়গা পায়, তাঁর পরিবার নিশ্চয়ই খুব খুশি হয়। এটা বুঝতে আমার সময় লেগেছে।’
সেই ম্যাচে বাদ পড়ার খবরটাও পূজাকে দেননি চেতেশ্বর। ওভাবে কষ্টের খবর দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। বরং নিজেই একা লড়তেন, পরিবারের কাছে নিজের কষ্ট লুকাতে চাইতেন।
কিন্তু পূজা বুঝতেন। তাঁর কাছে মনে হতো, চেতেশ্বর নিজেও বুঝছেন না যে তিনি মানসিকভাবে ক্লান্ত। স্বামীকে তাই বলেছিলেন, ‘তুমি তো এখন দলে নেই। চলো কথা বলি।’
স্ত্রীর সঙ্গে মন খুলে কথা বলে শান্তি পেয়েছিলেন পূজারা। কাজে দিয়েছিল আরও একটা কাউন্সেলিং। চেতেশ্বরই বলেছেন, ‘ইয়র্কশায়ারের মানসিক কন্ডিশনিং কোচ আমাকে শিখিয়েছিলেন, কখনো কখনো ৫০ রান করাও সাফল্য। প্রতিবার ১০০ করতে হবে, এমন নয়।’
২০২১ সালে ব্রিসবেন টেস্টে চেতেশ্বর পূজারার সেই ইনিংস অনেক দিন মনে রাখার মতো—মিচেল স্টার্ক, জশ হ্যাজলউড, প্যাট কামিন্স আর নাথান লায়নের সামনে একা দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কনুই, ঊরু, গলা, আঙুল, হেলমেটের গ্রিল—কোথায় বল লাগেনি। তবু ৫৬ রানের ইনিংস খেলে ভারতের সিরিজ জয়ে বড় অবদান রাখেন।
ওই ইনিংস ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য অনুপ্রেরণা হলেও পূজার জন্য ছিল দুঃস্বপ্ন।
‘আমি আতঙ্কে ছিলাম’—বলেন পূজা, ‘সবাইকে মেসেজ করছিলাম—ফিজিও, ম্যানেজার। কারণ, কয়েকটা বল মাথার কাছ দিয়ে গিয়েছিল। ভয় লাগছিল।’
ম্যাচ শেষে চেতেশ্বর ফোন তুলতেই দেখেন, পূজার মেসেজের বন্যা। উত্তরে লিখলেন, ‘আমি ঠিক আছি।’ এরপর একটু কথা বলে চলে যান দলের সঙ্গে উদ্যাপনে। তাঁর কথা, ‘ব্যথা ছিল, কিন্তু মিষ্টি ব্যথা। কারণ, ভারত ম্যাচ আর সিরিজ জিতেছিল।’
২০২৩ সালের জুনে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল ছিল পূজারার শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। তারপর আর দলে ফিরতে পারেননি। পূজা একসময় পরামর্শ দিয়েছিলেন কোচিং বা ব্রডকাস্টিং নিয়ে ভাবতে। পূজারা তখন রাজি হননি। পরে মত বদলান, যোগ দেন ইএসপিএন-ক্রিকইনফোর বিশ্লেষণধর্মী শোতে। বলছেন, ‘সেটা আমাকে খেলার ভিন্ন একটা দিক দেখিয়েছে, নিজের খেলা নিয়েও ভাবতে শিখিয়েছে।’ এখন তো অনেক সিরিজেই ধারাভাষ্য দেন।
তবে ৩৭ বছর বয়স হলেও এখনো অবসরের কথা ভাবছেন না পূজারা। খেলার ক্ষুধা রয়ে গেছে। চান আবারও মাঠে ফিরতে।
যদি ফিরতে পারেন, কে জানে হয়তো পূজার ‘দ্য ডায়েরি অব আ ক্রিকেটার্স ওয়াইফ’-এর ‘পার্ট টু’ আসতেও পারে!