৫ কারণে প্রিমিয়ার লিগের এই মৌসুম হতে পারে ইতিহাসের সেরা

শুক্রবার আসতে আর কত দিন!
ইউরোপিয়ান ফুটবল যাঁরা পছন্দ করেন, গত কয়েকটা মাস নিশ্চয়ই তাঁদের খালি খালি লাগছিল। মৌসুম শেষের বিরতি চলছিল বলে কোনো খেলা ছিল না। ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোর যাঁরা ভক্ত-সমর্থক, তাঁদের এই সময় কাটে অপেক্ষায়। আবার কবে নতুন মৌসুম শুরু হবে! সেই অপেক্ষা অবশেষে শেষ হচ্ছে। বাংলাদেশ সময় আগামী শুক্রবার (১৫ আগস্ট) রাত থেকে শুরু হচ্ছে ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের তিনটি। একই দিনে মাঠে গড়াবে ২০২৫-২৬ মৌসুমের ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, স্প্যানিশ লা লিগা ও ফরাসি লিগ আঁ।

সবচেয়ে বেশি অপেক্ষা প্রিমিয়ার লিগের জন্যই। প্রচার, প্রসার ও জনপ্রিয়তায় ইংল্যান্ডের এই শীর্ষ ফুটবল লিগই সবচেয়ে এগিয়ে। গত কয়েক দশকে প্রিমিয়ার লিগ উপহার দিয়েছে ফুটবলপ্রেমীদের স্মৃতিতে চিরস্থায়ী ছবি হয়ে যাওয়া কত মুহূর্ত!
এভারটনের হয়ে ওয়েইন রুনির প্রথম গোল, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে অভিষেক, জেমি ক্যারাঘারকে বোকা বানানো থিয়েরি অঁরির সেই গোল, মাঝমাঠ থেকে ডেভিড বেকহামের গোল, রয় কিন ও প্যাট্রিক ভিয়েরার সেই ঝগড়া, স্ট্যান কলিমোরের শেষ মুহূর্তের গোল, ধারাভাষ্যকারের ‘আগুয়েরোওওওওওও’ চিৎকার, কেভিন কিগানের আনন্দ, লেস্টারের অলৌকিক শিরোপা জয়ে ক্লদিও রানিয়েরির পাশে দাঁড়িয়ে আন্দ্রেয়া বোচেলির গান!

প্রিমিয়ার লিগের নতুন আরেকটা মৌসুম শুরুর আগে ফুটবলপ্রেমীদের মনে হয়তো উঁকি মারছে সেসব স্মৃতি। এবার নতুন একটা মৌসুমের অপেক্ষা, অপেক্ষা নতুন করে রোমাঞ্চিত হওয়ার। ফুটবল–বোদ্ধারা অনেকেই মনে করছেন, উত্তেজনা আর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবারের মৌসুমটা হতে পারে প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসেরই সেরা। কেন, চলুন দেখা যাক—

এবার লড়াই চার দলের

বাজির অঙ্কই বলছে লিভারপুল, আর্সেনাল, ম্যানচেস্টার সিটি ও চেলসি—সবাই আছে প্রিমিয়ার লিগ জেতার দৌড়ে

গত মৌসুমে আর্নে স্লটের লিভারপুল শিরোপা-লড়াইটাকে খুবই একপেশে বানিয়ে ফেলেছিল। ফেব্রুয়ারিতেই ম্যানচেস্টার সিটিকে ২-০ হারিয়ে দলটি শিরোপা প্রায় নিশ্চিত করে ফেলে। এরপর বলতে গেলে শুধু আনুষ্ঠানিকতাই বাকি ছিল।
এবার হয়তো তেমন হচ্ছে না। বাজির অঙ্কই বলছে লিভারপুল, আর্সেনাল, ম্যানচেস্টার সিটি ও চেলসি—সবাই আছে দৌড়ে। অন্তত মৌসুম শুরুর আগে চারটা দলকেই মনে হচ্ছে শিরোপার দাবিদার।

লিভেরপুলের জার্সিতে ফ্লোরিয়ান ভির্টৎস

লিভারপুল দলে এনেছে ফ্লোরিয়ান ভির্টৎসকে, যাকে অনেকে বলছেন বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে সৃজনশীল তরুণ তারকা। কেভিন ডি ব্রুইনা, কাইল ওয়াকার, জ্যাক গ্রিলিশদের ছেড়ে দিয়ে তরুণদের ওপর আস্থা রেখেছে ম্যানচেস্টার সিটি, আর্সেনাল অবশেষে খুঁজে পেয়েছে তাদের কাঙ্ক্ষিত স্ট্রাইকার, আর পিএসজির বিপক্ষে প্রাক্‌-মৌসুম প্রস্তুতি ম্যাচে চেলসি দেখিয়েছে, তারাও সেরাদের সঙ্গে লড়তে তৈরি।
এই চার দলের মুখোমুখি ১২টি ম্যাচেই সবচেয়ে বেশি চোখ থাকবে ফুটবলপ্রেমীদের।

গোল, গোল ও গোলের বন্যা

প্রিমিয়ার লিগের নামিদামি স্ট্রাইকাররা

এবার যেন স্ট্রাইকারদের মেলা বসেছে প্রিমিয়ার লিগে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে লিগের গোল সংখ্যায়।
২০২৪-২৫ মৌসুমে যেকোনো প্রিমিয়ার লিগ মৌসুমের চেয়ে সবচেয়ে বেশি ‘বিগ চান্স’ নষ্ট হয়েছিল, মোট ১২০১টি। ফলে আগের মৌসুমের (২০২৩-২৪) প্রতি ম্যাচে গোলের গড় ৩.২৮ থেকে গত মৌসুমে তা কমে ২.৯৩-এ নেমে এসেছিল।
গ্রীষ্মকালীন দলবদলের সময় শেষ হতে আরও কয়েক সপ্তাহ বাকি থাকলেও এরই মধ্যে প্রিমিয়ার লিগ ক্লাবগুলোর নতুন খেলোয়াড় কিনতে ২০০ কোটি ইউরোর বেশি খরচ করেছে। আর এই খরচের একটা বড় অংশ গেছে স্ট্রাইকারদের পেছনে।

ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে লিভারপুলে যোগ দিয়েছেন ফরাসি ফরোয়ার্ড হুগো একিতিকে

লাইপজিগ থেকে বেঞ্জামিন সেসকোকে নিয়ে এসেছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ৭ কোটি ৬৫ লাখ ইউরোর এই স্ট্রাইকার তাঁর গতি, দৌড় আর বল ধরে রাখার সামর্থ্য দেখিয়ে এরই মধ্যে মুগ্ধ করেছেন। ভিক্টর ইয়োকেরেসের সঙ্গে ২০৩০ সালের জুন পর্যন্ত চুক্তি করেছে আর্সেনাল। ২৭ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকারকে স্পোর্তিং লিসবনের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিতে আর্সেনালকে দিতে হয়েছে ৭ কোটি ৩৫ লাখ ইউরো। মিকেল আরতেতার না মেলা পাজলের শেষ টুকরা হতে পারবেন কি তিনি?
আইনট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে লিভারপুলে যোগ দিয়েছেন ফরাসি ফরোয়ার্ড হুগো একিতিকে। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি হতে পারেন লিভারপুলের নতুন নাম্বার নাইন। এরই মধ্যে কমিউনিটি শিল্ডে নিজের ফিনিশিং দক্ষতার কিছুটা ঝলক ইংল্যান্ডের ফুটবলপ্রেমীদের দেখিয়েছেন একিতিকে।
আর আগে থেকেই আছেন আলেকজান্ডার ইসাক, ম্যাথুস কুনহা, আর্লিং হলান্ড, ওমর মারমুশ, কোল পালমার ও মোহাম্মদ সালাহরা। লিগে এবার গোলের বন্যা বইতেই পারে।

দ্রুত পাল্টা আক্রমণের যুগ: পেপ কি মানিয়ে নিতে পারবেন

পেপ গার্দিওলা

পাল্টা আক্রমণের খেলায় প্রিমিয়ার লিগ আগে থেকেই সেরা। গত কয়েক মৌসুমে সেটা একটা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।
ফুটবল পরিসংখ্যানবিষয়ক প্রতিষ্ঠান অপ্টা ২০১৮-১৯ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচগুলোতে ৩৮৯টি প্রতি-আক্রমণ রেকর্ড করেছিল। গত মৌসুমে এই সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছে ৭৭৫, যা প্রায় দ্বিগুণ। এই ৭৭৫টি প্রতি-আক্রমণের মধ্যে ১১২টিতে গোল হয়েছিল, যা ২০২৩-২৪ মৌসুমে হওয়া গোলের চেয়ে ৩১টি বেশি।
আর প্রতি-আক্রমণে সেরা দল কোনটি? চ্যাম্পিয়ন লিভারপুল। সালাহকে সামনে রেখে লিভারপুল গত মৌসুমে প্রতি-আক্রমণ থেকে ৫২টি শট ও ১৪টি গোল করেছে। গত ৭ বছরের মধ্যে সব দল মিলিয়ে যা মৌসুম-সর্বোচ্চ।

নতুন মৌসুমে গার্দিওলা কি তাঁর দলকে পাল্টা আক্রমণের ছন্দে ঢেলে সাজাতে পারবেন?

অন্যদিকে পেপ গার্দিওলা খুব কাছ থেকেই দেখেছেন কীভাবে তাঁর দল ম্যানচেস্টার সিটি এই জায়গায় পিছিয়ে পড়েছে। তাঁর পজিশননির্ভর ফুটবল এখন আর অন্য দলগুলোকে খুব একটা ঝামেলায় ফেলতে পারছে না।
গার্দিওলাও হয়তো এখন নতুন এই ট্রেন্ডের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। জেরেমি ডোকু ও রায়ান চেরকির মতো খেলোয়াড়দের দিয়ে সেই চেষ্টার একটা ছাপ দেখা গেছে। নতুন মৌসুমে গার্দিওলা কি তাঁর দলকে পাল্টা আক্রমণের ছন্দে ঢেলে সাজাতে পারবেন? সিটিকে নিয়ে সবচেয়ে বড় কৌতূহল এটাই।

নবাগতদের লড়াই: পুরোনো ধারা বদলাতে পারে

সর্বশেষ মৌসুমে একটি বিরক্তিকর প্রবণতা দেখা গেছে প্রিমিয়ার লিগে— নিচের লিগ থেকে উঠে আসা তিনটি ক্লাবই আবার অবনমিত হয়ে গেছে। তবে এবার বার্নলি, সান্ডারল্যান্ড ও লিডসকে নিয়ে প্রত্যাশা একটু ভিন্ন। এবার আসা এই তিনটি দলেরই একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য, তারা নিজেদের ঘরের মাঠকে দুর্গে পরিণত করতে পারে। টার্ফ মুর, এল্যান্ড রোড ও স্টেডিয়াম অফলাইট প্রতিপক্ষ দলগুলোর জন্য ভয়ংকর হয়ে ওঠতে পারে। বড় দলগুলো এসব মাঠে পয়েন্ট হারালে উলট-পালট হয়ে যেতে পারে লিগের হিসাব-নিকাশ।

সিটির হয়ে নতুন মৌসুমের শুরুতে খেলতে পারবেন না রদ্রি

চোট-সমস্যা এবার কম হবে

গত মৌসুমে লিভারপুলের শিরোপা জয়ে বড় ভূমিকা ছিল তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোতে চোটের হানা। এবার গ্রীষ্মে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ বাদে বড় কোনো (বিশ্বকাপ বা ইউরো) আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট হয়নি, মানে খেলোয়াড়রা সতেজ। আর্সেনাল, সিটি, ইউনাইটেড, টটেনহাম, চেলসি—সব দলই তাদের সেরা একাদশটাকে বেশি ম্যাচে খেলাতে পারবে। ফলে গত মৌসুমে লিভারপুলের যে সুবিধা ছিল, এবার তা কমে যাবে। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়বে অনেক।
আর এসব কারণেই প্রিমিয়ার লিগের এবারের মৌসুমটা থেকে চোখ ফেরানো কঠিন হয়ে যেতে পারে ফুটবলপ্রেমীদের জন্য।
এখন একটাই প্রশ্ন, শুক্রবার আসতে আর কত দিন!