
অভিজ্ঞতা বনাম তারুণ্যের লড়াইয়ে জয়ী শেষ পর্যন্ত তারুণ্যই। গত এক যুগে ১৬ বারের চ্যাম্পিয়ন শিরিন আক্তারকে হারিয়ে পরশু ১৭তম জাতীয় সামার অ্যাথলেটিকসে দেশের দ্রুততম মানবী হয়েছেন সুমাইয়া দেওয়ান। ২০২২ সালের পর এই প্রথম। মাঠে বিভ্রান্তি, গ্যালারিতে উত্তেজনা—সবকিছুর মধ্যেও সুমাইয়া ছিলেন নিশ্চিত, জয় তাঁরই হবে। কাল জাতীয় স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে সুমাইয়া কথা বললেন সেসব নিয়েই—
আবার দ্রুততম মানবী হওয়ার মুহূর্তটা কেমন ছিল?
সুমাইয়া দেওয়ান: খুব ভালো। ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আগের জায়গায় ফিরে আসতে পেরেছি। তবে এখানেই থেমে থাকতে চাই না। অনেক দূর যাওয়ার স্বপ্ন দেখি।
যখন ফিনিশিং লাইনে পড়ে গেলেন, তখন কি ভয় হয়েছিল যে হয়তো জিততে পারবেন না?
সুমাইয়া: হয়নি। কারণ, শুরু থেকেই আত্মবিশ্বাসী ছিলাম প্রথম হব। ফিনিশিং লাইনে পড়ে গেলেও আমি ধরে নিই, আমিই প্রথম।
মাঠে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল, প্রথমে অনেকেই ভেবেছিলেন, শিরিন জিতেছেন। তখন আপনার মনের অবস্থা কেমন ছিল?
সুমাইয়া: আমি নিশ্চিত ছিলাম জয়ের ব্যাপারে। শিরিন আপু যে আনন্দ করছিলেন, সেটা আমি দেখিনি। তখন আমি অপেক্ষায় ছিলাম, কখন সিদ্ধান্তটা জানাবে।
শিরিন আক্তার বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকসের কিংবদন্তি স্প্রিন্টার। গত এক যুগে ১৬ বার জাতীয় পর্যায়ে ১০০ মিটার জিতেছেন। তাঁর মতো অভিজ্ঞ অ্যাথলেটের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে কেমন লাগে?
সুমাইয়া: খুব ভালো। শিরিন আপুর কাছে অনেক কিছু শেখার আছে। আমরা দুজনই নৌবাহিনীর অ্যাথলেট। প্রতিদিনই তাঁর সঙ্গে অনুশীলনে দেখা হয়। তিনি আমার বড় আপুর মতো। দুজনই বিকেএসপিতে পড়েছি। যদিও বিকেএসপিতে তাঁকে পাইনি। ২০১৭ সালে আমি যখন বিকেএসপিতে ভর্তি হই, তত দিনে তিনি বেরিয়ে গেছেন।
২০২২ সালে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে প্রথমবার শিরিনকে হারিয়েছিলেন। এই দুই জয়ের মধ্যে কোনটা আপনার কাছে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ?
সুমাইয়া: দুটি দুই রকম, তবে তাৎপর্য সমান। ২০২২ সালে আমি ন্যাশনালে প্রথম অংশ নিয়েই শিরিন আপুকে ১০০ মিটারে হারাই। তখন তিনি টানা ১২ বারের চ্যাম্পিয়ন। দারুণ অনুভূতি হয়েছিল তখন। তিন বছর পর আমি আবার নিজের জায়গায় ফিরে এসেছি।
শিরিনকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আপনি কীভাবে দেখেন—চ্যালেঞ্জ, অনুপ্রেরণা, নাকি দুটোই?
সুমাইয়া: দুটোই। চ্যালেঞ্জ এই অর্থে যে তিনি অনেক অভিজ্ঞ। আর অনুপ্রেরণা হলো, তাঁকে দেখে আমরা শিখি।
শারীরিক ও মানসিকভাবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কোথায় ছিল?
সুমাইয়া: পরপর কয়েকটি মিটে আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলাম। কিন্তু এবার কোনো সমস্যা ছিল না। সবদিক থেকেই আমি ফিট ছিলাম।
এখন আপনার লক্ষ্য কী—শুধু জাতীয় পর্যায় নয়, আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেকে কীভাবে দেখতে চান?
সুমাইয়া: দ্রুততম মানবীর খেতাব ধরে রাখতে চাই। সামনে এসএ গেমসে ভালো কিছু করার স্বপ্ন দেখি। আমার যা টাইমিং, তা আরও ভালো করার চেষ্টা করব। আর চাইব, বিউটি আপার ১৭ বারের দ্রুততম মানবীর খেতাব ছাড়িয়ে যেতে।
ছোটবেলায় কি ভেবেছিলেন, একদিন দেশের দ্রুততম মানবী হবেন?
সুমাইয়া: ছোট থেকেই অ্যাথলেটিকসের প্রতি আগ্রহ ছিল। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় ইন্টার স্কুল অ্যাথলেটিকসে খেলি। সেখান থেকেই আমার উঠে আসা। বোঝার বয়স থেকেই স্বপ্ন ছিল দেশের দ্রুততম মানবী হব।
আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা কে?
সুমাইয়া: আমার বাবা তজুমুদ্দিন দেওয়ান। তিনি সব সময় সাহস দিতেন। ২০২০ সালে হার্ট অ্যাটাকে তিনি মারা যান। তিনি কৃষিকাজ করতেন। মানিকগঞ্জ সদরে গড়পাড়া আলী নগরে আমাদের বাড়ি। আমরা তিন বোন। বোনদের মধ্যে আমি সবার বড়। আমি এখন ঢাবিতে চারুকলায় প্রিন্ট মেকিংয়ে পড়ি প্রথম বর্ষে।
আপনার বয়স এখন ২১। এত দূর আসতে কতটা কষ্ট করতে হয়েছে?
সুমাইয়া: ছোট থেকেই আর্থিক কষ্টে বড় হয়েছি। স্কুলে সময়মতো বেতন দিতে পারতাম না। সংসার চলবে না, আমার পরীক্ষার ফি দেবে, এমন টানাপোড়েন চলত। এমনও দিন গেছে, স্কুলে টিফিনের সময় বন্ধুরা খেত, আমি টাকার অভাবে খেতে পারতাম না। একসময় রানিং শু কেনার টাকাও ছিল না। আমাকে প্রথম রানিং শু কিনে দেন আমার বাবা, ২০১৬ সালে সাড়ে ৪ হাজার টাকায়।
প্রতিযোগিতার সময় পরিবারের লোকেরা মাঠে আসেন?
সুমাইয়া: না, এখন পর্যন্ত আমার কোনো প্রতিযোগিতা দেখতে পরিবারের কেউ আসেননি। এমনকি নিজের বোনেরাও নন। তবে কাকাতো বোন এসেছেন।
আপনার প্রিয় অ্যাথলেট কে?
সুমাইয়া: জ্যামাইকার শেলি অ্যান ফ্রেজার।
জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন?
সুমাইয়া: অলিম্পিক গেমসে অংশ নেওয়া।