এই মুহূর্তে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ পয়েন্ট তালিকার ছয়ে আছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড
এই মুহূর্তে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ পয়েন্ট তালিকার ছয়ে আছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড

৬ কারণে এবার প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিততে পারে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড

ফুটবলবিষয়ক ওয়েবসাইট গোল ডট কম বলছে, এবার প্রিমিয়ার লিগ জিততে পারে ইউনাইটেড। কেন, সে ব্যাখ্যা দিয়েছে তারা।

‘আমাদের লক্ষ্য অবশ্যই প্রিমিয়ার লিগ জেতা। জানি, গত মৌসুমের পর আমি এটা বলায় অনেকে হাসবে বা প্রশ্ন তুলবে। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য এটাই হওয়া উচিত’—যুক্তরাষ্ট্রে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের প্রাক্‌–মৌসুম সফরের সময় স্কাই স্পোর্টসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন দলটির ডিফেন্ডার লুক শ। তাঁর এই কথা তখন অনেকের কাছে প্রলাপের মতো মনে হয়েছিল। ক্লাবের ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে মৌসুমের পর এমন ঘোষণা তো পাগলামির কাছাকাছিই।

এরপর ইউনাইটেড ২০২৫-২৬ মৌসুমের শুরুটা করল কী বাজেভাবে। প্রথম ছয় ম্যাচে মাত্র দুই জয়। ব্রেন্টফোর্ডের মাঠে ৩-১ গোলে হারের পর সেপ্টেম্বরের শেষে তারা নেমে গিয়েছিল পয়েন্ট তালিকার ১৪ নম্বরে। সমর্থকদের বড় অংশই তখন রুবেন আমোরিমকে বরখাস্ত করার পক্ষে।

এক মাস আগেও রুবেন আমোরিমকে ছাঁটাইয়ের দাবি উঠেছিল

কিন্তু অক্টোবরে পাল্টে গেছে অনেক কিছু। ওল্ড ট্রাফোর্ডে সান্ডারল্যান্ডকে ২-০ গোলে হারিয়ে যেন প্রাণ ফিরে পায় আমোরিমের দল।

এরপর অ্যানফিল্ডে ৯ বছর পর লিভারপুলকে হারিয়ে আমোরিম পেয়ে যান ইউনাইটেড কোচ হিসেবে প্রথমবারের মতো টানা দুই জয়ের স্বাদ। এরপর ইউনাইটেড জিতেছে টানা তৃতীয় ম্যাচেও; ব্রাইটনকে ৪-২ গোলে হারিয়ে উঠে এসেছে পয়েন্ট তালিকার ৬ নম্বরে, শীর্ষে থাকা আর্সেনালের চেয়ে এখন পিছিয়ে তারা মাত্র ৬ পয়েন্টে।

ব্রাইটনের বিপক্ষে ম্যাচ শেষে আমোরিমও বলেছেন, ‘যখন আত্মবিশ্বাস বাড়ে, মনোবল পাল্টায়, তখন ভাগ্যও একটু করে পাশে আসে।’ দীর্ঘদিনের ব্যর্থতা আর হতাশার পর অবশেষে ভাগ্যকেও পাশে পেতে শুরু করেছে ইউনাইটেড। এখন লুক শর সেই ঘোষণা আর প্রলাপের মতো লাগছে না; বরং মনে হচ্ছে, ওটা এক আত্মবিশ্বাসী, সাহসী ভবিষ্যদ্বাণী।

ফুটবলবিষয়ক ওয়েবসাইট গোল তাই বলছে, এবার প্রিমিয়ার লিগ জিততে পারে ইউনাইটেড। কেন, সে ব্যাখ্যা দিয়েছে তারা।

এমবেউমো-আমাদ জুটি

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অনুশীলনে এমবেউমো (বাঁয়ে) ও আমাদ

ব্রায়ান এমবেউমোকে দলে ভেড়াতে ৭ কোটি ১০ লাখ পাউন্ড খরচের পর অনেক ইউনাইটেড সমর্থক চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন—এতে আমাদ দিয়ালোর ভবিষ্যৎ কী হবে?

গত মৌসুমে ব্রুনো ফার্নান্দেজের পর ইউনাইটেডের সবচেয়ে কার্যকর খেলোয়াড় ছিলেন আমাদ। ডান দিক দিয়ে কত স্মরণীয় মুহূর্ত উপহার দিয়েছেন—ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে তাঁর শেষ মুহূর্তের গোল, সাউদাম্পটনের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক! অন্যদিকে এমবেউমো ব্রেন্টফোর্ডে আগের মৌসুমে একই পজিশনে খেলে করেছিলেন ২০ গোল। তাই প্রশ্ন ছিল, আমোরিম কীভাবে একই দলে দুজনকেই খেলাবেন?

শুরুর দিকে কিছুটা অস্বস্তি ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠেছে ভয়ংকর এক জুটি, যাঁদের পারস্পরিক বোঝাপড়াই এখন ইউনাইটেডের ঘুরে দাঁড়ানোর মূল শক্তি। আমাদ এখন খেলছেন কিছুটা বদলে যাওয়া ভূমিকায়—ডান দিকে উইং ব্যাক হিসেবে, আর এমবেউমো থাকেন আমাদের ঠিক সামনে, ৩-৪-৩ ফরমেশনে ১০ নম্বর পজিশনে।

দুজনের জুটিটা হয়েছে মারাত্মক। লিভারপুলের বিপক্ষে তাঁদের সমন্বয় ছিল চোখধাঁধানো—দুই মিনিটেই গোল এনে দেন এমবেউমো। প্রথম ১০ ম্যাচে ৬ গোলে অবদান এমবেউমোর।

মাঠে এমবেউমো ও আমাদের বোঝাপড়া বেশ চমৎকার

ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যে আফ্রিকান নেশনস কাপে খেলতে যাবেন দুজনই। কিন্তু তাঁদের অনুপস্থিতিতেও যদি ইউনাইটেড আর্সেনালের কাছাকাছি থাকতে পারে, তাহলে ফিরেই এই দুই আফ্রিকান তারকা হয়তো দলের শিরোপা–লড়াইটা টেনে নিতে পারবেন মৌসুমের দ্বিতীয় ভাগ পর্যন্ত।

কুনিয়ার ছন্দে ফেরার আভাস

ব্রায়ান এমবেউমোর মতো দ্রুত মানিয়ে নিতে পারেননি মাথেউস কুনিয়া। ৬ কোটি ২৫ লাখ পাউন্ডে জুনে তাঁকে দলে টেনেছিল ইউনাইটেড। তখন মনে হয়েছিল, অবশেষে হয়তো ইউনাইটেড তাদের দীর্ঘদিনের গোল–সংকটের সমাধান পেয়ে গেছে। আগের মৌসুমে অবনমনের হুমকিতে থাকা উলভসের হয়ে প্রিমিয়ার লিগে ১৫ গোল করেছিলেন এই ব্রাজিলিয়ান।

কিন্তু ইউনাইটেডে শুরুটা একদমই আশানুরূপ হয়নি। প্রথম আট ম্যাচে কোনো গোল পাননি কুনিয়া। তার ওপর হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটে মিস করেন ম্যানচেস্টার ডার্বি, চেলসির বিপক্ষে নামতে পারেন মাত্র ২৫ মিনিটের জন্য।

তবু খারাপ খেলেছেন, এটা বলা যাবে না। বরং কুনিয়ার পারফরম্যান্স ধারাবাহিকভাবে ভালো হয়েছে। বল পায়ে দারুণ আত্মবিশ্বাসী, গতি দারুণ, মাঠে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন দ্রুত। এই গুণগুলোই ইউনাইটেডের আক্রমণকে করেছে আরও কার্যকর।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জার্সিতে অবশেষে গোল পেয়েছেন মাথেউস কুনিয়া

তবে স্ট্রাইকারের বিচার গোল দিয়েই হয়। কুনিয়া সেটাও পেয়ে গেছেন ব্রাইটনের বিপক্ষে ম্যাচের ২৪ মিনিটে। তাঁর ছন্দে ফেরার আভাস ইউনাইটেডের জন্য দারুণ সুখবর। এমবেউমোর মতো তিনিও প্রিমিয়ার লিগে পরীক্ষিত ম্যাচ উইনার। কঠিন পরিস্থিতিতে জাদুকরি মুহূর্ত উপহার দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।

অবশেষে চেনা ডি লিখট

ওল্ড ট্রাফোর্ডে মাথিস ডি লিখটের প্রথম মৌসুম ছিল বেশ হতাশাজনক। মাঝেমধ্যে ঝলক দেখালেও গতির ঘাটতি তাঁকে বারবার বিপদে ফেলেছিল। যেমনটা তিনি ভুগেছেন জুভেন্টাস ও বায়ার্ন মিউনিখে।

কিন্তু ২৬ বছর বয়সী এই ডাচ ডিফেন্ডার এবার খেলছেন এমনভাবে, যেন এই সুযোগই শেষ। আমোরিম তাঁকে হ্যারি ম্যাগুয়ারের চেয়ে বেশি সুযোগ দিচ্ছেন একাদশে, আর ডি লিখটও আস্থার প্রতিদান দিচ্ছেন মাঠে।

ডি লিখটের (ডানে) ডিফেন্ডিং বেশ আশা জাগানিয়া

ডি লিখট জানেন, যদি এবারও ব্যর্থ হন, ইউনাইটেড তো দূরে থাক, হয়তো ইউরোপের কোনো বড় ক্লাব আর তাঁকে চাইবে না। তাই এবার নেমেছেন নিজেকে প্রমাণের লড়াইয়ে। আর তাতে ধীরে ধীরে দেখা মিলছে সেই প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ ডিফেন্ডারের, যাঁকে একসময় আয়াক্স একাডেমির গর্ব বলা হতো।

গোলরক্ষক সংকটের অবসান

এডউইন ফন ডার সারের পর থেকেই বিশ্বমানের গোলকিপার খুঁজে ফিরছিল ইউনাইটেড। দাভিদ দে হেয়া ছিলেন বিশ্বস্ত, কিন্তু শেষ দিকে ভুল করতেন অনেক।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের নতুন গোলরক্ষক সেনে লামেন্স

আন্দ্রে ওনানা তো বলতে গেলে বিপর্যয় ডেকে এনেছিলেন ইউনাইটেডে। অবশেষে বেলজিয়ান সেনে লামেন্স এসে যেন স্বস্তির বাতাস বইয়ে দিয়েছেন ওল্ড ট্রাফোর্ডে।

সান্ডারল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেকেই ক্লিন শিট, লিভারপুল ও ব্রাইটনের বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ সেভ। বয়স মাত্র ২৩, কিন্তু আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। বোঝা যাচ্ছে, লামেন্সকে তাঁর দেশ বেলজিয়ামে কেন দীর্ঘদিন ধরে থিবো কোর্তোয়ার উত্তরসূরি মনে করা হচ্ছে।

বিশাল সাংস্কৃতিক পরিবর্তন

গত নভেম্বরে এরিক টেন হাগের উত্তরসূরি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আমোরিমকে অনেক ঝড় সামলাতে হয়েছে। কখনো কখনো তাঁকে টাচলাইনে এবং মিডিয়ার সামনে বিরক্ত ও ক্লান্ত মনে হয়েছে। তবে হাল ছাড়েননি। তিনি বড় বড় ঘোষণা দেননি, কিন্তু ছোট ছোট সিদ্ধান্তে বদলে দিয়েছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ভেতরের বাতাসটা।

প্রথম দিন থেকেই আমোরিমের জোর ছিল শৃঙ্খলায়। অনুশীলনে দেরি মানে জরিমানা। ক্লাবের ভেতরে অযথা জটিলতা বা রাজনীতি—কোনোটারই জায়গা নেই।
আমোরিম এমন একটা সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন, যেখানে নাম নয়, কাজটাই মুখ্য। খেলোয়াড়দের সামনে বারবার একটা কথাই বলেছেন, ‘তোমরা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জার্সি পরো, এর চেয়ে বড় কিছু নেই।’

এ বাক্যই এখন দলের প্রতিটি অনুশীলনে, প্রতিটি ম্যাচে প্রতিধ্বনিত হয়। তাঁর অধীনে তরুণেরা সুযোগ পাচ্ছেন, সিনিয়ররা দায় নিচ্ছেন। মাঠে একাত্মতার যে চিত্র এখন দেখা যায়, সেটা গত কয়েক মৌসুমে কল্পনাও করা যেত না।

প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর পতন

ইউনাইটেডের জন্য বড় সুখবর হচ্ছে, একদিকে তাদের উত্থান হচ্ছে, অন্যদিকে আশপাশের প্রতিদ্বন্দ্বীরা নিয়মিত হোঁচট খাচ্ছে।

সিটি আগের মতো ভয়ংকর নেই, হলান্ডকে আটকালে তারা দাঁড়াতেই পারে না। আর্নে স্লটের লিভারপুল এই মৌসুমে টানা হারের ধাক্কায় টালমাটাল। আর্সেনাল শীর্ষে থাকলেও তাদের ধারাবাহিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। চেলসি তো এখনো নিজেদের খুঁজছে। ‘বিগ সিক্স’-এর আরেক দল টটেনহামও আহামরি কিছু করতে পারছে না।

ম্যানচেস্টার সিটিকে এবার ভয়ংকর দল মনে হচ্ছে না

এরই মধ্যে ইউনাইটেড চুপচাপ উঠে এসেছে শিরোপা–লড়াইয়ের মঞ্চে। ইদানীং তারা পাশে পাচ্ছে ভাগ্যকেও। আর শিরোপা জিততে ভাগ্যকে একটু-আধটু পাশে লাগেই।

মৌসুমের শেষ পর্যন্ত এই ছন্দটা যদি ধরে রাখতে পারে ইউনাইটেড, ওল্ড ট্রাফোর্ডে ফিরতে পারে সেই হারানো গৌরব। সমর্থকদের মুখে মুখে শোনা যেতে পারে সেই গান—‘গ্লোরি গ্লোরি ম্যান ইউনইটেড’।