
একেকটি দিন যেন একেকটি বছরের মতো মনে হচ্ছে তাঁর কাছে। পারলে এখনই উড়াল দিতেন। প্রশিক্ষণ নিতে আর্জেন্টিনায় যাওয়ার সুযোগ সামনে, তর সইবে কেন! কিন্তু ভিসা তো পেতে হবে। দিন দশেক আগে ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে দিল্লিতে। ভিসা হয়ে গেলেই উঠে বসবেন বিমানে। যাবেন স্বপ্নের দেশে।
হঠাৎই আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো সুযোগ এসে পড়েছে বাংলাদেশে বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলে খেলা উদীয়মান ফুটবলার মিনহাজুল করিমের। স্বাধীন ডাকনামেই যাঁকে চেনে সবাই। আর্জেন্টিনার তৃতীয় বিভাগের ক্লাব অ্যাথলেটিকো ভিলা সান কার্লোস ক্লাব তাঁকে অনুশীলনে যোগ দিতে আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছে। আপাতত এক মাস অনুশীলন। নজর কাড়তে পারলে ক্লাবটি রেখেও দিতে পারে স্বাধীনকে।
প্রথমে শুনে অবিশ্বাস্য লেগেছে স্বাধীনের। এখনো যেন ঘোরের মধ্যে আছেন। নিজেই বলছেন, ‘গত রোজার ঈদের ছুটিতে ঢাকার শেখ জামাল ক্লাব থেকে যশোরের বাড়ি আসছিলাম। রাস্তাতেই ফোন পাই শেখ জামালের আর্জেন্টাইন ট্রেনার আরিয়েল কোলম্যানের। উনি বলেন, “তোমাকে তো ওরা পছন্দ করেছে।” তখন আমি আম্মাকে জানাই, শুনে আম্মা কেঁদে দেন। আমিও কাঁদি। আব্বাও কান্না করেছেন। এটা আসলেই স্বপ্নের মতো। আমি আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করি, মেসির খেলা দেখি। কখনো ওই দেশে যাওয়া হবে ভাবিনি।’
কিন্তু সেটিই এখন বাস্তব হতে চলেছে। স্বাধীন তাকিয়ে আছেন দিল্লির দিকে, কবে ভিসা পাবেন। এই অপেক্ষাও নাকি তাঁর কাছে মধুর লাগছে, ‘অপেক্ষাটা যদি উপভোগ করা যায়, সেটা মধুর হয়। এই সময়ে নিজেকে মানসিক আর শারীরিকভাবে প্রস্তুত করার সুযোগ পাচ্ছি।’ একটা লক্ষ্যও ঠিক করে রেখেছেন, ‘একটা সুযোগ পেয়েছি আর্জেন্টিনায় যাওয়ার। ক্লাবে ট্রায়াল দিয়ে বাংলাদেশের মুখ রাখতে চাই, পরে যেন তারা আমার কথা বলে। কোনো ক্লাবে চুক্তি করে সেখানে খেলতে চাই।’
স্বাধীনকে এই দুর্লভ সুযোগের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন আরিয়েল কোলম্যান। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ ফুটবল দলের আর্জেন্টাইন কোচ ডিয়োগো ক্রুসিয়ানির সঙ্গে কোলম্যান ট্রেনার হিসেবে কাজ করতে প্রথম ঢাকায় আসেন। সেই থেকে বাংলাদেশই তাঁর দ্বিতীয় বাড়ি। বর্তমানে শেখ জামাল ধানমন্ডির ট্রেনার। যশোরের বিখ্যাত শামস-উল-হুদা ফুটবল একাডেমিতে গিয়ে একটা প্রীতি ম্যাচে স্বাধীনের খেলা দেখে তাঁকে পছন্দ করেন কোলম্যান। তার আগেই অবশ্য স্বাধীনকে ঢাকায় নিজেদের ক্যাম্পে নিয়ে আসে শেখ জামাল। কিন্তু ঢাকায় স্বাধীনকে শুধু অনুশীলনে দেখেছেন কোলম্যান। শামস-উল-হুদা ফুটবল একাডেমিতে গিয়ে একটা ম্যাচে স্বাধীনকে দেখেই তিনি মুগ্ধ হয়ে যান।
কোলম্যান প্রথম আলোকে সেটাই বলছিলেন, ‘স্বাধীন রাইট উইংয়ে খেলে, খুবই ভালো ফুটবলার। আর্জেন্টিনায় কয়েকটি ক্লাবে আমি ওর ভিডিও পাঠাই। এখন সে বুয়েনস এইরেসের একটি ক্লাবে যাচ্ছে। ক্লাব থাকা-খাওয়ার খরচ দেবে। শামস-উল-হুদা একাডেমি দেবে বিমানভাড়া। চেষ্টা করব, বুয়েনস এইরেসের তৃতীয় বা চতুর্থ বিভাগের কোনো দলে স্বাধীনকে ঢোকাতে। একটি ক্লাবের সঙ্গে কথাও বলেছি। সবকিছু আসলে ওর পারফরম্যান্সের ওপর নির্ভর করছে। আগামী সপ্তাহে ভিসা পেয়ে যাবে আশা করি। তাহলে এ মাসের শেষ দিকে যেতে পারে।’
স্বাধীনের জীবনে এই বাঁকবদলে বড় অবদান শামস-উল-হুদা একাডেমির। এটি পরিচালিত হচ্ছে রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের অর্থায়নে। এর চেয়ারম্যান নাসের শাহরিয়ার জাহেদী একাডেমির চেয়ারম্যান। জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত যশোরের প্রয়াত ক্রীড়া সংগঠক শামস-উল-হুদা তাঁর শ্বশুর। নাসের শাহরিয়ার জাহেদীর পরিশ্রম আর আন্তরিকতায় গড়ে ওঠা একাডেমিতে ২০১৬ সালে আসেন যশোরের নওদা গ্রামের ছেলে স্বাধীন। স্থানীয় হামিদপুর প্রাথমিক স্কুলের বিরুদ্ধে আন্তস্কুল টুর্নামেন্টে নজর কেড়েছিল কিশোর স্বাধীন, একাডেমির প্রধান কোচ কাজী মারুফ তাঁকে একাডেমিতে নিয়ে আসেন।
ছাত্র এমন সুযোগ পাওয়ায় কাজী মারুফ স্বাভাবিকভাবেই গর্বিত। যশোর থেকে ফোনে বলেন, ‘কোলম্যান আমাদের একাডেমি দেখে অভিভূত হয়ে যান। এখানে তিনি তিন দিন ছিলেন। অনুশীলনও করান। আমাদের বলেন, তোমাদের ৪-৫টা ছেলে আছে, যারা ইউরোপে খেলার যোগ্য। আমি যোগাযোগ করলে তোমরা অনাপত্তিপত্র দেবে তো? আমরা সম্মতি দেওয়ায় কোলম্যান সামনে এগিয়েছেন। স্বাধীন আর্জেন্টিনা যাচ্ছে, আমরা এতে খুবই আনন্দিত।’
স্বাধীন ২০১৬ সালে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব–১৪ দলের হয়ে মক কাপ, পরের বছর অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ, ২০১৮ সালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ খেলেছেন। ২০১৮ সালে বাফুফের যুব ক্লাব টুর্নামেন্টে ঢাকা আবাহনীর হয়ে খেলে ২ গোল করেছেন, সহায়তা করেছেন আরও ৪টি গোলে। ২০১৯ সালে দ্বিতীয় বিভাগে খেলেছেন দিলকুশায়, ২০২০ সালে প্রথম বিভাগে ফ্রেন্ড সোশ্যালে। ২০২১ সালে পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের জার্সিতে ৬ গোল করার পাশাপাশি সহায়তা করেছেন ৮টিতে। শেখ জামালের সঙ্গে এখনো তাঁর কোনো চুক্তি হয়নি। সামনের মৌসুমে হবে। ক্লাব ফুটবলের উত্তাপ গায়ে মাখার আগেই ম্যারাডোনা-মেসিদের দেশে যাচ্ছেন স্বাধীন।