আজ মুশফিকের শততম টেস্ট
আজ মুশফিকের শততম টেস্ট

উৎপল শুভ্রর লেখা

অভিনন্দন, মুশফিকুর রহিম

প্রথম আলোতে এখন পর্যন্ত মুশফিকুর রহিমের কতগুলো ছবি ছাপা হয়েছে, বলতে পারবেন?

প্রশ্নটাই কেমন যেন! মুশফিকুর রহিমের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের বয়স ২০ বছরের বেশি। সেই ২০ বছরে বলার মতো কীর্তিও কম নয়। প্রথম আলোর খেলার পাতা ছাপিয়ে প্রথম পৃষ্ঠাতেও প্রায়ই তা উপচে পড়েছে। মুশফিকুর রহিমের ছাপা হওয়া ছবির সংখ্যা বলাটা কীভাবে সম্ভব!

প্রশ্নটা করেছি বটে, তবে উত্তর আমিও জানি না। তবে এটা তো জানি, প্রথম আলোতে মুশফিকুর রহিমের প্রথম যে ছবিটা ছাপা হয়েছিল, সেটি ছিল ‘ভুল মুশফিক’-এর ছবি। সেটি আবার কেমন? গল্পটা আগেও বলেছি। বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে মুশফিকুর রহিম শততম টেস্ট খেলতে নামার আগে আবারও নাহয় সেটি মনে করিয়ে দিই।

প্রথম ছবি যেহেতু, সময়টা অনুমান করতেই পারেন। হ্যাঁ, মুশফিকের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের বছর ২০০৫ সালেই। স্পষ্ট মনে আছে, মাছবাজারের শোরগোলের মধ্যে ফোনটা এসেছিল। কলটা ঠিক লোকের কাছেই এসেছে নিশ্চিত হওয়ার পর ওপাশের ভদ্রলোক পরিচয় দিলেন, ‘আমি মাহবুব হামিদ, মুশফিকুর রহিমের বাবা।’

বাবার সঙ্গে মুশফিকুর রহিম। ছবিটি মুশফিকের তরুণ বয়সে তোলা

পরিচয় পেয়েই মনে পড়ে গেল, আগের দিন জিম্বাবুয়েতে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়ে সেঞ্চুরি করেছেন মুশফিকুর রহিম। আমি তাই বললাম, ‘অভিনন্দন। আপনার ছেলে তো কাল সেঞ্চুরি করেছে।’

মাহবুব হামিদ বললেন, ‘এ জন্যই আপনাকে ফোন করেছি। আমার একটা স্বপ্ন ছিল, একদিন প্রথম আলোতে ওর ছবি ছাপা হবে।’

ও আচ্ছা, ছবি ছাপা হয়েছে বলে কৃতজ্ঞতা! আমি হালকা সুরে বললাম, ‘আপনার স্বপ্ন তো পূরণ হয়ে গেল। ছেলের ছবি তো ছাপা হয়েছে আজ।’

কিন্তু উচ্ছ্বাসের বদলে টেলিফোনে ভেসে এল বিষণ্ন একটা কণ্ঠ, ‘ভাই, এটা অন্য কারও ছবি। পেপারে প্রথম মুশফিকের ছবি ছাপা হলো আর সেটিই ওর নাম দিয়ে অন্য একজনের। খুব কষ্ট পেয়েছি।’

শুনে তো আমার মাথা খারাপ অবস্থা। এটা কীভাবে সম্ভব! কীভাবে সম্ভব, ব্যাখ্যা করলে বুঝতে পারবেন।

উদীয়মান প্রতিভা হিসেবে তখন মুশফিকুর রহিমের নাম একটু-আধটু শোনা যাচ্ছে। চেহারায় খুব বেশি মানুষ তখনো তাঁকে চেনে না। ঘরোয়া ক্রিকেটেও খুব বড় কোনো কীর্তি নেই। যে কারণে প্রথম আলোর ছবির বিশাল ভান্ডার খুঁজেও তাঁর পোর্ট্রেট খুঁজে পাওয়া যায়নি। যত দূর মনে পড়ে, মুশফিক তখন প্রিমিয়ার লিগে সে সময়কার প্রতাপশালী দল ওল্ড ডিওএইচএসে খেলেন। ওই দলের একটা গ্রুপ ছবি ছিল। সেখান থেকে মুশফিককে খুব ভালো চেনেন দাবি করে তা কেটে বের করে দিয়েছেন আলোকচিত্র সাংবাদিক। এখন তো দেখা যাচ্ছে, ওটা মুশফিক নয়, তাঁর কোনো ওল্ড ডিওএইচএস সতীর্থের। হ্যাঁ, ২০০৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর খেলার পাতায় সেই ‘ভুল’ মুশফিকের ছবিটাই ছাপা হয়েছিল।

মুশফিকুর রহিম। ক্যারিয়ারের শুরুর দিনগুলোয় যেমন ছিলেন

মাস তিনেক পর লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্টে নেমেছি। সেদিনের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার খেলার পাতা খুলতেই দেখি, মুশফিকুর রহিমের বিশাল এক ছবি। নর্দাম্পটনশায়ারের বিপক্ষে দারুণ এক সেঞ্চুরি করেছেন। সাসেক্সের বিপক্ষে আগের ম্যাচে খেলেছেন ৬৩ রানের এক ইনিংস। বয়স যা, দেখতে লাগে আরও কম। সেই পুঁচকে ছেলের ব্যাটিং ইংল্যান্ডে এমনই আলোড়ন তুলেছে যে ছবির ক্যাপশনে লেখা: লিটল ওয়ান্ডার!

ইংল্যান্ড থেকে পাঠানো প্রথম লেখাটা শুরুও করেছিলাম এ দিয়ে: মুশফিকুর রহিমের বাবা নিশ্চিত থাকতে পারেন, আর কোনো দিন পত্রিকায় মুশফিকুরের ভুল ছবি ছাপা হবে না। তাঁকে এখন সবাই চেনে।

ইংল্যান্ডের ওই সফরে ‘পর্যটক’ হয়েই থাকার কথা ছিল। টেস্ট সিরিজের পর ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজ, প্রায় দুই মাসের সফর, মুশফিককে টেস্ট স্কোয়াডে রাখা হয়েছিল খালেদ মাসুদের বিকল্প উইকেটকিপার হিসেবে। পরপর দুটি প্রস্তুতি ম্যাচে অমন ব্যাটিংয়ের পর দেখা গেল, লর্ডসে প্রথম টেস্টে বাংলাদেশের একাদশে প্রথম নামটিই লিখতে হয় মুশফিকুর রহিমের।

লর্ডস টেস্টেও মুশফিক ভালোই আলোড়ন তুলেছিলেন। টেস্টের প্রথম দিন প্রেসবক্সের পেছনের লাউঞ্জে তুমুল আড্ডা থেকে বিখ্যাত ক্রিকেট ইতিহাসবিদ ডেভিড ফ্রিথের হঠাৎই ছিটকে উঠে দাঁড়ানোর কথা এখনো মনে আছে। ‘এখন ওই ছেলেটা ব্যাট করতে নামবে’ বলে শশব্যস্ত হয়ে প্রেসবক্সে ফিরে যাওয়ার কথাও। ডেভিড ফ্রিথের আগ্রহের মূল কারণ ছিল মুশফিকের বয়স। তখন যা ১৬ বছর ২৬৭ দিন বলে প্রচারিত হয়েছিল। লর্ডসে এত কম বয়সে কেউ কখনো টেস্ট খেলেননি। পরে অবশ্য এতে একটা সংশোধনী এসেছে। এখন রেকর্ড বলে, টেস্ট অভিষেকের সময় মুশফিকের বয়স ছিল ১৮ বছর ১৭ দিন।

বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ১০০তম টেস্ট খেলতে যাচ্ছেন মুশফিকুর রহিম

তা ১৮ বছরের তরুণও তো ইংল্যান্ডে ‘কিড’ বলেই পরিচিত। সেই ‘কিড’ বাংলাদেশের ১০৮ রানের প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ১৯। টেস্ট ক্লাসটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ওতেই। ১৭৭ মিনিট স্থায়ী বাংলাদেশের ইনিংসের প্রায় অর্ধেকটা সময়ই (৮৫ মিনিট) ক্রিজে, আদর্শ ইংলিশ কন্ডিশনে সাপের মতো সুইং করতে থাকা বলে হাবুডুবু খাওয়া বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ লেগেছিল তাঁকেই।

দ্বিতীয় টেস্টেও না খেলার কোনো কারণ ছিল না। খেলতে পারেননি হেরিটেজ টাইপ টিম হোটেলের আদ্যিকালের সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পা মচকে ফেলায়। ১০ মাস পর বগুড়ায় দ্বিতীয় টেস্ট। ক্রিকেট ইতিহাসে আর কোনো উইকেটকিপার প্রথম দুটি টেস্ট স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলেননি। উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে সবচেয়ে বেশি ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ডটি তাই কোনো বিস্ময় নয়। টেস্টে তাঁর তিন ডাবল সেঞ্চুরির দুটিই উইকেটকিপিংয়ের হ্যাপা সামলে। সাঙ্গাকারা-গিলক্রিস্ট-ধোনির মতো উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যানেরও যেখানে একাধিক ডাবল সেঞ্চুরি নেই।

মুশফিককে নিয়ে আসল যে বিস্ময়, সেটি শুরুতেও ছিল, এখনো আছে। ইংল্যান্ডের ওই সফরে তাঁর বয়স নিয়ে যত আলোচনা হয়েছিল, শারীরিক আকৃতি নিয়েও ততটাই। দ্য ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকা মুশফিকের এই উচ্চতা প্রসঙ্গে টেনে এনেছিল বড় বড় সব নাম, ‘ডন ব্র্যাডম্যান, হানিফ মোহাম্মদ, সুনীল গাভাস্কার, শচীন টেন্ডুলকার, ব্রায়ান লারার মতো অনেক বড় বড় ব্যাটসম্যানই উচ্চতায় খাটো। মুশফিকুর রহিমও তাঁদের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন।’

ক্যারিয়ারের শুরুতেই কী সব কিংবদন্তির সঙ্গে তুলনা! ইংলিশ সংবাদমাধ্যম এই বিস্ময় মনে না রেখে মুশফিকের কাছে প্রকাশও করেছিল। মুশফিকের জবাবটা ছিল ক্ল্যাসিক, ‘ক্রিকেট তো বয়স বা উচ্চতার খেলা নয়।’

তা তো এত বছর ধরেই প্রমাণ করে যাচ্ছেন মুশফিকুর রহিম। যার একটি বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি। আর সবচেয়ে বড় প্রমাণ তো চোখের সামনেই—বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট খেলার সেঞ্চুরি!

অভিনন্দন, মুশফিকুর রহিম!