ছন্দে ফিরে দুর্দান্ত কিলিয়ান এমবাপ্পে
ছন্দে ফিরে দুর্দান্ত কিলিয়ান এমবাপ্পে

সেই এমবাপ্পেই এখন বড় স্বপ্ন দেখাচ্ছেন রিয়ালকে

গত বছরের নভেম্বরের শেষ দিকের কথা। ছন্দ হারিয়ে কিলিয়ান এমবাপ্পের তখন ছন্নছাড়া দশা। এরই মধ্যে লিভারপুলের কাছে চ্যাম্পিয়নস লিগে হারের পর ভাইরাল হয় এমবাপ্পের একটি ছবি। সেই ছবিতে দেখা যায়, ঘাড়ে ভর দিয়ে দুই পা ওপরে তুলে উল্টে আছেন ফরাসি তারকা। এ ছবি নিয়ে সে সময় হাসাহাসিও হয়েছে অনেকে। কেউ কেউ এ ছবিকে এমবাপ্পের চলমান দুর্দশার সঙ্গেও মিলিয়ে পাঠ করেছেন।

সমালোচক বা ট্রলকারীদের অবশ্য দোষ দেওয়ার খুব একটা সুযোগ ছিল না। সে সময়টায় ধারাবাহিকভাবেই বাজে পারফরম্যান্স করে যাচ্ছিলেন এমবাপ্পে। যা তাঁকে রীতিমতো কোণঠাসা করে ফেলেছিল।

লিভারপুলের বিপক্ষে সেই বাজে অভিজ্ঞতা অন্যভাবে ফিরে এসেছিল কদিন পর। অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের বিপক্ষে রিয়ালের ২-১ গোলে হারের রাতে পেনাল্টি মিস করে বসেন এমবাপ্পে। এরপর কেউ কেউ তাঁকে ডাকতে শুরু করেন ‘মিস পেনাল্টি’ নামে। বেশ বিব্রতকর অভিজ্ঞতাই বটে। অথচ চিত্রটা মোটেই এমন হওয়ার কথা ছিল না।

কয়েক বছর ধরে চলতে থাকা নাটকীয়তা ও উত্থান-পতনের পর্ব পার করে গ্রীষ্মের দলবদলেই পিএসজি ছেড়ে রিয়ালে আসেন এমবাপ্পে। ঘটনার ঘনঘটা এবং নামের কারণে স্বাভাবিকভাবেই শুরু থেকে মাইক্রোস্কোপের নিচে ছিলেন এমবাপ্পে। তাঁর প্রতিটি মুহূর্তকে নজরদারি করা হচ্ছিল কঠোরভাবে।

দর্শক, সমর্থক, সাবেক ফুটবলার বা সংবাদমাধ্যম—সবার চোখ ছিল তাঁর ওপর। আর পান থেকে চুন খসলেই গেল গেল রব। ‘রিয়াল তাকে কিনে ভুল করেছে’ বা ‘এমবাপ্পে চাপ নিতে পারেন না’—এমন কথাতেও ছেয়ে গিয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। অনেকটা অন্যায্যভাবেই দলের বাজে পারফরম্যান্সের বেশির ভাগ দায় বহন করতে হচ্ছিল তাঁকেই। এমনকি দলের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য সময় দিতেও যেন সবার অনীহা।

এমন পরিস্থিতিতে জবাবটাকে এমবাপ্পেকে মাঠেই দিতে হতো। এমন নয় যে শুরু থেকে খুবই বাজে পারফরম্যান্স করছিলেন কিংবা তাঁকে মাঠে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সমস্যাটা ছিল ধারাবাহিকতায়। নিয়মিত একই তালে খেলতে পারছিলেন না।

ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করার পথে গোলের পর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো উদ্‌যাপন করেছেন কিলিয়ান এমবাপ্পে

পাশাপাশি দলীয় সমন্বয়ে এমবাপ্পের ভূমিকাটা কেমন হবে, তা–ও স্পষ্ট ছিল না। এসব কারণে নিজেকে ঠিকঠাক মেলেও ধরতে পারছিলেন না। কেউ কেউ তখন তারকার আধিক্যের কারণে রিয়ালের এমন দশা কি না, সেই সন্দেহও করছিলেন। বিশেষ করে গ্যালাকটিকোস নিয়ে অতীত অভিজ্ঞতা ভালো না হওয়ায় এই আশঙ্কা একেবারে অমূলকও ছিল না।

কিন্তু এত সব নেতিবাচক আলাপের বিপরীতে একটি প্রতিজ্ঞার কথা শুনিয়েছিলেন এমবাপ্পে। বিলবাওয়ের বিপক্ষে পেনাল্টি মিসের পর বলেছিলেন, ‘কঠিন মুহূর্ত। কিন্তু এ পরিস্থিতি বদলানোর এবং আমি কে, সেটা দেখানোর সবচেয়ে ভালো সময়ও এটা।’

এটি যে নিছক কথার কথা ছিল না, সেই প্রমাণ দিতে খুব বেশি সময় নেননি এমবাপ্পে। দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করতে শুরু করেন বিশ্বকাপজয়ী এই তারকা। যা মৌসুমের শেষ ভাগে এসে দৃশ্যপটটাই যেন বদলে দিয়েছে। এ মুহূর্তে চলতি মৌসুমের অন্যতম সফল তারকার নাম বললে সে তালিকায় নিশ্চিতভাবেই আসবে এমবাপ্পের নাম। তাঁর এই ছন্দ ফেরা রিয়ালের জন্যও দারুণ স্বস্তির। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে রিয়ালকে একাধিকবার তিনি সামনে থেকেই পথ দেখিয়েছেন।

চ্যাম্পিয়নস লিগে শেষ ষোলোয় ওঠার প্লে-অফের কথাই ধরা যাক। ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে প্রথম লেগে ১ গোল করার পর দ্বিতীয় লেগে করেছিলেন হ্যাটট্রিক। বলা যায়, এমবাপ্পের কাছেই আত্মসমর্পণ করেছিল গার্দিওলার সিটি। এরপর আতলেতিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে শেষ ষোলোতেও এমবাপ্পে খেলেছেন দারুণ। দ্বিতীয় লেগে ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের মিস করা পেনাল্টিটা তাঁরই আদায় করা। ফাউলের শিকার না হয়ে সেই আক্রমণটা যদি পরিণতি দিতে পারতেন, তবে সেটি চলতি মৌসুমের অন্যতম সেরা গোলের স্বীকৃতিও পেতে পারত।

রিয়ালের হয়ে লিগে এমবাপ্পে প্রথম ১৪ ম্যাচে করেছিলেন ৭ গোল, আর পরের ১৪ ম্যাচে করলেন ১৩ গোল।

চ্যাম্পিয়নস লিগের ধারবাহিতা এমবাপ্পে টেনে এনেছেন লা লিগায়ও। শনিবার রাতে ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে রিয়ালের ২-১ গোলের জয়ে করেছেন জোড়া গোল। চলতি মৌসুমে লা লিগায় এমবাপ্পে এখন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা। ২৬ ম্যাচে এমবাপ্পের গোল এখন ২০টি, সঙ্গে আছে ৩টি অ্যাসিস্টও। তবে এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, রিয়ালের হয়ে এমবাপ্পে প্রথম ১৪ ম্যাচে করেছিলেন ৭ গোল, আর পরের ১৪ ম্যাচে করলেন ১৩ গোল। এমবাপ্পের পারফরম্যান্সের বিবর্তন বুঝতে এটুকু পরিসংখ্যানই বোধ হয় যথেষ্ট।

এই গোলের পথে একটি মাইলফলকও গড়েন এমবাপ্পে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর রিয়ালের হয়ে নিজের প্রথম ২৫ ম্যাচে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোল তাঁর—১৮। রোনালদো প্রথম ২৫ ম্যাচে করেছিলেন ২০ গোল। লা লিগায় সর্বোচ্চ গোলে এমবাপ্পে এখন হুমকি দিচ্ছেন রবার্ট লেভানডফস্কিকে। ২৫ ম্যাচে তাঁর চেয়ে ১ গোল বেশি করে শীর্ষে আছেন লেভা। আর সব মিলিয়ে চলতি মৌসুমে এমবাপ্পের গোল এখন ৪৩ ম্যাচে ৩০টি, যেখানে সঙ্গে ৪টি অ্যাসিস্টও আছে।

এখন সব বাদ দিয়ে শুধু এ মুহূর্ত পর্যন্ত পরিসংখ্যানকেও যদি বিবেচনা করা হয়, এমবাপ্পেকে পুরো নম্বর দিতে হবে। এর সঙ্গে বড় ম্যাচে জ্বলে ওঠা কিংবা দলের গুরুত্বপূর্ণ সময়ের পারফরম্যান্সকে যোগ করলে তিনি নিশ্চিতভাবেই এ মৌসুমের অন্যতম সেরা তারকাদের একজনই।

রিয়ালের তারকাবহুল দলে প্রথম মৌসুমেই এককভাবে সব আলো টেনে নেওয়া অবশ্য সহজ ছিল না। যে দলের ফ্রন্টলাইনে ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, জুড বেলিংহাম ও রদ্রিগোর মতো তিনজন তারকা আছেন, তাঁদের পেছনে ফেলে একক পারফরমার হয়ে ওঠা বেশ কঠিনই।

কিলিয়ান এমবাপ্পে (বাঁয়ে) ও ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের জুটিটা দারুণ জমেছে

কিন্তু সেই কঠিন কাজটাই খুব সহজে করেছেন এমবাপ্পে। এমনকি পিএসজিতে এমবাপ্পের রূঢ় রূপের কথা শোনা গিয়েছিল, সেটিও এখানে দেখা যায়নি। বরং ভিনিসিয়ুস-বেলিংহামদের সঙ্গে তাঁর মিথস্ক্রিয়া বেশ চোখে পড়ার মতো। যার ফলে রিয়াল আক্রমণভাগ এখন যেন ক্ষুরধার ও তীব্র।

এমন পারফরম্যান্সের পরও অবশ্য এমবাপ্পে এখন পর্যন্ত সফল নন। রিয়ালের সাফল্যের মাপকাঠিই যে ট্রফি। যতক্ষণ পর্যন্ত ট্রফি হাতে উঠছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত সফল বলার সুযোগ নেই।

আশার কথা, মৌসুম শেষে তিনটি শিরোপা জয়ের সুযোগ আছে রিয়ালের। যেখানে চ্যাম্পিয়নস লিগ ও লা লিগার পাশাপাশি আছে কোপা দেল রে জেতার সুযোগও। আর এ সুযোগ কাজে লাগাতে এমবাপ্পের শতভাগ চায় রিয়ালের। এখন মৌসুমের শেষ পর্যন্ত ছন্দ ধরে রেখে রিয়ালকে এমবাপ্পে শিরোপা এনে দিতে পারেন কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষা।