টেস্ট ক্রিকেটের চতুর্থ ইনিংসেই নাকি সত্যিকারের কিংবদন্তিরা জন্ম নেন!
কারণ? তখন লড়াই করতে হয় কন্ডিশনের সঙ্গে, লড়াই করতে হয় সময়ের সঙ্গে, ছুটতে হয় লক্ষ্যের পেছনে এবং সেটাই থাকে শেষ সুযোগ। টেস্ট ইতিহাসের সেরা ইনিংসগুলোর অনেকগুলোই এসেছে এই চতুর্থ ইনিংসে। ব্রিজটাউনে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ব্রায়ান লারার সেই ১৫৩, ডারবানে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে কুশল পেরেরার ১৫৩ কিংবা লিডসে বেন স্টোকসের অপরাজিত ১৩৫—ইনিংসগুলো একবার মনে করে দেখুন। প্রতিটিই চতুর্থ ইনিংসে, দুর্দান্ত বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে, অবিশ্বাস্য চাপের মুখে এবং ৩০০-এর বেশি রান তাড়া করার লক্ষ্যে। প্রতিবারই ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ হয়ে এই ব্যাটসম্যানরা দলকে জিতিয়েছেন ১ উইকেটে!
এসব ইনিংস একজন ব্যাটসম্যানকে কিংবদন্তি করে তোলে। কারণ, এমন ইনিংসের দেখা মেলে কালেভদ্রে।
তবে এখনকার ক্রিকেটে চতুর্থ ইনিংসে রান তাড়া করে এমন জয় কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। আর সেটাকে স্বাভাবিক বানিয়ে ফেলার কৃতিত্ব প্রধানত ইংল্যান্ডের। গতকালই যেমন আরও একবার টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে ৩০০ রানের বেশি তাড়া করে জিতেছে বেন স্টোকসের দল। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, হেডিংলিতে জয়ের জন্য ইংল্যান্ডের লক্ষ্য ছিল ৩৭১ রানের, স্বাগতিকেরা ম্যাচ জিতে গেছে ৫ উইকেট হাতে রেখে, ওভারপ্রতি ৪.৫৪ রান তুলে!
টেস্টের চতুর্থ ইনিংস ও পঞ্চম দিনের উইকেট, যেটাকে একসময় বধ্যভূমি মনে হতো ব্যাটসম্যানদের কাছে, সেখানে শুধু ইংল্যান্ডই নয়, অন্য দলগুলোও সাম্প্রতিক কালে বড় রান তাড়া করতে নেমে জয়ের জন্য খেলছে এবং জিতছেও।
একটা পরিসংখ্যান দিলে ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হয়ে যাবে। ২০২০ সাল পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে, চতুর্থ ইনিংসে ২৫০ বা এর বেশি রান তাড়া করে জেতার ঘটনা মাত্র ৬৫টি। পরাজয় ১৬৪ বার। অর্থাৎ হার-জিত দেখেছে—এমন ম্যাচগুলোর মধ্যে জয়ের হার ছিল মাত্র ২৮.৩ শতাংশ। যেখানে ২০২০ সাল থেকে হিসাব করলে চতুর্থ ইনিংসে ২৫০ বা এর বেশি রান তাড়া করে জেতার ঘটনা ১৫ বার, আর পরাজয় ১৭ বার। অর্থাৎ এই সময়ে জয়ের হার প্রায় ৪৬.৮ শতাংশ! দলগুলোর খেলার ধরনে বড় পরিবর্তন এসেছে, এটা তো বলাই যায়।
বেন স্টোকস অধিনায়ক হওয়ার পর থেকে ইংল্যান্ড চতুর্থ ইনিংসে ২৫০ বা এর বেশি রান তাড়া করে ৯ বারের মধ্যে ৬ বারই জিতেছে!
এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে ইংল্যান্ডই। ২০২২ সালের গ্রীষ্মে বেন স্টোকস অধিনায়ক হওয়ার পর থেকে ইংল্যান্ড চতুর্থ ইনিংসে ২৫০ বা এর বেশি রান তাড়া করে ৯ বারের মধ্যে ৬ বারই জিতেছে! নিজেদের মাঠে ইংল্যান্ডের এই পরিসংখ্যান আরও দুর্দান্ত—৭ বারের মধ্যে ৬ বারই জয়!
এ পরিবর্তনে ইংল্যান্ডের দেখানো পথে হাঁটছে অন্য দলগুলোও। চট করে স্মৃতি নাড়া দিলে উঠে আসবে গ্যাবায় ২০২১ সালে ৩২৯ তাড়া করে ভারতের জয়ের উদাহরণ, একই বছর চট্টগ্রামে ৩৯৫ রান তাড়া করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়, ২০২২ সালে গলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৩৪২ করে পাকিস্তানের জয়, এমনকি চলতি মাসে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ২৮২ করে দক্ষিণ আফ্রিকার জয়ের ঘটনাও।
চতুর্থ ইনিংসে সফলভাবে এমন বড় রান তাড়া করাটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠার একটা বড় কারণ হলো—টেস্ট ম্যাচের গতি এখন দ্রুততর হয়েছে। আগে টেস্টের শেষ ইনিংসে পিচ হয়ে যেত বোলারদের জন্য স্বর্গ। এখন অনেক মাঠেই শুরুতে আর্দ্রতা থাকলেও পরে ব্যাটিং সহজ হয়ে যায়। এই তো বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালেই যেমন লর্ডসে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংস শেষ হয়ে গেছে তৃতীয় দিন দুপুরেই। দক্ষিণ আফ্রিকা বাকি সময়টা পেয়েছে ব্যাটিংয়ের জন্য। এইডেন মার্করাম ও টেম্বা বাভুমা বেশ আরামেই ব্যাটিং করেছেন। কারণ, অস্ট্রেলিয়া শুরুর দিকে সিম মুভমেন্টের যে সুবিধা নিয়েছিল, সেটা তখন আর ছিল না।
এই দশকে ইংল্যান্ডে হওয়া টেস্টগুলোতে প্রথম ইনিংসে উইকেটপ্রতি রান উঠেছে ৩১, দ্বিতীয় ইনিংসে ৩২.৫, তৃতীয় ইনিংসে ২৭.৪। চতুর্থ ইনিংসে কত জানেন? ৩৬.৩, সবচেয়ে বেশি। আগের দশকে চতুর্থ ইনিংসে উইকেটপ্রতি গড় রানের চেয়ে যা ১৩ বেশি!
এবারের আগে ভারত যখন সর্বশেষ ইংল্যান্ড সফর করেছিল, এজবাস্টনে টসে জিতে বেন স্টোকস বলেছিলেন, তাঁরা রান তাড়া করতে চান। ওই টেস্টেও ইংল্যান্ড চতুর্থ ইনিংসে ৩৭৮ রান করে জিতেছিল। এরপর এবার হেডিংলিতে ৩৭১ করে জয়। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে চতুর্থ ইনিংসে সবচেয়ে বেশি রান তাড়া করে জয়ের তালিকায় এই দুটি ইনিংসই ১ ও ২ নম্বরে। হেডিংলিতে তো সর্বশেষ সাতটি টেস্টেই রান তাড়া করা দল জিতেছে!
চতুর্থ ইনিংসে রান তাড়া সহজ হয়ে যাওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা আছে আধুনিক মাঠ ব্যবস্থাপনা, উন্নত ড্রেনেজ সিস্টেমেরও (যে কারণে পিচে অতটা আর্দ্রতা থাকে না)। আরেকটা বড় কারণ, সীমিত ওভারের ক্রিকেট এখন ব্যাটসম্যানদের আরও সাহসী করে তুলেছে, তাঁরা শিখে ফেলেছেন কীভাবে রান তাড়া করতে হয়। বেন ডাকেট বা জো রুটের মতো ব্যাটসম্যানরাও তাই টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে হুট করে রিভার্স সুইপ খেলছেন, ঝুঁকি নিয়ে রান তুলছেন ওয়ানডে-টি-টোয়েন্টির মতো। একা জো রুটই তো ২০২২ থেকে এখন পর্যন্ত টেস্টে ৬ বার অপরাজিত থেকে ম্যাচ জিতিয়েছেন।
চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করা সবচেয়ে কঠিন, এই মিথও আসলে ভেঙে দিতে বড় ভূমিকা রেখেছে ইংল্যান্ডই। এই দশকে ইংল্যান্ডে হওয়া টেস্টগুলোতে প্রথম ইনিংসে উইকেটপ্রতি রান উঠেছে ৩১, দ্বিতীয় ইনিংসে ৩২.৫, তৃতীয় ইনিংসে ২৭.৪। চতুর্থ ইনিংসে কত জানেন? ৩৬.৩, সবচেয়ে বেশি। আগের দশকে চতুর্থ ইনিংসে উইকেটপ্রতি গড় রানের চেয়ে যা ১৩ বেশি!
চতুর্থ ইনিংসে রান তাড়া তাহলে এখন সত্যিই সহজ হয়ে গেছে!