Thank you for trying Sticky AMP!!

গলফার জামাল হোসেন

গলফ ক্লাবে আমগাছ পাহারা দিতে দিতে আজ তিনি চ্যাম্পিয়ন গলফার

ছোটবেলায় মায়ের হাত ধরে কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন জামাল হোসেন। কিন্তু মন পড়ে থাকত খেলাধুলায়। মামা মো. সিদ্দিক তা দেখে বললেন, ‘ছেলেটার যেহেতু লেখাপড়ায় মন নেই, ওকে একটা চাকরি দিয়ে দিই। লেখাপড়া করল আবার কিছু টাকাও এল।’

১০ বছরের শিরোপা–খরা ঘোচাতে পারবেন কি সিদ্দিকুর

যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। জামাল হোসেনকে নিয়ে যাওয়া হলো কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে। তারপর? ‘আমি যখন প্রথমবার কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে যাই, আমার মামা গলফ ক্লাবের সব আমগাছ চুক্তিতে নেন। মানে আমগুলো কিনে নেন। আমার কাজ ছিল সেসব আমগাছ দেখাশোনা করা। মামা বলেছিলেন, আমগাছগুলো তুমি দেখবে। পাহারা দেবে। সারা দিন আমগাছের নিচে ঘুরতাম। পাকা আম খেতাম। প্রচুর আম খাওয়া হতো। সালটা মনে নেই। সম্ভবত ১৯৯৫-৯৬ সালের কথা। গলফ ক্লাবে গিয়ে এই হলো আমার প্রথম অভিজ্ঞতা’—স্মৃতিচারণ করেন জামাল হোসেন।

এশিয়ান ট্যুরে খেলতে চান জামাল

কয়েক দিন পর মামাকে ৭ থেকে ৮ বছরের জামাল বললেন, তাঁকে বলবয় হিসেবে কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে ভর্তি করে দিতে। তখন কেডি মাস্টার প্রয়াত আমমত আলী বলবয়ের কাজ দেন কিশোর জামালকে। ২০০০ সালের আগে প্রথম বলবয় হয়ে প্রতিদিন ৩০, ৪০, ৫০ টাকা পেতেন। যাঁকে ঘিরে এই স্মৃতিচারণা, তিনি এখন বাংলাদেশের অতিপরিচিত একজন গলফার—জামাল হোসেন। সিদ্দিকুর রহমানের পর যাঁর পরিচিতি সবচেয়ে বেশি। জামালের ঝুলিতে কোনো এশিয়ান ট্যুর না থাকলেও ৫টি পিজিটিআই শিরোপা আছে।

কাতারে ২৭ কোটি টাকার টুর্নামেন্টে খেলা নিয়ে শঙ্কা সিদ্দিকুরের

সর্বশেষ ২২ এপ্রিল ঈদের দিন ভারতের আহমেদাবাদে পিজিটিআই টুর্নামেন্ট জিতেছেন জামাল। ভারতে এটি তাঁর দ্বিতীয় টুর্নামেন্ট জয়। ২০১৯ সালে প্রথমবার জেতেন ভারতে। বাংলাদেশে পিজিটিআই জেতেন ২০০৯, ২০১২ সালে। ২০১৩ সালে বিটিআই ওপেনও জিতেছেন। ২০১০ সালে পেশাদার গলফার হওয়ার পর এখন পর্যন্ত বেশ ভালোই এগোচ্ছেন। সিদ্দিকুর যেমন নানা দেশের ঘুরে ঘুরে খেলেন, জামাল বেশি খেলেন ভারতে। বছরে প্রায় সাত থেকে আট মাসই পড়ে থাকেন সেখানে। ভারতে ২০টির মতো টুর্নামেন্ট হয় বছরে, জামাল এর বেশির ভাগই খেলেন। গত বছর ৩৪ লাখ রুপি আয় করেন ভারতে। টাকা আয়ের দিক থেকে গত বছর ভারতে ‘অর্ডার অব মেরিট’–এ সেরা সাতে ছিলেন ভারতে।

পরিবারের সঙ্গে জামাল হোসেন

ভারতে এক কোটি রুপির প্রাইজমানির এই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ১৫ শতাংশ অর্থ পাচ্ছেন জামাল। যার পরিমাণ ১৫ লাখ রুপি। কী করবেন টাকা? ‘খেলায় লাগাব। একটা টুর্নামেন্ট খেলতে তো টাকা লাগে। আমার লক্ষ্য আরও ভালো জায়গায় খেলা’—বলছিলেন ৩৭ বছর বয়সী জামাল হোসেন।

ভারতে এই টুর্নামেন্টে জাপান, স্কটল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি দেশের গলফার এসেছিলেন। এশিয়ান ট্যুর জেতা খেলোয়াড় ছিলেন। যেমন ভারতের কালিন জোশি, রাশেদ খান, শামীম খানসহ কয়েকজন ছিলেন। টুর্নামেন্টটিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় ভারতে আগামী ২ বছর সব টুর্নামেন্ট খেলতে পারবেন জামাল। তাঁর সামনে ভারতে খেলার অবারিত সুযোগ। কিন্তু সেটা অর্জনের পেছনে আছে অনেক পরিশ্রম, যা থেকে যায় আড়ালেই।

সৌদি আরবে ৫৩ কোটি টাকার গলফ টুর্নামেন্টে সিদ্দিকুর

সেসব কথা বলতে বলতে আপ্লুত হয়ে পড়েন মাত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে থেমে যাওয়া জামাল। পেছন তাকিয়ে বলেন, ‘ছোট বেলায় মাত্র ৭ থেকে ৮ বছর বয়সে গলফ কোর্সে প্রথম এসে দেখি সিদ্দিক ভাই, মিলন, জুয়েল, হোসেনরা জাতীয় দলে খেলেন। সিদ্দিক ভাই তখন বিদেশে যান। আমারও ইচ্ছা হলো ভালো গলফার হবো, বিদেশে যাব। বাসায় গিয়ে এসব কথা আম্মুকে বলতাম। তিনি উৎসাহ দিতেন। আর সেটা আমাকে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে’— কথাগুলো বলতে বলতে জামালকে কিছুটা তৃপ্ত দেখায়।

এই ফাঁকে জামাল জানান বোনের সহায়তা পাওয়ার কথাও, ‘আমি প্রথম গলফ খেলা শুরু করলে বড় বোন ১০ হাজার টাকায় একটা গলফ সেট কিনে দেন। ভগ্নিপতি বিদেশে থাকতেন। তিনি আমাদের অনেক সহায়তা করতেন, যা কখনো ভুলব না।’

কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবেই গলফার হয়ে উঠেছেন জামাল হোসেন

কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবের কর্মকর্তাদের সহায়তা পাওয়ার কথাও বলেন বারবার। সহায়তা পেয়েছেন স্ত্রী পারভীন আক্তারেরও। বলবয় হিসেবে মেজর জেনারেল জীবন কানই দাসের সঙ্গে খেলতেন জামাল। সারা দিন পড়ে থাকতেন খেলা নিয়ে। খাওয়ার কথাও নাকি চিন্তা করতেন না। তখন টাকাও ছিল না সে রকম। ২০০৬ সালে জাতীয় দলে খেলায়াড় সুযোগ পান। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

জামালের জন্ম কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ থানার হাতিমারা গ্রামে। কৃষক বাবা আবদুর করিম মারা যান জামালের মাত্র ছয় মাস বয়সে। মাস তিনেক পরই মাত্র ৯ মাসের জামালকে নিয়ে মা নুরজাহান বেগম চলে আসেন ঢাকায়। ওঠেন কচুখেত এলাকায়। তাঁরা তিন বোন এক ভাই। মা ঢাকার আসার সময় ১৬ থেকে ১৭ বছর বয়সের বড় বোনকেও আনেন। দুই বোন ছিল গ্রামে চাচার কাছে। বড় বোন ঢাকায় এসে চাকরি নেন। কিছুদিন পর তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। এরই মধ্যে ছোট দুটি বোনকেও ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। মেজ বোনও চাকরি নেয়।

আসলে বাবা না থাকলে যা হয় আর কি! কষ্টেই কাটে জীবন। জামালও ব্যতিক্রম নয়। আর সেটা বলতে তাঁর কোনো দ্বিধা নেই, ‘মাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আত্মীয়স্বজনের সহায়তা পেয়েছেন। আমি গলফ ক্লাবে কাজ শুরু করলে আস্তে আস্তে তাঁর কষ্টটা কমে। ওইটুকু বয়সে আমি পরিবারকে সমর্থন দিই। বোনেরা অনেক কষ্ট করেছে। এটা মনে হলে খারাপ লাগে।’

গলফার ছাড়া অন্য কিছু হতে চাননি জামাল হোসেন

গলফ না খেললে কী হতেন জানেন না জামাল। অন্য কিছু হওয়ার ইচ্ছা জাগার সময়ও হয়নি তাঁর। গলফ ছাড়া অন্য প্রিয় খেলা ফুটবল। খেলা খেলা করেই কাটে সারা বেলা। আর খেলার পেছনে পরিবারের সমর্থন পান অনেক। ক্যারিয়ারের কথা ভাবলে জামালের খারাপ লাগে। তিনবার চেষ্টা করেও এশিয়ান ট্যুরে খেলতে পারেননি। এ নিয়ে হতাশা আছে জামালের। এ বছর বাংলাদেশে এশিয়ান ট্যুর হলে তখন আবার চেষ্টা করবেন।

তবে জামাল এখন পরিবার নিয়ে ভালো আছেন। দুই ছেলের বাবা হয়েছেন। গলফ খেলে ঢাকাতে ফ্ল্যাট করেছেন। ছোটবেলায় প্রথম গলফ ক্লাব গিয়ে আমগাছ পাহারা দেওয়া ছেলেটি আজ চ্যাম্পিয়ন গলফার।