
খারাপ থেকে খারাপতর।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে লিভারপুলের এই মৌসুমটা কেমন কাটছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে শুধু এই কথাটুকু বললে কি সবকিছু বোঝা যায়? সম্ভবত ‘না’। খারাপ সময় তো মৌসুমের প্রায় শুরু থেকেই যাচ্ছে লিভারপুলের। তবে গত পরশু রাতে নটিংহাম ফরেস্টের কাছে ঘরের মাঠে ৩-০ গোলে হার যেন লিভারপুলকে একেবারে তলানিতে নিয়ে গেল!
১২ ম্যাচ পর ১৮ পয়েন্ট লিভারপুলের, লিগ টেবিলে অবস্থান ১১তম, শীর্ষে থাকা আর্সেনাল এক ম্যাচ কম খেলেই ৮ পয়েন্টে এগিয়ে। শিরোপা ধরে রাখার স্বপ্ন আগেই ফিকে হয়ে গিয়েছিল বর্তমান চ্যাম্পিয়নদের। এখন এই করুণ হারের পর দলের পতন কীভাবে ঠেকাবেন কোচ আর্নে স্লট কিংবা ঠেকানোর জন্য তিনি লিভারপুলে আদৌ থাকবেন কি না, সেই অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলো জোরালো হতে শুরু করেছে।
আর্নে স্লট যুগে ফরেস্টের বিপক্ষে ম্যাচটাই সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ কেটেছে লিভারপুলের। ম্যাচ শেষ হতে যখন আর মাত্র ১২ মিনিট বাকি, মরগান গিবস-হোয়াইট নটিংহাম ফরেস্টের হয়ে তৃতীয় গোলটা করলেন। হতাশায় শত শত লিভারপুল সমর্থক মাঠ ছাড়তে শুরু করলেন। তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না! ম্যানচেস্টার সিটির কাছে বাজেভাবে হারটা হয়তো তাঁরা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু লিগ টেবিলের প্রায় তলানিতে থাকা নটিংহাম ফরেস্টের কাছে নিজেদের মাঠে এমন হার, এ তো রীতিমতো অপমানজনক!
মনে হচ্ছে, স্লটের সামনে এখন একের পর এক সমস্যা এসে পাহাড়ের মতো জমা হচ্ছে। সেগুলো থেকে তিনি দলকে উদ্ধার করবেন বা দলের কেউ তাঁকে উদ্ধার করে দেবে, এমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। রক্ষণে খুবই দুর্বল, মাঝমাঠে কোনো ধার নেই আর আক্রমণও যেন দাঁতভাঙা! লিগে সর্বশেষ সাত ম্যাচের ছয়টিতে হারল লিভারপুল।
শিরোপা ধরে রাখার আশা শুধু কাগজ-কলমের হিসাবে, বাস্তবে একেবারে ছিন্নভিন্ন!
চোট-আঘাতও অবশ্য কম ভোগায়নি লিভারপুলকে। ফ্লোরিয়ান ভির্টৎস এবং কনর ব্র্যাডলি এ সপ্তাহেই নতুন করে চোটে পড়েছেন। তবে স্লটের জন্য বড় দুশ্চিন্তা হলো, যাঁরা মাঠে আছেন, তাঁদের মধ্যে বিশ্বাস ও লড়াই করার মানসিকতার অভাব! দলের প্রতিষ্ঠিত তারকারা পথ হারিয়েছেন, ওদিকে গ্রীষ্মে আসা নতুন খেলোয়াড়েরাও নিজেদের ছাপ ফেলতে পারছেন না।
অ্যানফিল্ডে শেষ বাঁশি বাজার আগে ফরেস্ট সমর্থকেরা স্লটকে স্লেজিং করেছেন গলা ফাটিয়ে, ‘কাল সকালেই তোমার চাকরি যাচ্ছে!’ যদিও এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা আপাতত খুব কমই মনে হচ্ছে। তবে খুব দ্রুত যদি স্লট দলকে এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে না পারেন, পরিস্থিতি বদলে যেতেই পারে।
এই মৌসুমে লিভারপুলের রক্ষণ এত বাজে খেলছে যে এর দায় নির্দিষ্ট কোনো খেলোয়াড়কে চাপিয়ে দিলে সেটা অন্যায় হবে। তবে একই সঙ্গে এটাও সত্য, ইব্রাহিমা কোনাতের পারফরম্যান্স যেন আকাশ থেকে পাতালে নেমে গেছে!
মৌসুম শেষেই ক্লাবের সঙ্গে কোনাতের চুক্তি শেষ হতে চলেছে। হয়তো ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তাঁর পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলছে। কিন্তু নিজের মূল্য প্রমাণ করার বদলে কোনাতে এমন সব ভুল করছেন, যা সমর্থকদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ইদানীং তাঁর পারফরম্যান্স এমন হয়েছে, এখন তিনি যদি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, লিভারপুল সমর্থকদের বড় অংশই খেপে না উঠে বরং নির্বিকার থাকবেন।
আন্তর্জাতিক বিরতির আগে ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষেই কোনাতেকে দেখে মনে হয়েছে, নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন। ফরেস্টের বিপক্ষে ম্যাচেও আবার ভুলের পর ভুল। অহেতুক একটি কর্নার উপহার দিলেন, যেখান থেকেই ফরেস্টের প্রথম গোলটি আসে। এরপর ইগর জেসুসের গোলটা ভিএআর বাতিল না করলে কোনাতে আরও বিব্রত হতেন। তাঁর একের পর এক ভুল দেখে লিভারপুল সমর্থকেরা যখন হতাশ হয়ে চেঁচাচ্ছেন, বেঞ্চে বসে থাকা জো গোমেজ নিশ্চয়ই ভাবছিলেন—আর কী হলে তাঁর সুযোগ আসবে?
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই নিকোলো সাভোনার গোলে ২-০–তে পিছিয়ে পড়ার পর স্লট আর দেরি করেননি। কোনাতেকে তুলে নেন, রায়ান গ্র্যাভেনবার্চকে দেন অস্থায়ী সেন্টারব্যাকের দায়িত্ব। কোনাতের অভিযোগ করার কোনো কারণ ছিল না।
আলেক্সান্দার ইসাক আরও একবার হতাশার একটা রাত কাটিয়েছেন। পুরো ম্যাচে মাত্র ১৫ বার বল ছুঁয়েছেন, ম্যাচের শুরু থেকে খেলা খেলোয়াড়দের মধ্যে সবচেয়ে কম! প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় মাঠে প্রায় অদৃশ্য। প্রথমার্ধে একটা দৌড় ছাড়া কিছুই চোখে পড়েনি।
ম্যাচের আগে স্লট বলেছিলেন, ইসাককে ছন্দে ফেরাতে হলে অন্য ফরোয়ার্ডদের একটু সরাতে হবে। তাই উগো একিতিকেকে বসিয়ে ইসাককে নামানো হয়। কিন্তু ফল শূন্য। গোল নেই, ঝলক নেই, কারও সঙ্গে বোঝাপড়াও নেই।
এখনো লিভারপুলের হয়ে পুরো ৯০ মিনিট খেলেননি। একমাত্র গোলটা এসেছে কারাবাও কাপে সাউদাম্পটনের বিপক্ষে। আগামী ২১ দিনে ছয় ম্যাচ। স্লট হয়তো তাঁকে খেলিয়েই যাবেন। কিন্তু মানিয়ে নিতে সময়টা অনেক বেশি লাগছে।
অন্য কোচরা এ সময় যা করেন, স্লটও তা–ই করলেন। ম্যাচের পর হারের সব দায় নিলেন নিজের কাঁধে। বিবিসিকে বলেছেন, ‘ভালো হোক বা খারাপ হোক, দায় আমার। আমরা যথেষ্ট সুযোগ তৈরি করতে পারিনি। কিছু জিনিস পাল্টানোর চেষ্টা করেছি, কাজ হয়নি। গোলও করতে পারিনি। এই মাঠে একটা গোল হলে সবকিছু বদলে যেতে পারত।’
খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাস ধরে রাখতে বলেছেন লিভারপুল কোচ, ‘সামনে চ্যাম্পিয়নস লিগ, তারপর তিনটা লিগ ম্যাচ। মাথা নিচু করা যাবে না। কঠোর পরিশ্রম করে যেতে হবে। প্রতিদিনই আমরা চেষ্টা করছি।’
সেই চেষ্টার ফল না এলে সামনে স্লটের বিপদ যে আরও বাড়বে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো।