২০১৭ সালে বরুসিয়া ডর্টমুন্ড ছেড়ে বার্সেলোনার জার্সি গায়ে জড়িয়েছিলেন উসমান দেম্বেলে। কিন্তু তাঁকে নিয়ে বার্সেলোনা যে স্বপ্ন দেখেছিল, দেম্বেলে তার ধারেকাছেও যেতে পারেননি। বার্সেলোনায় ছয় বছর নিজের ছায়া হয়ে থাকা দেম্বেলের পারফরম্যান্সের চেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল তাঁর চোট ও মাঠের বাইরের নানা ঘটনা। বার্সার হাওয়া-বাতাস যেন তাঁর সইছিল না। শেষ পর্যন্ত হতাশা আর আক্ষেপের বোঝা নিয়ে ২০২৩ সালের আগস্টে পাড়ি জমান পিএসজিতে।
পিএসজি তখন বড় পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। লিওনেল মেসি ও নেইমার প্রায় একই সময়ে বিদায় নিয়েছেন। এমবাপ্পেও তখন যাই যাই করছিলেন, পরের মৌসুমে চলেই যান। তখনই নতুন পোস্টার বয় হয়ে হাজির দেম্বেলে। লুইস এনরিকের পিএসজি তখন একেবারে মেদহীন, ঝরঝরে এক দল।
তবে এই দল নিয়ে পিএসজি ইউরোপে কতটা সফল হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। কিন্তু গত মৌসুমে পিএসজি বদলে দিয়েছে সেই ধারণা। আর এতে বড় ভূমিকা ছিল দেম্বেলের। তাঁর পারফরম্যান্সই তাঁকে এবার ব্যালন ডি’অর জেতার কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। নাটকীয় কিছু না ঘটলে আজ প্যারিসের আলো ঝলমল মঞ্চে সোনালি ট্রফিটা উঠতে যাচ্ছে তাঁর হাতেই।
ব্যালন ডি’অর একজন ফুটবলারের জন্য সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সম্মান। এই ট্রফি জেতা এবং না জেতা—ফুটবলাররা অঘোষিতভাবেই দুটি আলাদা শ্রেণিতে ভাগ হয়ে যান। লম্বা সময় ধরে এই পুরস্কারটা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন লিওনেল মেসি (৮) ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো (৫)।
তবে এখন তাঁরা পর্দার আড়ালে চলে যাওয়ায় মঞ্চটা একরকম উন্মুক্ত হয়ে আছে। যেকোনো মৌসুমে দুর্দান্ত পারফর্ম করে যে কেউ বাজিমাত করে জিতে নিতে পারেন এই ট্রফি। গত বছর যেমন ম্যানচেস্টার সিটির মিডফিল্ডার রদ্রি এই পুরস্কার পেয়েছিলেন। এবার পারফরম্যান্স আর দলীয় সাফল্য—দুটি দিক থেকেই দেম্বেলে অন্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে।
এবারের ব্যালন ডি’অরের জন্য বিবেচনা করা হচ্ছে ২০২৪ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ১৩ জুলাই পর্যন্ত পারফরম্যান্স। এই সময়ে আলো ছড়িয়েছেন আরও কয়েকজন—লিভারপুলকে লিগ শিরোপা জেতাতে সালাহর ২৯ গোল, ১৮ গোলে সহায়তা; রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে এমবাপ্পের সর্বোচ্চ ৪৪ গোল; বার্সার হয়ে ইয়ামাল ও রাফিনিয়ার উজ্জ্বল পারফরম্যান্স। তবু দলীয় ও ব্যক্তিগত সাফল্য মিলিয়ে পাল্লা ভারী দেম্বেলের দিকেই।
পিএসজির জন্য ২০২৪-২৫ ছিল ইতিহাস বদলে দেওয়া এক মৌসুম। লিগ আঁ, ফ্রেঞ্চ কাপ আর চ্যাম্পিয়নস লিগ—সব জিতে ট্রেবল। ফাইনালে ইন্টার মিলানকে ৫-০ গোলে উড়িয়ে তারা হয়েছে ইউরোপ-সেরা। এই সাফল্যের অন্যতম রূপকার দেম্বেলে। সব মিলিয়ে মৌসুমে করেছেন ৩৫ গোল, সহায়তা করেছেন ১৬ গোলে।
শুরুটা অবশ্য ভালো ছিল না তাঁর। ২০২৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৮ ম্যাচে করেছিলেন মাত্র ৫ গোল। কিন্তু নতুন বছর শুরু হতেই আতশবাজির মতো বিস্ফোরিত হন দেম্বেলে। ১ জানুয়ারি থেকে মৌসুমের শেষ পর্যন্ত ২৯ ম্যাচে ২৫ গোল, ৮ গোলে সহায়তা। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় ম্যাচে টানা গোল। এক সপ্তাহে টানা দুটি হ্যাটট্রিক—একটি চ্যাম্পিয়নস লিগে স্টুটগার্টের বিপক্ষে, আরেকটি লিগ আঁতে ব্রেস্তের বিপক্ষে। ২০২৫ সালের প্রথম ২০ ম্যাচে ২৪ গোল—এককথায় অবিশ্বাস্য!
পিএসজির চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ে দেম্বেলের অবদান ছিল বিশাল। ১৪ গোলে সরাসরি অবদান (৮ গোল, ৬ গোলে সহায়তা)। ফরাসি কোনো ক্লাবের হয়ে এক মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে যা সর্বোচ্চ। প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে বেশি ৩৮টি সুযোগ তৈরি করেছেন দেম্বেলে, যা বার্সেলোনার রাফিনিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে সর্বোচ্চ। লিগ আঁতেও ছিলেন সেরা। ২১ গোল, ৮ সহায়তা—মোট ২৯ গোলের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল তাঁর নাম। আগের মৌসুমগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে পার্থক্যটা আরও স্পষ্ট হবে। ক্লাব বিশ্বকাপ বাদ দিলে শুধু ২০২৪-২৫ মৌসুমেই গোল আর সহায়তা যোগ করলে মোট ৪৮টি গোলের সঙ্গে নাম খুঁজে পাবেন দেম্বেলের।
গোল করা বা গোল করানোকে শেষ হয়নি দেম্বেলের ভূমিকা। কোচকে দিয়েছেন নানা বিকল্প। তাঁর পারফরম্যান্স সঙ্গীদেরও সেরাটা খেলতে অনুপ্রাণিত করেছে। একসময় যখন ইউরোপের সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়নদের তালিকা থেকে পিএসজির নাম মুছে ফেলতে বসেছিলেন অনেকে, তখনই ত্রাতা হয়ে দেম্বেলে দলকে তুলেছেন শীর্ষে।
আজ রাতে যদি সত্যি ব্যালন ডি’অরের সোনালি ট্রফি ওঠে দেম্বেলের হাতে, তবে সেটা শুধু তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্যের স্বীকৃতি হবে না, হবে পিএসজির ইতিহাস বদলে দেওয়া এক মৌসুমের সিলমোহরও। বার্সেলোনার বাতাসে না মানাতে পারলেও প্যারিসের আকাশে তো দেম্বেলে উড়েছেন ঠিকই।