জিয়ানলুইজি বুফন এখন আর ইতালির গোলপোস্টের নিচে দাঁড়ান না। অনেক দিন ধরেই তিনি সাবেক। তবে কিংবদন্তি এই গোলরক্ষক জাতীয় দলের সঙ্গেই যুক্ত, আপাতত তাঁর ভূমিকা ‘হেড অব ডেলিগেশন’ বা দলনেতা। গ্লাভস জোড়া তুলে রাখলেও ইতালিয়ান ফুটবলের ওপর তাঁর নজর এখনো সেই বাজপাখির মতোই তীক্ষ্ণ। আর সেই নজর দিয়েই তিনি যা দেখলেন, তা ইতালির ফুটবল–ভক্তদের জন্য মোটেই সুখবর নয়।
সম্প্রতি গাজেত্তা দেলো স্পোর্তকে দেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে বুফন ইতালির ফুটবল–ব্যবস্থাকে একেবারে ধুয়ে দিয়েছেন। তাঁর মতে, দশকের পর দশক ধরে চলে আসা আত্মতুষ্টি আর কর্তাদের অদূরদর্শী চিন্তাভাবনাই ইতালির ফুটবলকে খাদের কিনারে নিয়ে গেছে।
চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালি ২০১৮ ও ২০২২ বিশ্বকাপে জায়গা পায়নি। ২০২৬ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বেও নিজেদের গ্রুপ থেকে সরাসরি বিশ্বকাপের টিকিট কাটতে পারেনি, খেলতে হবে প্লে-অফে। আর সেই প্লে-অফে জিততে হবে দুটি ম্যাচ।
প্রথম ম্যাচে (সেমিফাইনাল) ইতালির প্রতিপক্ষ উত্তর আয়ারল্যান্ড। এই ম্যাচ জিতলে ওয়েলস–বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা ম্যাচের জয়ী দলের বিপক্ষে ফাইনাল। বিশ্বকাপ খেলতে হলে ওই ম্যাচটি জিততেই হবে। আর তা না পারলে টানা তিন বিশ্বকাপে দর্শক হয়ে থাকার মতো অবিশ্বাস্য ঘটনার সম্মুখীন হবে ইতালির ফুটবল।
তবে বুফন সতর্ক করে দিয়েছেন, ইতালির লজ্জা শুধু এখানেই শেষ না–ও হতে পারে। এভাবে চলতে থাকলে আরও তলানিতে যেতে পারে চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দেশের ফুটবল।
কথায় বলে, গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। বুফনের অবস্থাও হয়েছিল তাই। ২০১০ বিশ্বকাপ থেকে ব্যর্থ হয়ে ফেরার পর তিনি একটা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমরা ভুল করেছি, সন্দেহ নেই। কিন্তু সাবধান! কয়েক বছর পর এমন দিন আসবে যখন বিশ্বকাপ জেতা তো দূরের কথা, বাছাইপর্ব পার হতে পারলেই আমরা উৎসবে মেতে উঠব।’
বুফন এখন মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ওটা কোনো জাদুকরি ভবিষ্যদ্বাণী ছিল না, ছিল নির্মম বাস্তবতাকে আগেভাগে চিনতে পারার ক্ষমতা। তিনি বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছিলাম কী হতে যাচ্ছে। পরিবর্তনগুলো খুব দ্রুত ঘটছিল। আমি চেয়েছিলাম, আমরা যেন নিজেদের এমন কোনো রূপকথার গল্প না শোনাই, যার অস্তিত্ব বাস্তবে নেই।’
অতীতের জাবর কাটা আর সেই অলস ‘ফড়িং’ ইউরোপের অন্য পরাশক্তিদের সঙ্গে ইতালির পার্থক্যটা কোথায়? বুফন মনে করেন, ইতালি এখনো ইতিহাসের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে ঘুরছে, যেখানে অন্যরা বর্তমানে বাঁচে। তাঁর ভাষায়, ‘সমস্যা হলো আমরা দুই নৌকায় পা দিয়ে চলছি। ফ্রান্স ৩০ বছর ধরে রাজত্ব করছে, স্পেন প্রায় ২০ বছর ধরে। ওরা বর্তমান নিয়ে ভাবে। আর আমরা? আমরা অহংকারী। আমরা ভাবি, ঐশ্বরিক কৃপায় সবকিছু আমাদের পাওনা। আমাদের তো বুফন আছে, ক্যানাভারো আছে, টট্টি আছে—আর কী লাগে?’
এখানেই বুফন পিঁপড়ে আর ফড়িংয়ের সেই বিখ্যাত গল্পের উপমা টেনেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের উচিত ছিল তখনই কৌশল আর মডেলে পরিবর্তন আনা। কিন্তু আমরা তা না করে ওই গল্পের ফড়িংয়ের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। যারা শুধু গান গেয়ে সময় কাটিয়েছে, ভবিষ্যতের রসদ জমায়নি।’
বুফন সরাসরি আঙুল তুলেছেন ইতালির ফুটবলের নীতিনির্ধারকদের দিকে। দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা নেই, সবাই ব্যস্ত ‘আজ’ আর ‘এখন’ নিয়ে। বুফনের সাফ কথা, ‘সংস্কারের জন্য সাহস লাগে, যেটা আমাদের রাজনীতির মাঠে দেখা যায় না। সবাই ব্যস্ত ভোট নিয়ে, তাই তারা কেবল আজকের কথাই ভাবে। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করার সময় বা ইচ্ছে—কোনোটাই তাদের নেই।’
সাক্ষাৎকারের শেষটা বুফন করেছেন আরও একটা ভবিষ্যদ্বাণী দিয়ে। যদি এখনই ধৈর্যের সঙ্গে শক্ত হাতে হাল ধরা না হয়, তবে এই সংকট কাটবে না। ইতালির সর্বকালের সেরা এই গোলরক্ষক বলেন, ‘খুব সহজ হিসাব লিখে রাখুন, আজ থেকে ১০ বছর পর আমার জায়গায় অন্য কোনো ‘‘বুফন’’ বসে থাকবে। আর আপনি তাকে ঠিক এই প্রশ্নগুলোই করবেন। উত্তরগুলোও হবে হুবহু এক।’